আর একবার প্রমাণিত হ’লো যে, বর্তমান জীবিত মানুষের দাবি-দাওয়া অতীত ও মৃত্যু মানুষের প্রত্নসাক্ষ্যের দাবি-দাওয়ার চেয়ে অনেক বেশি শক্তিমান! এ নিয়ে দুঃখ করে লাভ নেই; ভাব-বিলাসেরও কোনও স্থান এ-ক্ষেত্রে নেই।
যাই হোক, আমার একমাত্ৰ সাস্তুনা এই যে, যার উপর ভার পড়েছিল তেলকুপীর এই প্রত্নসাক্ষ্য যতটা পারা যায় ততটা অন্তত উদ্ধার করা এবং তার বিবরণ লিপিবদ্ধ করা, তিনি আমার অন্যতম প্রাক্তন-ছাত্রী, ডাকটর শ্ৰীমতী দেবালা মিত্র, যিনি বর্তমানে ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সৰ্ব্বেক্ষণের এডিশনাল ডিরেকটার-জেনারেল। প্রাচীন দলিলপত্র ঘেঁটে, একাধিকবারু মজমান তেলকুপী পরিদর্শন করে তেলকুপীর প্রত্নসাক্ষ্য সম্বন্ধে যা কিছু “জ্ঞাতব্য তথ্য প্রভূত পরিশ্রমে তিনি তা উদ্ধার করছেন। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থ Telkupi-a submerged temple site in West Bengal (Memoirs of the Archaeological Sorvey of India, no. 76) থেকে আহরণ করে তেলকুপীর তদানীন্তন ধর্ম ও স্থাপত্য শিল্প সম্বন্ধে দু’চার কথা এখানে সংযোজন করছি, ইতিহাস নির্মাণের পথে কত বাধা বিষ্ম তার একটু আভাস দেবার জন্য।
প্রাচীন তৈলকল্পী যে একটি সমৃদ্ধ মন্দির-নগরী ছিল, ইতস্তত বিক্ষিপ্ত মন্দিরগুলির ধ্বংসাবশেষ থেকেই তা অনুমান করা যায়। তা ছাড়া ১৯৫৬-৫৭ সালে দামোদরের জলের নীচে একেবারে তলিয়ে যাবার আগেও যে এই নগরী ও তার উপকণ্ঠে অন্তত ২৫/২৬টি মন্দির ধ্বংসের নানা অবস্থায় দাঁড়িয়েছিল তা শ্ৰীমতী দেবালা মিত্রের আহৃত প্রত্নসাক্ষ্য থেকেই জানা যায়। এই মন্দির-নগরীর কেন্দ্র ছিল যাকে সেদিন পর্যন্তও লোকেরা জানতো ভৈরবথান বা ভৈরবস্থান বলে; এই ভৈরব থানেই ছিল অন্তত ১৩টি মন্দির। ছোট ছোট আরও কত মন্দির যে ছিল তার কোনও হিসেবই নেই। তা ছাড়া, ইতস্তত দাড়িয়েছিল আরও ১৩টি। যে-কোনও দেবস্থানই সাধারণ লোকের কাছে পরিচিত ছিল “থান’ বা স্থান বলে; এই নগরীতে এমন ‘থান’ ছিল অনেক, যেমন, নিরনীথিান, দূৰ্গাথান, চরকাথান, শিবথান, কালীথান, জামকুকড়াথান ইত্যাদি।
তৈলকল্পী এই অঞ্চলে প্রধানত স্মার্ত-পৌরাণিক ব্ৰাহ্মণ্যধর্মের অন্যতম কেন্দ্র ছিল। মন্দিরগুলিতে যে-সব দেবদেবীদের পূজাৰ্চনা হতো প্রত্নসাক্ষ্য থেকে জানা যাচ্ছে, তাদের মধ্যে ছিলেন উমা-মহেশ্বর, বিষ্ণু, নরসিংহাবতার, মহিষমৰ্দিনী দুর্গ, মাতৃকাদেবী, লিঙ্গরূপী শিব, অন্ধকাসুরবধরত। শিব, লিকুলীশ শিব, সূর্য গণেশ ইত্যাদি। সংখ্যা থেকে অনুমান হয়, শৈব ধর্মেরই প্রাধান্য ছিল বেশি। অন্তত একটি জৈন মন্দিরও বোধ হয় ছিল; একটি মন্দিরের জগমোহন অংশে জৈন নেমিনাথের শাসন-দেবী অম্বিকার একটি বৃহদাকৃতি প্রতিমা পাওয়া গেছে!
