ভারতবর্ষে বায়ানা নামক স্থানে প্রস্তরীভূত নরমুণ্ডের কঙ্কাল, দক্ষিণ ভারতে আদিত্যনল্পরে প্রাপ্ত কতকগুলি মুণ্ড-কঙ্কাল, মহেন-জো-দড়ো ও হরপ্পায় প্রাপ্ত কতকগুলি নরকঙ্কাল এবং তক্ষশিলার ধর্মরাজিক বিহারের ধ্বংসাবশেষের মধ্যে প্রাপ্ত কয়েকটি বৌদ্ধভিক্ষুর দেহাবশেষ ভারতীয় নরতত্ত্বজিজ্ঞাসার মীমাংসায় যে পরিমাণে সাহায্য করিয়াছে, বাঙলাদেশের জননির্ণয়ে তেমন সাহায্য পাইবার উপায় এ পর্যন্ত আবিষ্কৃত হয় নাই। বস্তুত, এ যাবৎ বাঙলাদেশের কোথাও প্রাগৈতিহাসিক বা ঐতিহাসিক কোনও যুগেরই কোনও নরকঙ্কাল আবিষ্কৃত হয় নাই। প্রাগৈতিহাসিক লৌহ অথবা প্রস্তর-যুগের বিশেষ কোনও বাস্তবাবশেষও বাঙলাদেশে এ পর্যন্ত এমন কিছু পাওয়া যায় নাই যাহার ফলে সেই যুগের সভ্যতা এবং সেই সূত্রে নরতত্ত্বনির্ণয়ের ইঙ্গিত কতকটা পাওয়া যাইতে পারে। কিন্তু যাহা আমাদের নাই তাহা লইয়া দুঃখ করিয়াও লাভ নাই। যতটুকু যাহা পাওয়া গিয়াছে তাহা লইয়াই একটা হিসাব-নিকাশ আপাতত করা যাইতে পারে।
——————
(১) এই নিবন্ধে জন সাধারণত ইংরাজী ‘people’ অর্থে ব্যবহৃত হইয়াছে , caste বুঝাইতে ‘বর্ণ’ ও বাংলা চলতি ‘জাত’ শব্দ ব্যবহৃত হইয়াছে। ইংরাজি ‘race’ ও ‘people’ এই দুইটি শব্দ লইয়া নানাপ্রকার বিভ্রমের সৃষ্টি ঐতিহাসিকদের মধ্যে দুর্লভ নয় ।
২. বাঙলার বর্ণবিন্যাস ও জনতত্ত্ব
দ্বিতীয় অধ্যায় । ইতিহাসের গোড়ার কথা
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ – বাঙলার বর্ণবিন্যাস ও জনতত্ত্ব
বাঙলার বর্ণবিন্যাস ও জনতত্ত্ব
বাঙলার বিভিন্ন বর্ণ ও শ্রেণীর জনসাধারণের দেহগঠনের, বিশেষভাবে কেশবৈশিষ্ট্য, চোখ ও চামড়ার রং, নাসিকা, কপাল ও নরমুণ্ডের আকৃতি ইত্যাদির পরিমিতি গ্রহণ করিয়া এ পর্যন্ত যাহা পাওয়া গিয়াছে তাহা সংক্ষেপে জানিয়া লওয়া যাইতে পারে। সকলের পরিমিতি একই মানদণ্ড অনুসারে গৃহীত হয় নাই; পণ্ডিতদের মধ্যে পরিমিতি গণনার যে বিভিন্নতা দেখা যায় ইহা তাহার অন্যতম কারণ। তবে, মোটামুটি বৈশিষ্ট্যগুলি ধরিতে পারা খুব কঠিন নয়। সর্বত্রই প্রধান প্রধান ধারার কথাই উল্লেখ করা সম্ভব; উপধারাগুলির ইঙ্গিতমাত্র দেওয়া চলে। অথচ প্রধান প্রধান ধারার সঙ্গে উপধারা মিলিয়া এক হইয়াই বাঙালীর জন-সাংকর্যের সৃষ্টি হইয়াছে, এ কথা ভুলিলে চলিবে না।
বৃহদ্ধর্মপুরাণ একটি উপপুরাণ; ইহার তারিখ আনুমানিক খ্ৰীষ্টীয় ত্রয়োদশ শতক; তুর্কি-বিজয়ের অব্যবহিত পরেই রাঢ়দেশে ইহা রচিত হইয়াছিল এমন অনুমান করিলে খুব অন্যায় হয় না। ব্রাহ্মণ-বর্ণ বাদ দিয়া সমসাময়িক বাঙলাদেশের জনসাধারণ যে ছত্রিশটি জাত-এ বিভক্ত ছিল, তাহার একটু পরিচয় এই গ্রন্থে পাওয়া যায়। গ্রন্থটির রচয়িতা ব্রাহ্মণেতর শূদ্রবর্ণের লোকদিগকে তদানীন্তন বর্ণবিভাগানুযায়ী তিনটি শ্রেণীতে বিভক্ত করিয়াছেন :
১. উত্তম সংকর বিভাগ : করণ (সৎশূদ্র), অম্বষ্ঠ (বৈদ্য), উগ্র, মাগধ, গান্ধিক, বণিক, শান্থিক, কংসকার, কুম্ভকার, তন্তুবায়, কর্মকার, গোপ, দাস (চাষী), রাজপুত্র, নাপিত, মোদক, বারজীবী, সূত (সূত্রধর), মালাকর, তামুলী ও তৌলিক। (২০)
