৮. উৎসাহে ভাটা
কিন্তু আমাদের উৎসাহ এক বছরের বেশি স্থায়ী হইল না। গান্ধীজীর দেওয়া প্রতিশ্রুতি-গত এক বছরে স্বরাজ আসিল না। চৌরিচূরার হাংগামার ফলে তিনি সার্বজনীন আইন অমান্য প্রত্যাহার করিলেন। কংগ্রেস নেতারা তদন্ত করিয়া রিপোর্ট দিলেন স্কুল-কলেজ ও অফিস-আদালত বয়কট ব্যর্থ হইয়াছে। এরপর ছাত্ররা জাতীয় বিদ্যালয় ছাড়িয়া দলে-দলে সরকারী ‘গোলাম-খানায়’ ঢুকিতে লাগিল। আমাদের জাতীয় বিদ্যালয়ের ও তাঁতের স্কুলের ছাত্র কমিয়া গেল। খদ্দরের কাপড় মোটা ও রং কাঁচা বলিয়া আমাদের তৈরি কাপড় বিক্রিতে মন্দা পড়িল। কারিগর শিক্ষক ও গরিব মাস্টারদের বেতন দেওয়া অসম্ভব হইয়া উঠিল। তাঁতের স্কুলের কারিগর শিক্ষকরা ছিলেন সবাই গরিব লোক। তাঁদের মাসে মাসে নিয়মিতভাবে বেতন না দিলে চলিত না। এদের বেতন বাকী পড়িতে লাগিল। তাঁতের তৈরি কাপড়গুলি নিয়মিত বিক্রি হইত না। বিক্রি হইলেও কম দাম হইত। তাতে বেতন বাকী পড়িত। বাজারের তোলা গ্রামের মুষ্টি চাউল সব ব্যাপারেই লোকের উৎসাহ কমিতে লাগিল। মাষ্টার, কারিগর ও কর্মীদের মধ্যে শৈথিল্য ও নিরুৎসাহ দেখা দিল।
আমাদের মন ও শরীরের উপর এর চাপ পড়িল। শামসুদ্দিন ছিলেন বরাবরের আমাশয় রোগী। এক বছরের কঠোর পরিশ্রম ও অনিয়মে তাঁর শরীর আরও খারাপ হইল। শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তন হিসাবেই তিনি ‘মোসলেম জগৎ’ নামক সাপ্তাহিক কাগজের দায়িত্ব লইয়া কলিকাতা চলিয়া গেলেন। আমি একা চরম নিরুৎসাহ ও অভাবের মধ্যে হাইস্কুল, তাঁতের স্কুল, চরখা স্কুল, পল্লীসমিতি ও শালিসী পঞ্চায়েতের কাজ চালাইতে লাগিলাম। এই দুর্দিনে ‘বড় চাচা’ যহিরুদ্দিন সাহেবের পৃষ্ঠপোষকতা ও উৎসাহ এবং ডাঃ দীনেশ চন্দ্র সরকার ও ডাঃ আক্কাস আলী প্রভৃতি উৎসাহী কর্মীদের কর্মোন্মাদনার উত্তাপই আমার কর্মপ্রেরণার সলিতা কোনও মতে জ্বালাইয়া রাখিল।
কিন্তু বেশিদিন এভাবে চলিল না। শেষ পর্যন্ত আমিও রণে ভংগ দিলাম। আস্তে আস্তে সব প্রতিষ্ঠান গুটাইয়া নিজে ময়মনসিংহ শহরে চলিয়া আসিলাম। ১৯২২ সালের মাঝামাঝি জিলার জনপ্রিয় নেতা মৌঃ তৈয়বদ্দিন আহমদ পুনরায় ওকালতি শুরু করায় জিলা খিলাফত কমিটির সেক্রেটারির দায়িত্ব আমারই উপর পড়িল। আন্দোলনে যোগ দিয়াই তৈয়বুদ্দিন সাহেব ফ্যামিলি বাড়ি পাঠাইয়া দিয়াছিলেন। তাঁর বাসাই খিলাফত নেতাদের বাসস্থান ছিল। আমারও হইল। তৈয়বুদ্দিন সাহেব তাঁর বড় ভাই মৌঃ শাহাবুদ্দিন উকিল সাহেবের বাসায় খাওয়া-দাওয়া করিতেন। আমরা কতিপয় নেতা তৈয়বুদ্দিন সাহেবের বাসায় মেস করিয়া খাওয়া-দাওয়া করিতাম। নেতাদের মধ্যে যাঁদের শহরে বাড়ি-ঘর নাই তাঁরা কংগ্রেস খেলাফতের টাকাতেই খাওয়া খরচ চালাইতেন। আমারও তাই হইল। কিন্তু এটা আমার ভাল লাগিত না। বিশেষতঃ টাকার অভাবে এই সময় খিলাফত কমিটির স্বতন্ত্র অফিস উঠাইয়া কংগ্রেস অফিসেরই এক কামরায় খিলাফত অফিস করিলাম। এমত অবস্থায় নেতাদের খাওয়ার তহবিলের টাকা খরচ করিলে খেলাফত অফিসের খরচায় টান পড়িত।
