দ্বিতীয় কারণ অবশ্য এর চেয়ে কাটখোট্টা বাস্তব কারণ। মাসে মাসে যে চল্লিশটি টাকা পাই শিক্ষকতা ছাড়িয়া দিলে তা-ইবা পাইব কোথায়? খিলাফত ফন্ডে যে সামান্য পয়সা ছিল, সেক্রেটারি হিসাবে আমি অবশ্যই কোষাধ্যক্ষের নিকট হইতে তা চাহিয়া নিতে পারিতাম। কিন্তু নিজের খাওয়ার জন্য কোষাধ্যক্ষের কাছে টাকা চাওয়া আমি লজ্জার বিষয় মনে করিতাম। কাজেই স্কুলের মাস্টারি ছাড়িলে আমাকে খালি পকেটে এবং শেষ পর্যন্ত খালি পেটে থাকিতে হইবে। এটা আমার কাছে স্পষ্ট হইয়া উঠিল। এইভাবে এতদিনে বুজিলাম, দেশের স্বাধীনতাই বল, আর ধর্মের খিলাফতই বল, পেটে আগে কিছু না দিয়া দুইটার কোনওটাই উদ্ধার করা চলে না।
কলেজ ছাড়িবার সময় ল্যাংলি সাহেব ও বাপ-মা মুরুব্বিরাও এই কথাই বলিয়াছিলেন। তখন জবাব দিয়াছিলামঃ টাকা-পয়সা ও ভোগবিলাসিতা ত তুচ্ছ কথা, দেশ ও ধর্মের জন্য প্রাণ পর্যন্ত ত্যাগ করিতে পারি। এখন বুঝিতেছি, দরকার হইলে প্রাণ হয়ত সত্য-সত্যই দিতে পারি। কিন্তু তার দরকার ত মোটেই হইতেছে না। কেউত আমার প্রাণ চাইতেছে না। প্রাণ দিবার কোনও রাস্তাই তা নিজের চোখেও দেখিতেছি না। মাস্টারি ছাড়া কাজের মধ্যে ত আড্ডা মারা। উকিলরা সব কোর্টে ফিরিয়া যাওয়াতে তাঁদের বাসায়ও আগের মত আড্ডা দেওয়া চলে না। মক্কেলের ভিড়। একমাত্র চাঞ্চল্যকর কাজ কংগ্রেস-খিলাফতের সভা উপলক্ষে কলিকাতা গয়া। দিল্লী বোম্বাই যাওয়া। সেটাও আমার ভাগ্যে জুটে না। কলিকাতার পশ্চিমে আর আমার যাওয়াই হয় না। কারণ ঐ সব সভায় যাওয়ার ভাড়া ও খরচ-পত্র বহন করার মত টাকা কংগ্রেস-খিলাফত ফণ্ডে নাই। কাজেই অন্য সব কর্মী বন্ধুরা, বন্ধু-বান্ধব ও আত্মীয়-স্বজনের নিকট হইতে টাকা যোগাড় করিয়া লয়। কিন্তু আমার তেমন কোনও বন্ধু-বান্ধব ও আত্মীয়-স্বজন না থাকায় আমি কলিকাতা যাওয়ার আনন্দ হইতেও প্রায়শঃ বঞ্চিত থাকিতাম।
কাজেই সকল দিক বিবেচনা করিয়া আমি যে বাস্তব অবস্থার সম্মুখীন হইলাম, তার সোজা অর্থ এই যে, আমি খিলাফত ও স্বরাজের দোহাই দিয়া কলেজ ছাড়িয়া আসিয়া চল্লিশ টাকা বেতনের চাকরি করিতেছি। কলেজ ত্যাগের এই কি পরিণাম? এই কাজে কি স্বরাজ খিলাফত উদ্ধার হইবে? বাপ-মা মুরুব্বিদের এমন কি নিজেরে ফাঁকি দেই নাই কি? অতিশয় অস্থির-চঞ্চল হইয়া উঠিলাম। অনেক বিনিদ্র রজনী কাটাইলাম।
০৩. বেংগল প্যাক্ট
বেংগল প্যাক্ট
তেসরা অধ্যায়
১. খিলাফত্রে অবসান
