কলিকাতা টাউন হলে মুসলিম লীগ সম্মিলনী খুব ধুমধামের সাথে অনুষ্ঠিত হইল। আমার নেতা ও মনিব মৌলবী মুজিবুর রহমান অভ্যর্থনা সমিতির চেয়ারম্যান। ডাঃ আর. আহমদ সেক্রেটারি। চেয়ারম্যানের ইচ্ছা অনুসার্কে আমাকে অভ্যর্থনা সমিতির অন্যতম সহকারী সেক্রেটারি করা হইল। আমি জীবনের প্রথম এই নিখিল ভারতীয় কনফারেন্সের কাজ ঘনিষ্ঠভাবে দেখিবার সুযোগ পাইলাম। মৌঃ মোহাম্মদ ইয়াকুব (পরে সার) এই সম্মিলনীতে সভাপতিত্ব করেন। সস্ত্রীক জিনা সাহেব এই সম্মিলনীতে যোগ দেন। আমি মিসেস রতন বাই জিন্নাকে অত কাছে হইতে এই প্রথম ও শেষবারের মত দেখিতে পাই।
মিঃ জিন্না ও মওলানা মোহাম্মদ আলীর ব্যক্তিগত বিরোধের সুযোগ লইয়া নাইট-নবাবরা অতঃপর মুসলিম লীগ কাউন্সিলে জিন্না সাহেবের উপর অনাস্থা দিবার চেষ্টা করেন। দিল্লীতে লীগ কাউন্সিলের সভা। মৌলবী মুজিবুর রহমান ও মওলানা আকরম খাঁর নেতৃত্বে বাংলার কাউন্সিলারগণ দলবদ্ধভাবে দিল্লী গেলাম জিন্না নেতৃত্বকে নাইট-নারবদের হামলা হইতে বাঁচাইতে। বাংলার প্রতিনিধিরা আমরা কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট ডাঃ আনসারীর মেহমান হই। ডাঃ আনসারীর যমুনা পারস্থ দরিয়াগঞ্জের সুবৃহৎ প্রাসাদতুল্য বাড়ি গোটাটাই আমাদের জন্য ছাড়িয়া দেওয়া হয়। আমাদের খাওয়ার ব্যবস্থাও ডাঃ সাহেবই করেন।
জিন্না-বিরোধী উপদলও খুব ভোড়জোড় করে। দিল্লীর বিল্লিমারন রোডে এক বিশাল ভবনে কাউন্সিলের সভা রু হয়। কিন্তু ডাঃ আনসারীর উদ্যোগে নেতৃবৃন্দের চেষ্টায় কাউন্সিল বৈঠকের আগেই জিন্না সাহেব ও মওলানা মোহাম্মদ আলীর মধ্যকার বিরোধ মিটিয়া যায়। কাউন্সিল বৈঠকের শুরুতে উভয় নেতার মধ্যে কোলাকুলি হয়। আমরা হর্ষধ্বনি ও করতালি দিয়া তাঁদেরে অভিনন্দন জানাই। জিন্না বিরোধীরা একদম চুপ মারিয়া যান। শান্তিপূর্ণভাবে কাউন্সিলের কাজ শেষ হয়। কাউন্সিল জিন্না-নেতৃত্বে আস্থা পুনরাবৃত্তি করিয়া এবং সাম্প্রদায়িক ঐক্যের ভিত্তিস্বরূপ মুসলিম দাবি-দাওয়া সম্বন্ধে এবং ‘অলহোয়াইট কমিশন’ সম্পর্কে জিন্না সাহেবকে সর্বময় ক্ষমতা দিয়া প্রস্তাব পাস করতঃ সভার কাজ সমাপ্ত হয়।
তিনদিন সম্মিলনীর কাজ করিবার জন্য এবং জিন্না-বিরোধীদের একহাত দেখাইবার জন্য আমরা যারা প্রস্তুত হইয়া আসিয়াছিলাম, একদিনে সভার কাজ শেষ হওয়ায় তারা বেকার হইলাম। আর কি করা যায়? জনাব মুজিবুর রহমানের খরচে ও নেতৃত্বে দিল্লী-আগ্রার দর্শনীয় জায়গা ও বস্তুসমূহ দেখিয়া জীবনের সাধ মিটাইলাম। অতঃপর আগ্রার বিশ্ববিখ্যাত সূরাহি প্রত্যেকে আধ ডজন করিয়া কিনিয়া কলিকাতা ফিরিলাম। পথে আসিতে আসিতে সূরাহির সংখ্যা অর্ধেক হইয়া গেল। তাতেও দামের দিক দিয়া আমাদের যথেষ্ট মুনাফা থাকিল।
২. কংগ্রেসের ব্যর্থতা