২. মধ্যম সংকর বিভাগ : তক্ষণ, রজক, স্বর্ণকার, স্বর্ণবণিক, আভীর, তৈলকারক, ধীবর, শোণ্ডিক, নট, শাবাক (শাবার), শেখর ও জালিক। (১২)
৩. অন্ত্যজ বা অধম সংকর (বর্ণাশ্রম-বহিস্কৃত) : মলেগ্রহী, কুড়ব, চণ্ডাল, বরুড়, চর্মকার, ঘণ্টজীবী বা ঘট্টজীবী, ডোলাবাহী, মল্ল ও তক্ষ। (৯)
ইহা ছাড়া তিনি অবাঙালী ও বৈদেশিক ম্লেচ্ছ কয়েকটি কোমের নামও করিয়াছেন স্বতন্ত্র বিভাগের অধীনে, যথা, দেবল বা শাকদ্বীপী ব্রাহ্মণ, গণক-গ্রহবিপ্ৰ, বাদক, পুলিন্দ, পুককশ, খশ, যবন, সুহ্ম, কম্বোজ, শবর, খর ইত্যাদি। উপরের তালিকা হইতে দেখা যাইবে, বৃহদ্ধর্মপুরাণ যদিও বলিতেছেন ছত্রিশটি জাত বা বর্ণ-উপবর্ণের কথা, নাম করিবার সময় করিতেছেন একচল্লিশটির। পাচটি যে পরবর্তী কালের যোজনা, এ অনুমান সেই হেতু অসংগত নয়। এখনও আমরা ছত্রিশ জাত-এর কথাই তো প্রসঙ্গত বলিয়া থাকি। ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণের ব্রহ্মখণ্ডও খুব সম্ভব বাঙলাদেশের রচনা এবং বৃহদ্ধর্মপুরাণের প্রায় সমসাময়িক। এই পুরাণেও সমসাময়িক বাঙলার বিভিন্ন জাত-এর একটা অনুরূপ তালিকা পাওয়া যায়। এই গ্রন্থেরই বর্ণবিন্যাস অধ্যায়ে এ সম্বন্ধে বিস্তৃত আলোচনা পাওয়া যাইবে; এখানে বর্তমান প্রয়োজনে সে তালিকার আর কোনও প্রয়োজন নাই।
বর্ণ ও জনের দিক হইতে এই বিভাগ যে কৃত্রিম এ কথা অনস্বীকার্য, তাহা ছাড়া বর্ণ তো কিছুতেই জন-নির্দেশক হইতে পারে না। আর, একটু মনোযোগ করিলেই দেখা যাইবে, ইহার প্রথম দুইটি বিভাগ ব্যবসায়-কর্মগত এবং তৃতীয় ও চতুর্থ বিভাগ দুইটি কতকটা জনগত। প্রথম বিভাগটি জলচল ও দ্বিতীয় বিভাগটি জল-অচল বর্ণের বলিয়া অনুমেয়; কাজেই কি কর্মবিভাগ কি জনবিভাগ, কোনও দিক হইতেই ইহার মধ্যে ঐতিহাসিক যুক্তি হয়তো মিলিবে না। দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যায়, স্বর্ণকার ও স্বর্ণবণিক কেনই বা মধ্যম সংকর, আর গন্ধবণিক ও কংসবণিক কেনই বা উত্তম সংকর, অথবা তৈলকার কেনই বা মধ্যম সংকর। বস্তুত, বর্ণবিভাগ যেখানে ব্যবসায়-কর্মগত সেখানে প্রত্যেক বর্ণের মধ্যেই বিভিন্ন জনের বর্ণ আত্মগোপন করিয়া থাকিবেই; এই বর্ণগুলি সেইজন্যই সংকর এবং স্মৃতি ও পুরাণে বারবার যে বর্ণসংকর ও জাতিসংকরের কথা বলা হইয়াছে ইহার ইঙ্গিত ইতিহাস ও নরতত্ত্বের দিক হইতে নিরর্থক ও অযৌক্তিক নয়। রাহ্মণবর্ণের মধ্যে সাংকর্যের কথা যে বলা হয় নাই তাহার কারণ হয়তো এই যে, এইসব পুরাণ ও স্মৃতি প্রায়শ তাহাদেরই রচনা; অথচ নরতত্ত্বের দিক হইতে দেখা যাইবে এই জাতিসাংকর্য অম্বষ্ঠ ও করণদের সম্বন্ধে যতখানি সত্য ঠিক ততখানি সত্য ব্রাহ্মণদের সম্বন্ধেও। নরতাত্ত্বিক বিশ্লেষণে এই কথাটা ভালো করিয়া ধরা পড়িবে এবং তখন দেখা যাইবে, ব্রাহ্মণ প্রভৃতি উচ্চবর্ণের লোকেরা যে পরিমাণে সংকর, বৃহদ্ধর্মপুরাণের উত্তম এবং মধ্যমে সংকর বিভাগের অধিকাংশ বর্ণই সেই পরিমাণে এবং প্রায় একই বৈশিষ্ট্যে সংকর।