ব্রাহ্মণ, বৈদ্য, কায়স্থ ও নমঃশূদ্রদের ছাড়া আর যে সব বর্ণের উল্লেখ আগে করা হইয়াছে, তাহাদের মধ্যে গান্ধিক বণিক, সদগোপ ও গোয়ালা (গোপ), কৈবর্ত (চাষী ও মাহিষ্য), নাপিত, ময়রা (মোদক), বারুই (বারজীবী অর্থাৎ পানের বরজ যাহার উপজীবিকা), তামূলী (তাম্বুলী-যে পান বিক্রয় করে) এবং যুগী (তন্তুবায়) নিঃসন্দেহেই বৃহদ্ধর্মপুরাণের উত্তম সংকর পর্যায়ভুক্ত, এবং কলু বা তেলি (তৈলকারক), রজক, সুবর্ণবণিক এবং মালী মধ্যম সংকর পর্যায়ভুক্ত। চণ্ডাল বা চাঁড়াল, মুচি (চর্মকার), দুলিয়া (ডোলাবাহী), মালো, কেওড়া, মল্ল, ধীবর, প্রভৃতি অন্ত্যজ পর্যায়ের।
এইগুলি ছাড়া আরও কয়েকটি জাতের লোকদের সম্বন্ধে এবং উল্লিখিত জাতগুলি সম্বন্ধেও অতিরিক্ত কিছু কিছু পরিমিতি-গণনা বিভিন্ন নৃতত্ত্ববিদেরা করিয়াছেন। এইসব নরতত্ত্বগত পরিমিতি-গণনায় যাহা পাওয়া যায় তাহা বিশ্লেষণ করিলে দেখা যায়, উচ্চবর্ণের অর্থাৎ ব্রাহ্মণ, বৈদ্য, কায়স্থ-বর্ণের বাঙালী দেহ-দৈর্ঘ্যের দিক হইতে মধ্যমাকৃতি; নমঃশূদ্রেরাও তাহাই। উত্তম সংকর বিভাগের বাঙালীও সাধারণত মধ্যমাকৃতি, কিন্তু খর্বতার দিকেও একটা ঝোঁক খুব স্পষ্ট। মালী ছাড়া মধ্যম সংকর বর্ণের লোকেরাও তদনুরূপ; মালীরা খর্বাকৃতি। অন্ত্যজ পর্যায়ের বা বর্তমানের তথাকথিত অস্পৃশ্য জাতের লোকেরা সাধারণত খর্বাকৃতি; কিন্তু ইহাদের মধ্যেও কোনও কোনও জাত স্পষ্টতই মধ্যমাকৃতি এবং অনেক জাতের মধ্যেই মধ্যমাকৃতির দিকে ঝোঁক কিছুতেই দৃষ্টি এড়াইবার কথা নয়। মুণ্ডাকৃতির দিক হইতে দেখিতে গেলে, সাধারণ ব্রাহ্মণ, কায়স্থ প্রভৃতি উচ্চবর্ণ এবং নমঃশূদ্ররা যেমন গোলাকৃতি, উত্তম সংকর পর্যায়ের অধিকাংশ বর্ণ তেমনই। আবার কোনও কোনও নিম্ন উপবর্ণের মধ্যে, যেমন পশ্চিম বাঙলার ভূমিজ ও সাঁওতালদের মধ্যে গোলের দিকেও একটু ঝোঁক উপস্থিত। এই ধরনের ঝোঁক, অবশ্য কিছু কিছু অন্য বর্ণের মধ্যেও একেবারে অনুপস্থিত নয়। তেমনই আবার কতকগুলি বর্ণের মধ্যে দৈর্ঘ্যের দিকে ঝোঁক অত্যন্ত স্পষ্ট, যেমন মাহিষ্য, নাপিত, ময়রা, সুবর্ণবণিক, মুচি, বুনা, বাগদী, বেদে, পশ্চিম বঙ্গের মুসলমান প্রভৃতিদের মধ্যে। কতগুলি বর্ণ তো স্পষ্টতই দীর্ঘমুণ্ডাকৃতি, যেমন উত্তর, মধ্য ও দক্ষিণ বঙ্গের নাসাকৃতির দিক হইতে ব্রাহ্মণ-বৈদ্য-কায়স্থ ও নমঃশূদ্র বর্ণের লোকেরা সকলেই সাধারণত