বরাবরের মতই এবারও হিন্দু-মুসলিম-সমস্যার সমাধান-চেষ্টা ব্যর্থ হয়। বিরোধ আরও বাড়িয়া যায়। ১৯২৮ সালের প্রজাস্বত্ব আইনের প্রশ্নে দল নির্বিশেষে সব হিন্দু মেম্বররা জমিদার পক্ষে এবং দল-নির্বিশেষে সব মুসলিম মেম্বাররা প্রজার পক্ষে ভোট দেন। আইনসভা স্পষ্টতঃ সাম্প্রদায়িক ভাগে বিভক্ত হয়। পর বৎসর সুভাষ বাবুর নেতৃত্বে কৃষ্ণনগর কংগ্রেস সম্মিলনীতে দেশবন্ধুর বেংগল প্যাকেট বাতিল করা হয়। কি মুসলমানের স্বার্থের দিক দিয়া, কি প্রজার স্বার্থের দিক দিয়া, কোন দিক দিয়াই কংগ্রেসের উপর নির্ভর করিয়া চলা আর সম্ভব থাকিল না।
৩. প্রজা-সমিতির জন্ম
আমরা মুসলমান কংগ্রেসীরা মওলানা আকরম খাঁ সাহেবের নেতৃত্বে কংগ্রেস বর্জন করিয়া নিখিল-বংগ প্রজা সমিতি গঠন করি (১৯২৯)। সার আবদুর রহিম এই সমিতির সভাপতি ও মওলানা আকরম খাঁ ইহার সেক্রেটারি হন। মৌঃ মুজিবুর রহমান, মৌঃ আবদুল করিম, মৌঃ ফযলুল হক, ডাঃ আবদুল্ল সুহরাওয়ার্দী, খান বাহাদুর আবদুল মোমিন সি. আই. ই. ইহার ভাইস প্রেসিডেন্ট, মৌঃ শামসুদ্দিন আহমদ ও মৌঃ তমিয়ুদ্দিন খাঁ জয়েন্ট সেক্রেটারি নির্বাচিত হন। এইভাবে রাজনৈতিক মত-ও দল-নির্বিশেষ বাংলার সমস্ত হিন্দু নেতা জমিদারের পক্ষে কংগ্রেসে এবং সমস্ত মুসলিম নেতা প্রজার পক্ষে প্রজা-সমিতিতে সংঘবদ্ধ হইলেন। এই পরিস্থিতি লক্ষ্য করিয়া দেশপ্রিয় জে, এম. সেনগুপ্ত একদিন আফসোস করিয়াছিলেন : “আজ হইতে কংগ্রেস শুধু মুসলিম-বাংলার আস্থাই হারাইল না, প্রজাসাধারণের আস্থাও হারাইল।” মিঃ সেনগুপ্তের ভবিষ্যদ্বাণী অক্ষরে-অক্ষরেকলিয়া গিয়াছিল।
এই সময় আমি ওকালতি পাস করিয়া ‘দি মুসলমানের’ কাজ ছাড়িয়া ময়মনসিংহ জিলা কোটে প্র্যাকটিস শুরু করি। সংগে-সংগে নিখিল বংগ প্ৰজা সমিতির ময়মনসিংহ শাখা গঠন করিবার কাজে হাত দেই। অল্পদিন মধ্যেই এ কাজে আশাতিরিক্ত সাফল্য লাভ করি। এ কাজে ময়মনসিংহ বারের মোখতার মৌঃ আবদুল হাকিম ও শ্রীযুক্ত প্রমথ চন্দ্র বসু, কতোয়ালী থানার মওলানা আলতাফ হোসেন, কাতলাসেনের মৌলবী আবদুল করিম খাঁ, উকিল মৌঃ মোহাম্মদ কলম আলী, ত্রিশাল থানার মৌঃ ওয়ায়েযুদ্দিন, ঈশ্বরগঞ্জের মৌঃ আবদুল ওয়াহেদ বোকাই নগরী, ফুলপুরের মৌঃ মুজিবুর রহমান খী ফুলপুরী ও মওলানা আবদুর রহমান, নান্দাইল থানার মওলানা বোরহান উদ্দীন কামালপুরী ও মৌঃ আবদুর রশিদ খা, জামালপুরের মৌঃ তৈয়ব আলী উকিল ও মৌঃ গিয়াসুদ্দিন আহমদ, টাংগাইলের উকিল মৌঃ খোন্দকার আবদুস সামাদ, মোখর মৌঃ খোদা বখশ ও মৌঃ নিযামুদ্দিন আহমদ, নেত্রকোনার উকিল মৌঃ আবদুর রহিম ও মৌঃ আবদুস সামাদ তালুকদার, কিশোরগঞ্জের মৌঃ আফতাবুদ্দিন আহমদ, মৌঃ মোহাম্মদ ইসরাইল উকিল ও মৌঃ আবু আহমদের সহায়তার কথা আমি জীবনে ভুলিতে পারিব না। তাঁদের নিঃস্বার্থ কঠোর পরিশ্রমে অল্পকাল মধ্যেই ময়মনসিংহ প্রজা-সমিতি একটি শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। প্রজা আন্দোলন সংঘবদ্ধ আন্দোলনের আকারে মাথা চাড়া দিয়া উঠে। পরবর্তীকালে অবসরপ্রাপ্ত ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট মৌঃ আবদুল মজিদ ও ধনবাড়ির জমিদার নবাবযাদা সৈয়দ হাসান আলী প্রজা আন্দোলনে যোগ দেন। তাতে ময়মনসিংহ প্রজা সমিতির শক্তি ও মর্যাদা বাড়িয়া যায়। এই দুই জনের অর্থ সাহায্যে প্রজা-সমিতির নিজস্ব ছাপাখানা কিনিয়া ‘চাষী’ নামে প্রজা আন্দোলনের সাপ্তাহিক মুখপত্র বাহির করি।
সাহিত্যিক হিসাবে জিলার সরকারী-বেসরকারী উভয় মহলে আমার একটা বিশেষ স্নেহ-প্রীতির স্থান ছিল। কাজেই আমি ময়মনসিংহে ওকালতি শুরু করার সাথে-সাথেই সকল দলের মুসলমান নেতারা আমাকে আপন করিয়া লইলেন। শহরের যাঁরা মুরুৰি তাঁদের সকলের কাছেই আমি পরিচিত। বছর পনর আগে স্কুলের ছাত্র হিসাবে সভা-সমিতিতে বক্তৃতা করিয়া এবং প্রবন্ধ পাঠ করিয়া সুনাম অর্জন ও মুরুব্বিদের স্নেহ-ভালবাসা লাভ করিয়াছিলাম। এরাই সকলে মিলিয়া আমাকে এমন এক সম্মানের স্থানে বসাইলেন যেখানে বসিবার আমার কোন যোগ্যতা ছিল না, অভিজ্ঞতা ও বয়সের দিকে হইতেও না, মতবাদের দিক হইতেও না। এই পদটি ছিল আঞ্জুমনে-ইসলামিয়ার সহকারী সভাপতির পদ। করটিয়ার স্বনামধন্য জমিদার ওয়াজেদ আলী খানপন্নী (চান মিয়া সাহেব) আঞ্জুমনের সভাপতি। কিন্তু তিনি থাকেন কলিকাতা। কোনদিন আঞ্জুমনের সভায় আসেন না। দুইজন সহসভাপতি : একজন সার এ. কে. গযনবী; আরেক জন জিলার সর্বজনমান্য প্রবীণ নেতা খান বাহাদুর ইসমাইল। আমি যখন ময়মনসিংহ বারে যোগ দেই সেই বছরই সার এ, কে, গযনবী বাংলার লাটের একযিকিউটিভ কাউন্সিলার নিযুক্ত হন। নিয়মানুসারে তিনি আঞ্জুমনের সহ সভাপতিত্বে ইস্তাফা দেন। তাঁরই স্থলে আমাকে সর্বসম্মতিক্রমে সহসভাপতি নির্বাচন করা হয়–আমার ঘোরতর আপত্তি সত্ত্বেও। আমার জ্যেষ্ঠভ্রাতা-তুল্য শ্রদ্ধেয় মৌঃ শাহাবুদ্দিন আহমদ আঞ্জুমনের সেক্রেটারি। আঞ্জুমনের অপর ভাইস প্রেসিডেন্ট খান বাহাদুর ইসমাইল সাহেব পাবলিক প্রসিকিউটর ও জিলা বোর্ডের চেয়ারম্যান আঞ্জুমনের সভায় উপস্থিত হওয়ারও আলোচনায় যোগ দেওয়ার সময় তাঁর খুবই কম। কাজেই আমাকেই কার্যতঃ আঞ্জুমনের প্রেসিডেন্টের কাজ করিতে হইত। আমার বয়সে অনেক বড় ও ওকালতিতে অনেক সিনিয়র মৌঃ তৈয়বুদ্দিন খান সাহেব (পরে খান বাহাদুর), শরফুদ্দিন খান সাহেব (পরে খান বাহাদুর নূরুল আমিন, আবদুল মোননম খাঁ, গিয়াসুদ্দিন পাঠান, মৌঃ মোঃ ছমেদ আলী প্রভৃতি অনেক যোগ্যতার ও মান্যগণ্য ব্যক্তি থাকিতেও আমাকে যে এই সম্মান দেওয়া হইয়াছিল তার একমাত্র কারণ ছিল আমার প্রতি মুরুব্বিদের স্নেহ।