স্থাপত্যশিল্পের দিক থেকে তেলকুপীর মন্দিরগুলিকে উত্তর-ভারতীয় রেখবর্গীয় মন্দিরের আঞ্চলিক একটি রূপ বললে ভুল কিছু বলা হয় না। স্থানীয় বেলে পাথরে তৈরি এই মন্দিরগুলি সবই আয়তনে ছোট, দৈর্ঘ্য ও পরিসরে আপেক্ষিকভাবে ক্ষুদ্রাকৃতি। পুরুলিয়ার অন্যত্র রেখবর্গীয় সে-সব মন্দির ধ্বংসের বিভিন্ন দশায় আজও দাড়িয়ে আছে (চিত্ৰ-সংগ্রহে এমন ২/৩টি মন্দিরের ছবি প্রকাশিত হয়েছে), এ-মন্দিরগুলি তাদেরই সমগোত্রীয়, আকৃতিতে এবং প্রকৃতিতেও। এই ধরনের মন্দির শুধু পুরুলিয়াতেই নয়, বাঁকুড়া ও বর্ধমানেও আছে, ওড়িশাতেও আছে। পঞ্চদশ শতকীয় (১৪৬১ খ্ৰীষ্ট শতক) বরাকারের মন্দির তিনটিও একই পরিবারভুক্ত বলা যেতে পারে। তেলকুপীর কোনও মন্দিরেই কোনও লিপিসাক্ষ্য নেই; সুতরাং মন্দিরগুলির নির্মাণ কাল সম্বন্ধে সুনিশ্চিত ভাবে কিছু বলবার উপায় নেই। তবে স্থাপত্য রীতি থেকে মনে হয়, এ-অঞ্চলের এই রেখবর্গীয় মন্দির-নির্মাণ শুরু হয়েছিল নবম-দশম শতকে এবং একটানা অন্তত ত্ৰয়োদশ শতকের শেষ পর্যন্ত চলেছিল।
১৫. ইতিহাসের ইঙ্গিত
০১. ইতিহাসের ইঙ্গিত – শেষ কথা
ইতিহাসের যুক্তি দিয়া এই গ্রন্থের সূচনা; সেই যুক্তিকেই বিস্তৃত করিতে চেষ্টা করিয়াছি পর পর তেরোটি অধ্যায়। জুড়িয়া! এই সুবিস্তৃত তথ্যবিবৃতি ও আলোচনার ভিতর হইতে ইতিহাসের কোন কোন ধারা সরু মোটা রেখায় সুস্পষ্ট হইয়া উঠিতেছে, নিরবচ্ছিন্ন সমগ্র প্রবাহটির কোথায় কোন বাঁেক দৃষ্টিগোচর হইতেছে, এই সুবিস্তৃত কালখণ্ড পরবর্তী কালখণ্ডের জন্য কী কী বস্তু উত্তরাধিকার স্বরূপ রাখিয়া যাইতেছে, ভবিষ্যতের কোন নির্দেশ দিয়া যাইতেছে, এক কথায় এই সুবৃহৎ গ্রন্থ ভেদ করিয়া ইতিহাসের কোন ইঙ্গিত ফুটিয়া উঠিতেছে, গ্ৰন্থশেষে একটি অধ্যায়ে তাহার আলোচনা উপস্থিত করা হয়তো অসঙ্গত নয়। এতক্ষণ ছিলাম। ঘনবৃক্ষবিন্যস্ত গহন অরণ্যের মধ্যে; এখন দূরে দাঁড়াইয়া বাহির হইতে সমস্ত অরণাটির আকৃতি-প্রকৃতি এবং উহার সমগ্র জীবন-প্রবাহের ধারাটি সংক্ষেপে একটু ধরিবার চেষ্টা করা যাইতে পারে। এই চেষ্টার উদ্দেশ্য প্রাচীন বাঙালীর জীবন-প্রবাহের উপরিভাগের ছোটবড় তরঙ্গগুলির পরিচয় লওয়া নয়; সে কাজ তো সুদীর্ঘ গ্রন্থ জুড়িয়াই করিয়াছি। বরং আমার উদ্দেশ্যে, সেই প্রবাহের গভীরে কোন আবর্ত ঘূর্ণ্যমান, কোন অনুকূল ও প্রতিকূল অবস্রোতের সঞ্চরণ, কোন কোন শক্তি সক্রিয় তাহা জানা ও বুঝা, সমস্ত ঘটনাপ্রবাহ ও বস্তুপুঞ্জকে সংহত করিয়া একটি গভীর ও সমগ্র দৃষ্টিতে দেখা, প্রাচীন বাঙালী জীবনের মৌলিক ও গভীর চরিত্রটিকে ধরিতে চেষ্টা করা। এই জানা ও বুঝা, দেখা ও ধরা ঐতিহাসিকের অন্যতম কর্তব্য বলিয়া মনে করি।