তীক্ষ্ণ ও উন্নতনাসা। সুবর্ণবণিকদের মধ্যে তীক্ষ্ণ ও উন্নত নাসা হইতে চ্যাপটা পর্যন্ত সব ধারাই সমভাবে বিদ্যমান; পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানদের মধ্যেও তাহাই। ময়রাদের নাসাকৃতি মধ্যম কিন্তু তীক্ষ্ণতার দিকে ঝোঁক স্পষ্ট। উত্তম ও মধ্যম সংকর পর্যায়ের, এমন-কি অস্পৃশ্য ও অন্ত্যজ পর্যায়ের অধিকাংশ বর্ণেরই নাসাকৃতি মধ্যম, তবে কোনও কোনও বর্ণের কোমদের মধ্যে, যেমন গন্ধবণিক, নাপিত, তেলি, কলু, মালো প্রভৃতির চ্যাপটার দিকেঝোঁক সহজেই ধরা পড়ে। আবার কতগুলি বর্ণের নাসাকৃতি একেবারেই চ্যাপটা, যেমন, বেদে ভূমিজ, বাগদী, বাউর, তামলী, তন্তুবায়, রজক, মালী, মুচি, বাশফেড়, মাহিষ্য প্রভৃতি। সাঁওতালদের নাসিকাকৃতিও চ্যাপটা, কিন্তু মধ্যমাকৃতির দিকে ঝোঁক আছে।
কয়েকটি ধারণা এইবার মোটামুটি কিছুটা স্পষ্ট হইল। সাধারণভাবে বলা যায়, বাঙালীর চুল। কালো, চোখের মণি পাতলা হইতে ঘন বাদামী, বা কালো, গায়ের রং সাধারণত পাতলা হইতে ঘন বাদামী, নিম্নতম শ্রেণীতে চিকণ ঘনশ্যাম পর্যন্ত দেহ-দৈর্ঘ্যের দিক হইতে বাঙালী মধ্যমাকৃতি, খর্বতার দিকে বোকও অস্বীকার করা যায় না। বাঙালীর মুণ্ডাকৃতি সাধারণত দীর্ঘ উচ্চবর্ণস্তরে গোলের দিকে বেশি ঝোঁক। নাসাকৃতিও মোটামুটি মধ্যম, যদিও তীক্ষ্ণ ও উন্নত নাসাকৃতি উচ্চতর বর্ণের লোকদের ভিতর সচরাচর সুলভ।
বাঙলাদেশের বিভিন্ন শ্রেণীর উচ্চ ও নিম্নজাতের এবং বাঙালী মুসলমানদের কিছু কিছু রক্তবিশ্লেষণ কোথাও কোথাও হইয়াছে। মিসেস ম্যাকফারলেন, রবীন্দ্রনাথ বসু, মীনেন্দ্রনাথ বসু, শশাঙ্কশেখর সরকার, অনিল চৌধুরী, মাখনলাল চক্রবর্তী প্রভৃতি কয়েকজন তাঁহাদের গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করিয়াছেন। ইঁহাদের সম্মিলিত গবেষণার ফল মোটামুটি বাঙালীর জন-সাংকর্যের ইঙ্গিত সমর্থন করে। ডক্টর ম্যাকফারলেনের মতে, বর্ণ, বর্ণেতর ও অস্পৃশ্য বাঙালী হিন্দুদের মধ্যে যে রক্তবৈশিষ্ট্য ধরা পড়ে বাঙালী মুসলমানদের মধ্যেও তাঁহাই। বাঙালী মুসলমানেরা যে বাঙালী হিন্দুদেরই সমগোত্রীয় ইহা তাহার আর একটি প্রমাণ।
