এঁদের সাহচর্যে ময়মনসিংহ শহরের প্রায় বছর খানেক বড়ই আনন্দে কাটিয়াছে, সুরেন বাবু, মওলানা আযিযুর রহমান (ইনি নোয়াখালির লোক ছিলেন), মৌলবী আবদুল হামিদ দেওপুরী, অধ্যাপক মোয়াযম হোসেন, মৌঃ সাইদুর রহমান প্রভৃতি হিন্দু-মুসলমান কংগ্রেস খেলাফত নেতারা বিকালে দল বাঁধিয়া রাস্তায় বাহির হইতাম। পথচারীরা সম্ভ্রমে আমাদের পথ ছাড়িয়া দিত এবং সালাম-আদাব দিত। এমন পথ ভ্রমণে আমিই ছিলাম অন্যতম প্রধান বক্তা অবশ্য রাস্তাঘাটে। পথ চলিতে চলিতে আমার মত বকিতে কেউ পারিতেন না। আমি কোনও কোনও সময় অতি উৎসাহে বন্ধুদের সামনে করিয়া পিছন দিকে চলিতে-চলিতে বক্তৃতা করিতাম। এমন করিতে গিয়া একদিন একজন পথচারিনী মহিলার পায়ে পাড়া মারিয়া ঝটপট ঘুরিয়া হিন্দু ভংগিতে দুই হাত জোড় করিয়া মহিলাকে নমস্কার করিলাম। রাস্তায় যখন বেড়াইতে বাহির হইয়াছেন তখন নিশ্চয়ই তিনি মুসলমান নন। আমাকে এভাবে নমস্কার করিতে দেখিয়ে মহিলা হতভম্ব হইয়া গেলেন। বন্ধুরা সকলে হো হো করিয়া হাসিয়া উঠিল। কেউ কেউ বলিলেন : ‘ওটা যে বেশ্যা। একটা বেশ্যাকে তুমি সেলাম করিলে?’ আমার মুখ হইতে চট করিয়া বাহির হইল : ‘যারা বেশ্যাগামী তাদের কাছেই ইনি বেশ্যা, আমার কাছে তিনি ভদ্রমহিলা মাত্র।’ সকলে নীরব হইলেন। মেয়েটি সজল নয়নে আমার দিকে চাহিয়া রহিল।
কিন্তু বেশিদিন এভাবে চলিল না। সক্রিয় আন্দোলনের অভাবে চিন্তার প্রচুর সুযোগও পাইলাম। অবস্থাগতিকে চিন্তায় বাধ্যও হইলাম। অল্পদিনের মধ্যেই বুঝিলাম, দেশের স্বাধীনতা ও খিলাফতের জন্য সর্বস্ব ও প্রাণ বিসর্জন দিবার যে দুর্বার তাকিদে কলেজ ত্যাগ করিয়াছিলাম, সে সব ত্যাগের আজ কোন দরকার নাই। কারণ স্বাধীনতা ও খেলাফত কোনটাই উদ্ধারের কোনও সম্ভাবনা এখন নাই। মহাত্মাজী স্বরাজের মেয়াদ অনির্দিষ্টকালের জন্য পিছাইয়া দিয়াছেন। মোস্তফা কামাল খেলাফত ভাংগিয়া দিয়া মহামান্য সুলতানকে দেশ হইতে তাড়াইয়া দিয়াছেন। কাজেই আমার আপাততঃ জাতীয় বিদ্যালয়ের মাস্টারিই সার হইল। বেতন চল্লিশ টাকা এতদিন মোটেই অপ্রতুল মনে হয় নাই। কারণ তৎকালে খরচও কম ছিল। তখন এক পয়সায় এক কাপ চা, চার পয়সায় পঁচিশ টা মুখপোড়া বিড়ি ও পয়সায় দুইটা দিয়াশলাই পাওয়া যাইত। তাতে সারা দিনে চার আনার বেশি খরচ করিতে পারিতাম না। তৈয়বুদ্দিন সাহেবের বাসায় বিনা-ভাড়ায় থাকিতাম। তিন-চার বন্ধুতে একত্রে মেস করিয়া খাইতাম। পাঁচ টাকার বেশি খোরাকি লাগিত না। পোশাকে বাবুগিরি ছিল না। সস্তা মোটা খদ্দরের তহবন্দ ও পাঞ্জাবী পরিতাম। একটা ধুতিতেই একটা পাঞ্জাবী ও একটা তহবন্দ হইয়া যাইত। দুই টাকা চার আনা দিয়া বছরে দুই খানা ধুতি (প্রতিটি আঠার আনা) কিনিতাম তাতেই দুইখানা পাঞ্জাবী ও দুইখানা তহবন্দ হইয়া যাইত। দুইটা পাঞ্জাবী সিলাই করিতে দর্জি নিত বার আনা। তহবন্দ সিলাইর চার্জ ছিল দুইটা দুই আনা। পাঞ্জাবীর বাদবাকী টুকরা কাপড় হইতে সচ্ছন্দে দুইটা গান্ধী টুপি হইয়া যাইত। দুইটা