১৯২২ সালের মাঝামাঝি প্রাদেশিক খিলাফত কমিটির ওয়ার্কিং কমিটির এক বৈঠক উপলক্ষে কলিকাতা গেলাম তদানিন্তন প্রাদেশিক সেক্রেটারি সৈয়দ মাজেদ বখশ সাহেবের বিশেষ অনুরোধে, কলিকাতায়ও আমার এই প্রথম পদার্পণ। খিলাফত কমিটির মিটিংএও আমার এই প্রথম উপস্থিতি। আমি অনেক আগে হইতেই প্রাদেশিক ওয়ার্কিং কমিটির মেম্বার থাকা সত্ত্বেও এর আগে কখনও তার মিটিং-এ যোগ দেই নাই। অল-ইন্ডিয়া-খিলাফত নেতা মওলানা শওকত আলী সাহেব ওয়ার্কিং কমিটির সমস্ত সদস্যের সাথে বিশেষতঃ জিলা-নেতৃবৃন্দের সাথে খিলাফতের বিশেষ পরিস্থিতি আলোচনা করিতে চান। সেক্রেটারি মাজেদ বখশ সাহেবের এই মর্মের পত্র পাইয়াই আমি এই সভায় অংশ গ্রহণ করিতে আসি। কলিকাতা খিলাফত কমিটির আর্থিক অবস্থা তখনও স্বচ্ছল। মফস্বলের নেতাদের হোটেলে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা তখনও করা হয়। সেক্রেটারি সৈয়দ মাজেদ বখশ সাহেব আমারও বন্দোবস্ত করিলেন। কিন্তু আমি হোটেলের বদলে শামসুদ্দিনের সাথে থাকাই মনস্থ করিলাম। তাই ১নং আন্তণী বাগানস্থ ‘মোসলেম জগত’ আফিসে উঠিলাম। খিলাফত কমিটির সভায় যোগ দেওয়া ছাড়াও আমার অন্য উদ্দেশ্য ছিল। খিলাফত উদ্ধারের বদলে নিজেকে উদ্ধার করা আমার আশু প্রয়োজন হইয়া পড়িয়াছিল। শামসুদ্দিনের মধ্যস্থতায় কোনও খবরের কাগজে একটা চাকরি যোগাড়ের সম্ভাবনা বিচারও আমার সে যাত্রায় উদ্দেশ্য ছিল। খিলাফত কমিটির কাজ সারিতে আমার দুইদিন লাগিল। মওলানা শওকত আলী সাহেবকে এতদিন শুধু দূর হইতে দেখিয়াছি, সভা-সমিতিতে বক্তৃতা শুনিয়াছি। এবারই প্রথম সামনা-সামনি কথা বলিবার গৌরব অর্জন করিলাম। মওলানা সাহেবের আশাবাদ দেখিলাম। বিস্মিত হইলাম। তখন মোস্তফা কামালের নেতৃত্বে নয়াতুকী বাহিনী গ্রীক বাহিনীর কবল হইতে স্মর্না উদ্ধার করিয়াছে; গ্রীক বাহিনীকে তাড়া করিয়া নিতেছে। এই ঘটনায় সব মুসলমানেরই আনন্দ করিবার কথা। আমরাও করিয়াছি। কিন্তু মোস্তফা কামালের নেতৃত্বে তুর্কীরা রাজনৈতিক সেকিউলারিষম গ্রহণ করিতেছে; পোশাক-পাতিতে ইউরোপীয় সাজিবার চেষ্টা করিতেছে এবং খিলাফত প্রতিষ্ঠান উঠাইয়া দিতে পারে বলিয়া গুজব রটিতেছে। স্বয়ং তুর্কীরা খিলাফত উঠাইয়া দিলে আমরা ভারতীয়রা কিরূপে আন্দোলন চালাইব, প্রধানতঃ এই কথাটার আলোচনার জন্যই মওলানা সাহেব কলিকাতা আসিয়াছেন। তাঁর মতে কামাল খিলাফত উচ্ছেদ করিতে পারেন না। আইনতঃ সে অধিকারও তাঁর নাই। খিলাফত কোন দেশ-রাষ্ট্রের অনুষ্ঠান নয়; এটা বিশ্ব-মুসলিমের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান। অতএব কামাল পাশা ওটা উঠাইয়া দিলেও আমরা তা মানিব না। মওলানা সাহেবের এই বিস্ময়কর আশাবাদে পুরাপুরি শরিক হইতে না পারিলেও আমরা খিলাফত-কর্মীরা নৈরাশ্যের মধ্যে আলোর ছটা দেখিতে পাইলাম। পরম উৎসাহের মধ্যেই খিলাফত কমিটির কাজ শেষ হইল।