কিন্তু এতক্ষণ বাঙালী জাতির দেহ-গঠনের যে সব বৈশিষ্ট্যের কথা বলা হইল, তাহা আসিল কোথা হইতে? এ প্রশ্নের উত্তর পাইতে হইলে প্রাগৈতিহাসিক যুগ হইতে আরম্ভ করিয়া ভারতবর্ষে যে সব জন ছিল ও পরে যে সব জন একের পর এক এদেশে আসিয়া বসবাস করিয়াছে, প্রবহমান রক্তস্রোতে নিজেদের রক্ত মিশাইয়াছে, মৈত্রী ও বিরোধের মধ্য দিয়া একে অন্যের নিকটতর হইয়াছে, তাঁহাদের হিসাব লইতে হয়। কিন্তু তাহা করিবার আগে একটি সুপ্রচলিত মতবাদ সম্বন্ধে একটু বিচারের অবতারণা করা প্রয়োজন। এই মতটি নরতাত্ত্বিক হার্বার্ট রিজলির।
বাঙলাদেশের উচ্চবর্ণগুলির ভিতর এবং অন্যান্য বর্ণের ভিতরও চওড়া নাসিকাকৃতি এবং গোল মুন্ডাকৃতির একটা সুস্পষ্ট ধারা বিদ্যমান, এ কথা আগেই বলা হইয়াছে। বাঙালীর এইসব বৈশিষ্ট্যের যুক্তি খুঁজিতে গিয়া বহুদিন আগে রিজলি সাহেব বলিয়াছিলেন, বাঙালীরা প্রধানত মোঙ্গোলীয় ও দ্রাবিড় নরগোষ্ঠীর সংমিশ্রণে উৎপন্ন। তিব্বত-চৈনিক গোষ্ঠীর চীনা, বর্মী, ভোটিয়া, নেপালী প্রভৃতি জনের লোকেরা তো আমাদের সুপরিচিত। ইহারা খর্বকায়, স্বল্পশ্মশ্রু এবং পীতাভবর্ণ। ইহাদের করোটি প্রশস্ত, নাসাকৃতি সাধারণত চ্যাপ্টা। আর, রিজলি যাহাদের বলিয়াছেন দ্রাবিড় সেই নরগোষ্ঠী তাহার মতে সিংহল হইতে গঙ্গার উপত্যকা পর্যন্ত বিস্তৃত। ইহারা কৃষ্ণবর্ণ, খর্বকায়, ইহাদের মুন্ডাকৃতি দীর্ঘ, নাসাকৃতি চ্যাপ্টা। রিজলি মনে করেন, এই দুই নরগোষ্ঠীর মিশ্রণে উৎপন্ন মোঙ্গোল-দ্রাবিড় নরগোষ্ঠী বিহার হইতে আরম্ভ করিয়া আসাম পর্যন্ত এবং উড়িষ্যা ও ছোটনাগপুর হইতে আরম্ভ করিয়া হিমালয় পর্যন্ত বিস্তৃত। ইহাদের মাথা গোল হইতে মধ্যমাকৃতি, নাসা মধ্যম হইতে চ্যাপ্টা। ব্রাহ্মণ-কায়স্থদের ভিতর উন্নত ও সুগঠিত নাসার প্রাধান্য দেখা যায়। মোঙ্গলীয়দের মাথা প্রশস্ত (অর্থাৎ চওড়া, brachycephalic); কিন্তু তাহাদের নাক চ্যাপ্টা; বাঙালীদের প্রশস্ত মুন্ডের ধারা মোঙ্গালীয় শোণিতের দান, আর বাহ্মণ-কায়স্থদের উন্নত সুগঠিত নাসা ভারতীয় আর্যরক্তের দান, ইহাই হইতেছে রিজলির মত। এই মত অনুসরণ করিয়া তিনি সিদ্ধান্ত করিয়াছিলেন যে, উড়িষ্যা ও ছোটনাগপুর পর্যন্ত সমস্ত পূর্ণভারতে মোঙ্গোলীয় প্রভাব উপস্থিত; দ্রাবিড় বলিয়া একটি নরগোষ্ঠী আছে এবং ইহাদের মাথা দীর্ঘ– এই দুই নরগোষ্ঠীর সাংকর্যে বাঙালীর উৎপত্তি। কাজেই বাঙালীর মুন্ডাকৃতি মধ্যম এবং তাহার মধ্যে দুই প্রান্তের গোল ও দীর্ঘ দুই ধারাই বর্তমান। উচ্চবর্ণের লোকদের মধ্যে যে উন্নত সুগঠিত নাসামান দেখা যায় তাহা ভারতীয় আর্যরক্তের দান।