৯. জাতীয় বিদ্যালয়ে মাস্টারি
অতএব আমি স্থানীয় জাতীয় বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা গ্রহণ করিলাম। এই স্কুলের হেড মাষ্টার ছিলেন আমার শিক্ষক ও মৃত্যুঞ্জয় স্কুলের ভূতপূর্ব সহকারী হেডমাস্টার শ্ৰীযুক্ত ভূপতি নাথ দত্ত। তিনি ছিলেন ঋষি-তুল্য মহাপ্রাণ ব্যক্তি। ছাত্রজীবনেই তিনি আমাকে পূত্রবৎ স্নেহ করিতেন। আমাকে পাইয়া তিনি লুফিয়া নিলেন সহকারীরূপে। তাঁর নেই-শীতল ছায়ায় ও তাঁর অভিজ্ঞ পরিচালনায় আমি শিক্ষকতা শুরু করিলাম। শিক্ষার আদর্শ ও উদ্দেশ্য সম্বন্ধে এবং শিক্ষকতার টেকনিক্যাল খুঁটি-নাটি ব্যাপারে এই সময় তাঁর কাছে অনেক জ্ঞান লাভ করিলাম। স্কুলের সময় তিনি ছাত্রদের যেমন বিদ্যা শিক্ষা দিতেন, স্কুল আওয়ারের পরে তেমনি তিনি আমাদিগকে শিক্ষকতা শিক্ষা দিতেন। বেতন হিসাবে আমি চল্লিশটি টাকা পাইতাম। এই টাকাতেই আমি খেলাফত নেতাদের মধ্যে রীতিমত ধনী লোক হইয়া গেলাম। নিজের পরা ছাড়া দু’একজন গরিব সহকর্মীকেও পোষিতে পরিতাম। শিক্ষকদের মধ্যে আরবী-ফারসী শিক্ষক ছাড়া। আরও দু’জন মুসলমান ছিলেন। তাঁদের নাম ছিল মৌঃ,সাইদুর রহমান ও মৌঃ আলী হোসেন। উভয়ে নিম্নশ্রেণীর শিক্ষক ছিলেন। সাইদুর রহমান সাহেব বেতন পাইতেন ত্রিশ টাকা ও আলী হোসেন পাইতেন পঁচিশ টাকা। উভয়েই আমাদের সাথে এক মেসে থাকিতেন। খেলাফত নেতা-কর্মীদের ভার তাঁদের উপরও গড়াইত।
এই সময় খিলাফত ও অসহযোগ আন্দোলন ঝিমাইয়া আসিয়াছে। কাজেই করিবার মত কাজ আমাদের বিশেষ কিছু ছিল না। দিনের বেলা মাস্টারি করি এবং বিকাল ও রাত্রি বেলা নেতাদের বাড়ি-বাড়ি চা খাই। অগত্যা অফিসে বসিয়া আড্ডা মারি। এই সুযোগে শহরের বড় বড় নেতা যথা শ্রীযুক্ত সূর্যকুমার সোম, ডাঃ বিপিন বিহারী সেন, শ্রীযুক্ত সুরেন্দ্র নাথ মৈত্রেয়, মিঃ সুধীর চন্দ্র বসু বারিস্টার (সূৰ্য্যবাবুর মেয়ের জামাই), শ্রীযুক্ত সুরেন্দ্র মোহন ঘোষ ও শ্রীযুক্ত মতিলাল পুরকায়স্থ প্রভৃতির সহিত ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত হই। সুরেনবাবু ‘মধু ঘোষ’ নামে সুপরিচিত ছিলেন। তিনি প্রায় আমার সমবয়স্ক। সেজন্য তাঁর সাথে বন্ধুত্ব হয়। তিনি বিপ্লবীদের ‘মধুদা’ ছিলেন। ডাঃ বিপিন সেন ও সূৰ্য্য সোম আমার পিতৃতুল্য শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি ছিলেন। পরবর্তী জীবনে তাঁদের স্নেহও পাইয়াছিলাম অফুরন্ত। তাঁরা উভয়ে অসাম্প্রদায়িক উদার মহান ব্যক্তি ছিলেন।