শুধু আমার কথাতেই সিরাজী সাহেব মত পরিবর্তন করিয়াছেন এমন দাবি আমি করি না। কারণ ইতিমধ্যে বহু বড় বড় কংগ্রেস নেতা সিরাজী সাহেবের সহিত দেখা করেন। অভ্যর্থনা কমিটির চেয়ারম্যান পাবনার জমিদার বিখ্যাত ব্যারিস্টার ও সাহিত্যিক প্রমথ চৌধুরী ও করটিয়ার জমিদার জনাব ওয়াজেদ আলী খানপন্নী (চান মিয়া সাহেব) সিরাজী সাহেবের সহিত যোগাযোগ করিয়াছিলেন।
একদিন আগে হইতে দলে দলে ডেলিগেটরা আসিতে শুরু করিলেন। চান মিয়া সাহেব একদিন আগে হইতেই সিরাজগঞ্জে আসিয়া অভ্যর্থনা কমিটির আয়োজনের তদারক শুরু করিলেন। সিরাজী সাহেব নিরপেক্ষ হইয়া যাওয়ায় সম্মিলন-বিরোধী চক্রান্ত হাওয়ায় মিলাইয়া গেল।
নির্দিষ্ট দিনে বিপুল-উৎসাহ উদ্যমের মধ্যে বিরাট সাফল্যের সংগে সম্মিলনের অধিবেশন হইল। ডেলিগেটের সংখ্যাই ছিল পনর হাজারের মত। দর্শকের সংখ্যা ছিল তার অনেক গুণ। এত বড় জন-সমাবেশে অভ্যর্থনা সমিতির চেয়ারম্যানের ভাষণ, দেশবন্ধুর প্রাণস্পর্শী বক্তৃতা, মওলানা আকরম খাঁ সাহেবের সুলিখিত পাণ্ডিত্যপূর্ণ অভিভাষণ ও অন্যান্য বক্তাদের বক্তৃতায় হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের বাণী এমন সজীবতা লাভ করিয়াছিল যে প্রায় সর্বসম্মতিক্রমে দেশবন্ধুর বেংগল প্যাক্ট গৃহীত হইয়া গেল।
দেশবন্ধুর অত সাধের বেংগল প্যাক্ট আজ ভাংগিয়া গিয়াছে। হিন্দু ও মুসলমান দুই জাতি হইয়াছে। দেশ আজ ভাগ হইয়াছে। দুই স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে। দেশবন্ধুর প্রাণপ্রিয় পরাধীন দেশবাসী আজ স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বাধীন নাগরিক হইয়াছে। সিরাজগঞ্জের বগল বাহিয়া যমুনা নদীর অনেক পানি গড়াইয়া গিয়াছে। কিন্তু দেশবন্ধুর সেদিনকার মর্মস্পর্শী উদাত্ত আবাহন আমার কানে, এবং বোধ হয় আমার মত অনেক বাংগালীর কানে, আজো রনিয়া-রবিয়া ধ্বনিয়া উঠিতেছে : “হিন্দুরা যদি উদারতার দ্বারা মুসলমানের মনে আস্থা সৃষ্টি করিতে না পারে, তবে হিন্দু-মুসলিম ঐক্য আসিবে না। হিন্দু-মুসলিম-ঐক্য ব্যতীত আমাদের স্বরাজের দাবি চিরকাল কল্পনার বস্তুই থাকিয়া যাইবে।” দেশবন্ধুর কল্পিত হিন্দু-মুসলিম-ঐক্যের বাস্তব রূপ সম্পর্কে তিনি তাঁর সিরাজগঞ্জ-বক্তৃতায় বলিয়াছিলেন : ‘হিন্দু ও মুসলমান তাদের সাম্প্রদায়িক স্বতন্ত্র সত্তা বিলোপ করিয়া একই সম্প্রদায়ে পরিণত হউক, আমার হিন্দু-মুসলিম-ঐক্যের রূপ তা নয়। ওরূপ সত্তা বিসর্জন করনাতীত।” এই বাস্তব বুদ্ধির অভাবেই আজ দেশ ভাগ হইয়াছে। ইহারই অভাবে দেশভাগ হইয়াও শান্তি আসে নাই।
