এখন যাহারা রাজনীতি করিতেছেন এবং ভবিষ্যতে যাহারা রাজনীতির মাধ্যমে দেশ ও জাতির কল্যাণ কামনায় নিজদিগকে উৎসর্গ করিবার লক্ষ্যে বিভিন্ন ক্ষেত্রে নিয়োজিত রহিয়াছেন তাহাদের সকলের জন্য আবুল মনসুর আহমদ-এর ‘আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর’ বইখানি দিগ-দর্শন হিসাবে কাজ করিবে বলিয়া আমার বিশ্বাস।
আবুল মনসুর আহমদ-এর ‘আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর উদীয়মান প্রজন্মের সামনে একটি জীবন্ত ইতিহাস। মূলত ইহা শুধু একখানি গ্রন্থ নয়–ইহা একটি জাতির জীবন্ত ইতিহাস বা রাজনৈতিক দলিল (পলিটিক্যাল ডকুমেন্ট)। এই ডকুমেন্ট দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক এবং মাস্টার্স শ্রেণীতে অবশ্য পাঠ্য থাকা উচিত ছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্য জাতির, যাঁহারা কর্ণধার তাঁহারা এ বিষয়ে কোন উদ্যোগ আজ পর্যন্ত গ্রহণ করেন নাই।
সাধারণভাবে প্রকাশক হিসাবে নয়– দেশের একজন সচেতন নাগরিক হিসাবে মরহুম আবুল মনসুর আহমদ-এর ‘আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর’ অর্থাৎ এই মূল্যবান পলিটিক্যাল ডকুমেন্ট আহরণের জন্য আমি আজ দেশের ছাত্র, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী এবং বর্তমান ও ভবিষ্যতের রাজনীতিবিদগণের নিকট জানাইতেছি বিনীত আর।
— মহীউদ্দীন আহমদ
ঢাকা, ১ ফেব্রুয়ারি, ১৯৯৫
.
পঞ্চম সংস্করণের ভূমিকা
ছাত্রাবস্থা হইতেই সৈয়দ আহমদ ব্রেলভী এবং স্যার সৈয়দ আহমদ-এর একজন অনুসারী হিসাবে একটি বিশেষ রাজনৈতিক চিন্তা এবং আদর্শে বিশ্বাসী হইয়া আমার জীবন গড়িয়া উঠিয়াছে।
মরহুম আবুল মনসুর আহমদ-এর ‘আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর’ বইখানিতে আমার আজীবনের লালিত স্বপ্ন এবং সেই চিন্তা ও আদর্শের প্রতিচ্ছবি রহিয়াছে।
এই ঐতিহাসিক বইখানি ছাপাইবার জন্য অনেক প্রকাশক লালায়িত আছেন। আমি জানি তাহাদের সেই লালসা শুধু আর্থিক কারণে রাজনৈতিক বা জাতীয় কোন উদ্দেশ্য সাধনের লক্ষ্যে নহে। কিন্তু এই বইখানি ছাপাইবার পিছনে আমার লালসা–আদর্শের, অর্থের নহে।
বইখানির লেখক মরহুম আবুল মনসুর আহমদ আমার মনের গভীরের সেই চিন্তা ও আদর্শের সন্ধান পাইয়াছিলেন এবং সেই কারণেই জীবদ্দশায় তিনি কখনই তাহার এই অমূল্য বইখানি প্রকাশনার সুযোগ হইতে আমাকে বঞ্চিত করেন নাই।