পরের বছর (১৯২৮) ডিসেম্বর মাসে কলিকাতায় কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের বার্ষিক অধিবেশন। ১৯২৭ সালের কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট ডাঃ আনসারীর উদ্যোগে স্বায়ত্ত শাসিত ভারতের শাসনতান্ত্রিক বিধানের সুপারিশ করার উদ্দেশ্যে পণ্ডিত মতিলালের নেতৃত্বে নেহরু কমিটি গঠিত হইয়াছিল। এই কমিটি যে রিপোর্ট দিয়াছিল তাতে হিন্দু-মুসলিম সমস্যার সমাধানের জন্য নয়া ফরমুলা দেওয়া হইয়াছিল। এ রিপোর্টের রচয়িতা পণ্ডিত মতিলাল নেহরু স্বয়ং কলিকাতা কংগ্রেসের প্রেসিডেন্ট। পক্ষান্তরে জিন্না সাহেবের পরম ভক্ত উদর মতাবলম্বী মাহমুদাবাদের রাজা সাহেব (বর্তমান রাজা সাহেবের পিতা) মুসলিম লীগ সেশনের সভাপতি। কাজেই সকলেই আশা করিতেছিল এবার কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের সমঝোতায় হিন্দু-মুসলিম-সমস্যার সমাধান হইয়া যাইবে। সাইমন কমিশনের গঠন সম্পর্কে বৃটিশ সরকারের অনমনীয় মনোভাবও উভয় প্রতিষ্ঠানের সমঝোতার রাস্তা পরিষ্কার করিয়া দিয়াছিল।
বাংলায় এই দুই প্রতিষ্ঠানের অধিবেশন হইতেছে। সুতরাং বাংলার হিন্দু-মুসলিম নেতৃবৃন্দের এদিককার দায়িত্বই সবচেয়ে বেশি। অতএব কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের অধিবেশনের তারিখের বেশ কিছুদিন আগে ‘দি মুসলমান’ অফিসে বাংলার হিন্দু মুসলিম নেতৃবৃন্দের এক আলোচনা সভা হয়। হিন্দু পক্ষ হইতে মিঃ জে, এম, সেনগুপ্ত, মিঃ শরৎচন্দ্র বসু, ডাঃ বিধান চন্দ্র রায়, মিঃ জে, এম, দাশগুপ্ত, মিঃ জে, সি, গুপ্ত, ডাঃ ললিত চন্দ্র দাস, মিঃ নলিনী রঞ্জন সরকার ও আরও দু-একজন উপস্থিত হন। মুসলিম পক্ষে সার আবদুর রহিম, মৌঃ ফযলুল হক, মওলানা আযাদ, মৌঃ আবদুল করিম, মৌঃ আবুল কাসেম, মৌলবী মুজিবুর রহমান, মওলানা আকরম খাঁ, মওলানা ইসলামাবাদী এবং আরও কয়েকজন এই আলোচনায় শরিক হন। নেতাদের ফুট-ফরমায়েশ করিবার জন্য মৌঃ মুজিবুর রহমানের কথামত আমিও এই সভায় উপস্থিত থাকিবার অনুমতি পাই। দেশবন্ধুর বেংগল প্যাক্ট তখনও : কাগমে-কলমে বাঁচিয়া আছে। কাজেই আলোচনা প্রধানতঃ এই প্যাকটের উপরেই চলিল। হিন্দু-মুসলিম-বিরোধ মীমাংসার সব আলোচনার ভাগ্যে যা হইয়াছে, এই আলোচনা বৈঠকের বরাতেরও অবিকল তাই হইল। কিন্তু এ বৈঠকে আমি স্যার আবদুর রহিমের মুখে যে মূল্যবান একটি কথা শুনিয়াছিলাম প্রধানতঃ সেইটি লিপিবদ্ধ করিবার জন্যই এই ঘটনার অবতারণা করিয়াছি। মুসলমানদের দাবি-দাওয়া সম্পর্কে নেতাদের বিভিন্ন যুক্তির উত্তরে ডাঃ বিধান রায় তাঁর স্বাভাবিক কাট-খোট্টা ভাষায় বলিলেন : তা হলে মুসলমানদের কথা এই স্বাধীনতা সংগ্রামে যাব না, কিন্তু চাকরিতে অংশ দাও। পাল্টা জবাবে উস্তাদ সার আবদুর রহিম সংগে-সংগে উত্তর দিলেন? তা হলে হিন্দুদের কথা এই : চাকরিতে অংশ দিব না, কিন্তু স্বাধীনতা সগ্রামে আস। সবাই হাসিয়া উঠিলেন। অতঃপর সার আবদুর রহিম সিরিয়াস হইয়া বলিলেন : ‘লুক হিয়ার ডাঃ রায়। ইউ ফরগেট দ্যাট ইউ হিন্দুয় হ্যাভ গট অনলি ওয়ান এনিমি দি বৃটিশার্স টু ফাঁইট, হোয়ারআয় উই মুসলিমস হ্যাভ গট টু ফাঁইট থ্রি এনিমিয় : দি বৃটিশার্স অনদি ফ্রন্ট, দি হিন্দু অনদি রাইট এন্ড দি মোল্লায অনদি লেফট।’ কথাটা আমি জীবনে ভুলিতে পারি নাই।