০৪. প্রজা-সমিতি প্রতিষ্ঠা
প্রজা-সমিতি প্রতিষ্ঠা
চৌথা অধ্যায়
১. সাম্প্রদায়িক তিক্ততা বৃদ্ধি
১৯২৫ সালের ১৬ই জুন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ নিতান্ত আককিভাবে পরলোক গমন করেন। বাংলার কপালে দুর্ভাগ্যের দিন শুরু হয়। ঐ সালের শেষ দিকে মুসলিম লীগের আলীগড় বৈঠকের সভাপতিরূপে সার আবদুর রহিম হিন্দুদের সাম্প্রদায়িক মনোভাবের নিন্দা করিয়া ভাষণ দেন। তাতে হিন্দু নেতাদের অনেকে এবং হিন্দু সংবাদ-পত্ৰসমূহ সাধারণভাবে সার আবদুর রহিমের উপর খুব চটিয়া যান। হিন্দুদের এই আবদুর রহিম-বিদ্বেষ এতদূর তীব্র হইয়া উঠে যে ১৯২৬ সালের গোড়ার দিকে লাট সাহেব যখন সার আবদুর রহিমকে মন্ত্রী নিয়োগ করেন, তখন কোন হিন্দু নেতাই সার আবদুর রহিমের সহিত মন্ত্রিত্ব করিতে রাজী হন না। ফলে সার আবদুর রহিম পদত্যাগ করিতে বাধ্য হন। সার আবদুর রহিমের স্থলে সার আবদুল করিম গয়নবীর সাথে মন্ত্রিত্ব করিতে হিন্দু-নেতারা রাজী হন। তাতে সার আবদুল করিম গয়নবী ও ব্যারিস্টার ব্যোমকেশ চক্রবর্তী মন্ত্রী নিযুক্ত হন। এই ঘটনায় সাম্প্রদায়িক তিক্ততা বাড়িয়া যায়। মুসলমানরা এই মন্ত্রিদ্বয়কে ‘গজচক্র’ মন্ত্রিত্ব বলিয়া অভিহিত করে। আমি এই সময় জনাব মৌলবী মুজিবুর রহমান সাহেবের সম্পাদিত ‘দি মুসলমানের’ সহকারী সম্পাদকতার কাজ করি। আমাদের কাগ-সহ সব কয়টি মুসলমান সাপ্তাহিক (মুসলমান-পরিচালিত কোনও দৈনিক তখন ছিল না) এক-যোগে ‘গজচক্র’-মন্ত্রিত্বের বিরুদ্ধে কলম চালাই। মুসলমান ছাত্ররা আন্দোলনে অংশ গ্রহণ করে। অল্প দিনেই গজচক্র মন্ত্রিদ্বয় পদত্যাগ করিতে বাধ্য হন। সার আবদুল করিম গযনবী মন্ত্রিত্ব হারাইয়া মসজিদের সামনে বাজনার বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেন। এই সময় রাজরাজেশ্বরী মিছিলের বাজনা লইয়া কলিকাতায় তৎকালের বৃহত্তম সাম্প্রদায়িক দাংগা হয়। উভয় পক্ষে এগার শত লোক হতাহত হয়। মসজিদের সামনে বাজনার দাবিতে বরিশালের জনপ্রিয় হিন্দু নেতা শ্রীযুক্ত সতীন সেন প্রসেশন করিতে যান। কুলকাঠি থানার পোনাবালিয়া গ্রামে পুলিশ-মুসলমানে সংঘর্ষ হয়। জিলা ম্যাজিস্ট্রেট ব্ল্যাণ্ডির নির্দেশে মুসলমানের উপর গুলি করা হয়। অনেক লোক হতাহত হয়। এতে হিন্দু-মুসলিম সম্পর্কের দ্রুত অবনতি ঘটে।