তাহার ইনতেকালের পর সময়ের বিবর্তনে সাময়িক পরিবর্তন হইলেও তাহার সুযোগ্য পুত্র এককালের সংগ্রামী ছাত্রনেতা, প্রখ্যাত লেখক ও সাংবাদিক, দৈনিক বাংলাদেশ টাইমস পত্রিকার প্রাক্তন সম্পাদক এবং দেশের সর্বাধিক প্রচারিত বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকার কলামিস্ট ভ্রাতৃপ্রতিম জনাব মহবুব আনাম তাহার সুযোগ্য পিতার মনের খবর জানিতেন বলিয়াই এই ঐতিহাসিক গ্রন্থ ‘আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর’ প্রকাশনার দায়িত্ব এখনও পর্যন্ত আমার উপরেই রাখিয়াছেন।
জনাব মহবুব আনাম ইচ্ছা করিলে বইখানি প্রকাশনার দায়িত্ব অন্যকে দিয়া প্রচুর অর্থ পাইতে পারেন কিন্তু তিনি তাহা করেন নাই– তাহার এই উদারতা ও মহানুভবতার জন্য আমি চিরকৃতজ্ঞ।
– প্রকাশক
১৫ ফেব্রুয়ারি, ১৯৯৯
০১. রাজনীতির ক খ
রাজনীতির ক খ
পয়লা অধ্যায়
১. পরিবেশ
পথ চলিতে-চলিতে গলা ফাটাইয়া গান গাওয়া পাড়া-গাঁয়ে বহুৎ পুরান রেওয়াজ। খেতে-খামারে মাঠে-ময়দানে ভাটিয়ালি গাওয়ারই এটা বোধ হয় অনুকরণ। আমাদের ছেলেবেলায়ও এটা চালু ছিল। আমরা মকতব-পাঠশালার পড়ুয়ারাও গলা ফাটাইতাম পথে-ঘাটে। তবে আমরা নাজায়েয গান গাইয়া গলা ফাটাইতাম না। গানের বদলে আমরা গলা সাফ করিতাম ফারসী গযল গাইয়া, বয়েত যিকির করিয়া এবং পাঠ্য-পুস্তকের কবিতা ও পুঁথির পয়ার আবির্তি (আবৃত্তি) করিয়া। এ সবের মধ্যে যে পয়ারটি আমার কচি বুকে বিজলি ছুটাইত এবং আজো এই বুড়া হাড়ে যার রেশ বাজে তা এই :
আল্লা যদি করে ভাই লাহোরে যাইব
হুথায় শিখের সাথে জেহাদ করিব।
জিতিলে হইব গাযী মরিলে শহিদ
জানের বদলে যিন্দা রহিবে তৌহিদ।
একটি চটি পুঁথির পয়ার এটি। তখনও বাংলা পুঁথিতে নযর চলে নাই। ‘মহাভা-মহাভা-রতে-রক’র মত বানান করিয়া পড়িতে পার মাত্র। কারণ তখন আমি আরবী-ফারসী পড়ার মাদ্রাসা নামক মকতবের তালবিলিম। চাচাজী মুনশী ছমিরদ্দিন ফরাসী ছিলেন আমাদের উস্তাদ। শুধু পড়ার উস্তাদই ছিলেন না। খোশ এলহানে কেরাত পড়া ও সুর করিয়া পুঁথি পড়ারও উস্তাদ ছিলেন তিনি। চাচাজী এবং হুসেন আলী ফরাযী ও উসমান আলী ফকির নামে আমার দুই মামুও পুঁথি পড়ায় খুব মশহুর ছিলেন। মিঠা দরা গলায় তারা যে সব পুঁথি পড়িতেন তার অনেক মিছরাই আমার ছিল একদম মুখস্থ। উপরের পয়ারটি তারই একটি। কেচ্ছা-কাহিনীর শাহনামা। আলেফ-লায়লা, কাছাছুল আম্বিয়া, শহিদে কারবালা, মসলা মসায়েলের ফেকায়ে-মোহাম্মদী ও নিয়ামতে-দুনিয়া ও আখেরাত ইত্যাদি পুঁথি কেতাবের মধ্যে দু’চার খানা ছোট-ছোট জেহাদী রেসালাও ছিল আমাদের বাড়িতে। পশ্চিম হইতে জেহাদী মৌলবীরা বছরে দুই-তিনবার আসিতেন। আমাদের এলাকায়। থাকিতেন প্রধানতঃ আমাদের বাড়িতে। তারাই বস্তানিতে লুকাইয়া আনিতেন এ সব পুস্তক। আমাদের বাড়িতে থাকিয়া এরা মগরেবের পর ওয়াজ করিতেন। চাঁদা উঠাইতেন। লেখাপড়া-জানা লোকের কাছে এই সব কিতাব বিক্রয় করিতেন নাম মাত্র মূল্যে।