টুপিতে ও দুইটা তহবন্দে কখনও চার আনা কখনও বা দুই আনা দর্জিকে দিয়াই মাফ লইতাম। সুতরাং দেখা গেল, মোট সোওয়া তিন টাকা খরচ করিয়া আমার দুইটা পাঞ্জাবী দুইটা তহবন্দ ও দুইটা টুপি হইয়া যাইত। খদ্দরটা মোটা বলিয়া মজবুতও হইত। ধুইতামও নিজেই। একনম্বর ঢাকাই বাংলা সাবান ছিল পাঁচ আনা সের। দশ পয়সায় আধা সেরের একটা দলা পাওয়া যাইত। প্রতি সপ্তাহে ঐ এক দলা সাবানে সব কাপড় ধোলাই হইয়া যাইত। কখনও কখনও এক পয়সার নীল কিনিয়া নীলের ছোপ দিতাম। কেউ ‘বাবু’ বলিলে তাও দিতাম না। তবু মোটামুটি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকিতাম।
সুতরাং টাকা-পয়সার অল্পতার কথা অনেকদিন মনে করি নাই। প্রথমে মনে পড়ে আদর্শহীনতার কথা। কিসের জন্য অত প্রশংসার ছাত্র-জীবন ত্যাগ করিলাম? নিশ্চয়ই চল্লিশ টাকার স্কুল মাস্টারি করিবার জন্য নয়। ন্যাশনাল স্কুলে মাস্টারি? তারই মানে কি? চরখায় সূতা কাটা ছাড়া ‘গোলামখানা’ হাই স্কুলের পঠিতব্য ও ন্যাশনাল হাই স্কুলের পঠিতব্যে পার্থক্য কি? সব বেসরকারী স্কুলের অধিকাংশ শিক্ষক এবং অনেক ছাত্র আমারই মত খদ্দর পরেন। তবে পার্থক্যটা কোথায়? বিশেষতঃ ন্যাশনাল স্কুলই হোক আর ‘গোলামখানা’ই হোক মাস্টারগণকে ত ঘড়ির কাঁটা ধরিয়াই স্কুলে আসতে হয়। বিকালে ক্লান্ত দেহে শুকনা মুখে ঘরে ফিরিতে হয়।
দেশোদ্ধারের চিত্ত-চাঞ্চল্যকর দেহমন-শিহরণকারী কাজ এতে কোথায়? মনটা ক্রমেই খারাপ হইতে লাগিল। স্কুলের কাজ ছাড়িয়া দিয়া অপেক্ষাকৃত রোমাঞ্চকর রোমান্টিক কিছু করিবার জন্য মন উতলা হইয়া গেল। কিন্তু দুইটি কারণে হঠাৎ কিছু করিতে পারিলাম না। তার একটি ছাত্রের মায়া, অপরটি টাকার মায়া ছাত্রের মায়া এইজন্য যে তাদেরে আমি ভালবাসিতাম। তারাও আমাকে ভালবাসিত। সহকর্মীরাও বলিতেন, আমি ছাত্রদের মধ্যে খুবই জনপ্রিয়। আমি তখন দাড়ি রাখিয়াছি। দাড়ি-লুংগি টুপিতে আমি দস্তুরমত একজন মুনশী সাহেব। এমন একজন মুসলমানের পক্ষে ঐ স্কুলে জনপ্রিয় শিক্ষক হওয়া আশ্চর্যের বিষয় ছিল। কারণ ছেলেদের বেশির ভাগই ছিল ব্রাহ্মণ-কায়স্থ-বৈদ্য সমাজের হিন্দু ছেলে। অধিকাংশই শহরের উকিল-মোক্তার ডাক্তার প্রভৃতি ভদ্রলোকের ছেলে। এরা আমাকে এত ভক্তিশ্রদ্ধা করিত যে এদের অনেকে রাস্তাঘাটে পর্যন্ত আমাকে পা ছুঁইয়া প্রণাম করিত। অথচ হিন্দু মাষ্টাররা এই সৌভাগ্য হইতে বঞ্চিত ছিলেন। এইসব ছেলের মধ্যে চার জনের কথা আমি জীবনে ভুলিতে পারি না। দুই জন ব্রাহ্মণ, একজন কায়স্থ ও একজন বৈদ্য। এঁরা সকলেই পরবর্তী জীবনে উচ্চ-উচ্চ দায়িত্বপূর্ণ পদের অধিকারী নেতৃস্থানীয় লোক হইয়াছেন। হিন্দু ছেলেদের মধ্যে মুসলমানদের মত গুরু-ভক্তি নাই বলিয়া স্বয়ং হিন্দু শিক্ষকদেরই একটা সাধারণ অভিযোগ আছে। আমার নিজের অভিজ্ঞতা এই অভিযোগ সমর্থন করে না। এই ধরনের ভক্তিমান ছেলেরা আমার হৃদয়-মন এমন জয়। করিয়াছিল যে এদের মনের দিকে চাহিয়া আমি কোনমতেই এই স্কুলের মায়া কাটাইতে পারিতাম না।