এই তিক্ত আবহাওয়ায় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষার জন্য চেষ্টা করিতেছিল একমাত্র জিন্না-নেতৃত্বের মুসলিম লীগই। এটা কংগ্রেসের অন্যতম প্রধান কাজ হওয়া সত্ত্বেও এ ব্যাপারে কার্যতঃ কংগ্রেস সম্পূর্ণ নিরুপায় হইয়া পড়িয়াছিল। মুসলিম সমাজে কংগ্রেসের প্রভাব কমিয়া গিয়াছিল অথচ শুধু হিন্দুদের পক্ষে কথা বলায়ও তাঁদের আপত্তি ছিল। ফলে তাঁদের হিন্দু-মুসলিম-ঐক্যর কথা কার্যতঃ অর্থহীন দার্শনিক আপ্তবাক্যে পর্যবসিত হইয়াছিল। সে অবস্থায় জিন্না-নেতৃত্বে মুসলিম লীগই হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের প্রশ্নে বাস্তববাদী ছিল। রাজনৈতিক দাবি-দাওয়ায় বৃটিশ সরকারের মোকাবেলায়ও মুসলিম লীগই ছিল কংগ্রেসের নিকটতম সহপথিক। ভারতবাসীর স্বায়ত্তশাসন-দাবির কার্যকারিতা পরখের জন্য ‘অল্ হোয়াইট’ সাইমন কমিশন পাঠাইবার কথাও বিলাতি পার্লামেন্টে এই সময় উঠিয়াছিল। সাম্প্রদায়িক তিক্ততার সুযোগে ইংরাজের খায়েরবাহ নাইট-নবাবরা জিন্না সাহেবকে মুসলিম লীগ নেতৃত্ব হইতে অপসারণ করার জন্য কোমর বাঁধিয়া লাগিয়া যান। পাঞ্জাবের সার মিয়া মোহাম্মদ শফী এই জিন্না-বিরোধী ষড়যন্ত্রের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। বাংলার সার আবদুর রহিম বাদে আর সব নাইট-নবাবরা তাতে যোগ দেন। এই পরিবেশে ১৯২৭ সালে কলিকাতা টাউন হলে নিখিল ভারত মুসলিম লীগের বার্ষিক অধিবেশন হয়। বরাবর কংগ্রেস ও লীগের বৈঠক একই সময়ে একই শহরে প্রায় একই প্যান্ডেলের নিচে হইত। ১৯১৬ সালের লাখনৌ প্যাকটের সময় হইতেই এই নিয়ম চলিয়া আসিতেছিল। তবু সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতি ও নাইট-নবাবদের ষড়যন্ত্রের মোকাবেলায় সাবধানতা হিসাবেই ১৯২৭ সালের মুসলিম লীগের বৈঠক ঐ সালের কংগ্রেস বৈঠকের সাথে মাদ্রাজে না করিয়া কলিকাতায় করা হয়। জিন্না সাহেবের অন্তরংগ বন্ধু ডাঃ আনসারী মাদ্রাজ কংগ্রেসের সভাপতি। তবু মিঃ জিন্ন মুসলিম লীগকে কংগ্রেসের সংস্পর্শ হইতে দূরে রাখিলেন। জিন্না-বিরোধী নাইট-নবাবরা লাহোরে এক প্রতিদ্বন্দ্বী মুসলিম লীগ সম্মিলনীর আয়োজন করিলেন। সার মোহাম্মদ শফী তাতে সভাপতিত্ব করিলেন। বাংলার দু-চার জন নবাব-নাইট জনমত অগ্রাহ্য করিয়া একরূপ গোপনে লাহোর সম্মিলনীতে অংশ গ্রহণ করিলেন।