তবে সত্যটা কী? শ্রীবিবস্বান আর্য ‘মিথ্যাময় ইতিবৃত্ত’ গ্রন্থে বলেছেন–“রামায়ণ নামটার সঙ্গে রাম বা শ্রীরামচন্দ্রের নামের কোনো সম্পর্ক ছিল না। বইয়ের নাম রাখার ব্যাপারে এ ধরনের অসংগতি ইলিয়াড-ওডিসি নামের প্রাচীন গ্রিক ভাষায় লেখা বলে প্রচার করা দুটি কাব্যগ্রন্থের ক্ষেত্রেও ঘটেছে। ইলিয়াডের সঙ্গে ইলিয়াম স্থাননামের এবং ওডিসির সঙ্গে অডিসিয়ুস চরিত্ৰনামের সম্পর্ক থাকার কথাটাও কষ্টকল্পিত। স্বভাবতই কিছু প্রশ্ন সামনে এসে পড়ে। সম্পর্ক যদি না-ই থাকবে তবে গ্রন্থ চারটির (রামায়ণ, মহাভারত, ইলিয়াড ও ওডিসি) নাম রাখার আসল কারণটা কী? তবে কি গ্রন্থগুলির নাম রাখার ব্যাপারে কোনো রহস্য আছে? না-হলে চার চারটি বিশ্ববিখ্যাত গ্রন্থের নাম রাখতে একইরকম অসংগতি থেকে যাবে কেন? কেন ইলিয়াড ও ওডিসি শব্দদুটির তর্জমা করেই রামায়ণ ও মহাভারত নামদুটো উদ্ভাবনের ব্যবস্থা হয়েছে?”
গ্রন্থগুলির রচনাকাল সম্পর্কে ২০০/৪০০ বছর এদিক-ওদিক করার খেলা কেউ কেউ দেখালেও এগুলি যে জিশুখ্রিস্ট্রের জন্মের আগে লেখা হয়েছে সে সম্পর্কে কেউই সন্দেহ প্রকাশ করেননি। তবে রামায়ণ কোন্ সময়ে। রচিত হয়েছিল তা নির্ণয় করা সহজ নয়। কারণ রামায়ণে যেমন মূল’ অংশ আছে, তেমনই আছে প্রক্ষিপ্ত অংশ। আবার এই প্রক্ষিপ্ত অংশগুলিও বিভিন্ন সময়ে যোগ করা হয়েছে। কাজেই কালগত বৈষম্যের ফলে সমগ্র রামায়ণের একটি নির্দিষ্ট রচনাকাল নির্ণয় করা সম্ভব নয়। ইয়াকোবি (Jacobi) ও ম্যাকডাওয়েল (McDowell) মনে করেন, রামায়ণ প্রাক্-যুদ্ধযুগের রচিত কাব্য। এর রচনাকাল ৮০০ থেকে ৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ। কিথ (Keith) বলেন, রামায়ণ খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকে রচিত৷ ভিন্টারনিৎস (Winternitz) ও বুলকে (Bulcke) বলেছেন, রামায়ণের রচনাকাল খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতকেই।
বস্তুত ষষ্ঠ শতকের রামায়ণ গ্রন্থ উদ্ধার করা হয়েছে। রামায়ণ লিখিত পৃষ্ঠাগুলি ভারতের কলকাতার সংস্কৃত ভিত্তিক গ্রন্থাগারে পাওয়া যায়। সংস্কৃত সাহিত্য পরিষদ এ তথ্য বার্তা সংস্থা টাইমস অব ইন্ডিয়াকে জানিয়েছে। রামায়ণের এই সংস্করণে রাম-সীতা ও বিভিন্ন মানুষের কাহিনি বর্ণনা করা হয়েছে। তবে এ সংস্করণের বিশেষত্ব হচ্ছে, রাম-সীতার পৃথক হওয়ার কাহিনি বিশেষভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। এই সংস্করণ চতুর্থ খ্রিস্টপূর্বে রচিত বাল্মীকির রামায়ণ থেকে ভিন্ন। পাঁচ খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে উদ্ধার হওয়া ওই রামায়ণ। অন্যদিকে বাল্মীকির রামায়ণ সাত খণ্ডে প্রকাশিত। যা এখন পর্যন্ত সবার কাছে গ্রহণযোগ্য।
ইয়াকোবির মতকে স্বীকার করে নিয়ে ওয়েবার (weber) কয়েকটি যুক্তি দেখিয়েছেন–(১) রামায়ণ একটি রূপক মাত্র। ভারতবর্ষে গ্রিক আক্রমণের আগেই রামায়ণ রচিত হয়েছিল। রামায়ণে ‘যবন’ শব্দের ব্যবহার থাকলেও তা গ্রিকদের বোঝায় না। উত্তর-পশ্চিম ভারতে একসময় সমস্ত বৈদেশিক আক্রমণকারী সাম্রাজ্যলোভী জাতিকে ‘যবন’ বলে অভিহিত করা হত। (২) রামায়ণ রচনাকালে পাটলিপুত্ৰ (এখন পাটনা) নগরী স্থাপন হয়নি। মেগাস্থিনিসের বিবরণ থেকে জানা যায়, খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকে তা স্থাপিত হয় এবং মগধরাজ অজাতশত্রুর পৌত্র উদয়ী রাজগৃহ থেকে পাটলিপুত্রে রাজধানী স্থানান্তরিত করেন। রামায়ণে এই বিখ্যাত নগরীর উল্লেখ না-থাকার পাটলিপুত্র প্রতিষ্ঠার পূর্বে রামায়ণ রচিত হয়েছিল বলে মনে করা হয়।(৩) বাল্মীকির ভাষা বহু ক্ষেত্রে পাণিনি ব্যাকরণের নিয়ম মেনে চলেনি। তাই মনে করা যায়, রামায়ণ পাণিনির আগে রচিত। (৪) রামায়ণে মিথিলা ও বিশালা নামে দুটি পৃথক নগরীর উল্লেখ আছে। বুদ্ধের সময়ে ওই দুই নগরী মিলিত হয়ে একটি রাজ্যে পরিণত হয়, সেই রাজ্যটির নাম বৈশালী। রামায়ণে বৈশালীর উল্লেখ না-থাকার মনে করা যেতে পারে রামায়ণ বৌদ্ধযুগের আগে রচিত।(৫) রামায়ণের কাহিনি অনুসরণ করলে দেখা যায়, সে যুগে ভারতবর্ষ অনেক অনেক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যে বিভক্ত ছিল। বৌদ্ধযুগের পূর্বেই ভারতবর্ষের এই অবস্থা। এ থেকেও প্রমাণিত হয় রামায়ণ বৌদ্ধযুগের আগে রচিত। (৬) বৌদ্ধ ও জৈনযুগের সাকেত নগরী আগে কোশলের রাজধানী ছিল এবং তার নামকরণ করা হয় অযোধ্যা। রামায়ণে সাকেত নগরীর উল্লেখ না-থাকার অনুমান করা যায় যে, বৌদ্ধযুগের বহু আগেই রামায়ণ রচিত হয়। (৭) ইয়াকোবির মতে, রামায়ণে পালি ভাষার কোনো চিহ্ন না-থাকার রামায়ণ বৌদ্ধযুগের আগেই রচিত। (৮) রামায়ণের কোনো চরিত্রই ঐতিহাসিক নয়। সীতা মূলত কৃষির রূপক। রামের দ্বারা রাবণ বধ এবং সীতা উদ্ধারের কাহিনি বস্তুত অনার্যদের আক্রমণের হাত থেকে কৃষিভিত্তিক আর্যসভ্যতা রক্ষা করা। সুতরাং বৌদ্ধযুগের বহু পূর্বেই রামায়ণের মূল অংশের রচনা সম্পূর্ণ হয়েছিল। অতএব ওয়েবার ও ইয়াকোবির গবেষণা থেকে যে সমর্থন পাওয়া যাচ্ছে, তা হল–রামায়ণ খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতকের পূর্বে রচিত হয়েছিল। দশরথ জাতক, শ্যাম জাতক, বিশ্বম্ভব জাতক, নলিনীকা জাতক, মহাসুত সোম জাতক প্রভৃতি জাতক কাহিনির সঙ্গে মিল দেখে ডঃ দীনেশচন্দ্র সেন মনে করেন, বাল্মীকি রামায়ণ রচনা করার পূর্ব থেকেই জাতকে বিভিন্ন রামকাহিনি প্রচলিত ছিল।