মহাকাব্য ব্যক্তিনিষ্ঠ নয়, বরঞ্চ বস্তুনিষ্ঠ। লেখকের অন্তর অনুভূতির প্রকাশ নয়, বস্তুপ্রধান ঘটনাবিন্যাসের প্রকাশ। গীতিকাব্যোচিত সুরেলা বাঁশি নয়, রণসজ্জার তুর্য-নিনাদ। মহাকাব্য মহাকায়, মহিমোজ্জ্বল, ব্যাপক হিমাদ্রিকান্তির মতো ধীর, গম্ভীর, প্রশান্ত, সমুন্নত ও মহত্ত্বব্যঞ্জক। এই কাব্যে কবির আত্মবাণী অপেক্ষা বিষয়বাণী ও বিষয়বিন্যাসই আমাদের অধিকতর দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এছাড়া সংস্কৃত আলংকারিকদের মতে আশীর্বচন, মস্ক্রিয়া অথবা বস্তুনির্দেশ দ্বারা এই কাব্য শুরু হয়। মহাকাব্যের আখ্যানবস্তু পৌরাণিক বা ঐতিহাসিক। বৈয়াকরণ বিশ্বনাথ বলেছেন–“ইতিহাসোঙবংবৃত্তমন্যদ্বা সজ্জনাশ্রয়”। নায়ক (কখনো কখনো একাধিক নায়কও থাকতে পারে) ধীরোদাত্তগুণসমন্বিত অর্থাৎ সমস্ত সদ্গুণের সমষ্টিভূত; সর্গসংখ্যা অষ্টাধিক এবং পটভূমি স্বর্গ-মর্ত্য-পাতাল প্রসারী। এতে শৃঙ্গার, বীর, শান্ত–এই তিনটির একটি রস মুখ্য বা প্রধান এবং অন্যান্য রস এদের অঙ্গস্বরূপ হবে।
সংস্কৃত আলংকারিকদের মতে যা মহাকাব্য, তার সঙ্গে পাশ্চাত্য মহাকাব্যের কোনো কোনো বৈসাদৃশ্য থাকলেও এদের মধ্যে ভাবগত সাদৃশ্য বর্তমান। পাশ্চাত্য আলংকারিক এরিস্টটলের মতে, “মহাকাব্য আদি, মধ্য ও অন্ত সংবলিত বর্ণনামূলক কাব্য। এতে বিশিষ্ট কোনো নায়কের জীবনকাহিনি অখণ্ডভাবে বর্ণনা করা হয় এবং বীরোচিত ছন্দের সাহায্যে কীর্তিত হয়। মহাকাব্যের বস্তু উপাদান জাতীয় জীবনের ঐতিহাসিক বা পৌরাণিক তথ্য সরবরাহ করে। এর অনুপ্রেরণা অধিকাংশ সময়ই ঐশীশক্তি; এতে মানব, দানব, দেবদেবীর চরিত্রের সমাবেশ এবং প্রয়োজনবোধে অতিলৌকিক স্পর্শও উপস্থিত থাকতে পারে। তবে মহাকাব্যের পরিসমাপ্তি সকল সময়েই শুভান্তিক হবে এমন কোনো নির্দিষ্ট নিয়ম নেই। এতে জটিল ঘটনাবর্তের সৃষ্টি এবং বহুবিধ চরিত্র সন্নিবেশ থাকলেও সমগ্র কাব্যটিতে একটি অখণ্ড শিল্প-সংগত সৌন্দর্যবোধ ও মহত্ত্বব্যঞ্জক গাম্ভীর্য থাকবে। এর। ভাষা প্রসাদগুণসম্পন্ন, ওজস্বী এবং অনুপ্রাস-উপমা প্রভৃতি অলংকারবহুল হবে।
এ প্রসঙ্গে আরও কিছু মহকাব্যের খোঁজ নিলে বাহুল্য হবে না নিশ্চয়। প্রাচীন মহাকাব্য (পঞ্চম শতক থেকে পঞ্চদশ শতক)। সপ্তম শতক–‘তায়েন বো কোয়াইলেঞ্জ’ (প্রাচীন আইরিশ); পাণিনি প্রণীত রামায়ণ ও ‘অষ্টদেহী’ অনুসরণে সংস্কৃত ভাষায় পরিমার্জিত ‘ভট্টিকাব্য’; মহাভারত অনুসরণে সংস্কৃত ভাষায় ভারবি রচিত ‘কীরাতাজুনীয়’ ও মাঘ রচিত ‘শিশুপালবধ। অষ্টম থেকে উনবিংশ শতক–‘বিউওল্ফ’ এবং “ওয়ালদেয়ার’ (প্রাচীন ইংরেজি); ডেভিড অব সাসুন (আর্মেনিয়ান)। নবম শতক–সংস্কৃত ভাষায় রচিত ‘ভাগবত পুরাণ’। দশম শতক–শাহনামা’ (ফারসি সাহিত্য); সেন্ট গলের একেহার্ড প্রণীত ‘ওয়াথারিয়াস’ (লাতিন)। একাদশ শতক–‘তাঘরিবাত বনি হিলাল’ (আরবি সাহিত্য); জনৈক জার্মান লেখক রচিত ‘রুডলিয়েব’ (লাতিন); বাইজেনটাইন সাম্রাজ্যের বীরকে ঘিরে ‘ডাইজেনিস একরিটাস’ (গ্রিক); ‘এপিক অব কিং গেসার’ (তীব্বতীয় ভাষায়)। দ্বাদশ শতক–‘চ্যানসন ডি রোল্যান্ড’ (প্রাচীন ফরাসি); শোটা রুসট্যাভেলি প্রণীত’দ্য নাইট ইন দ্য প্যান্থার স্কিন’; ওয়াল্টার অব চাটিলন রচিত ‘আলেক্সান্দ্রিস’ (লাতিন); জোসেফ অব এক্সটার প্রণীত’ডি বেলো ট্রোইয়ানো’ ও ‘দ্য লস্ট এন্টিওচিজ’; কারম্যান ডি প্রোডিসিওন গুইনোনিস (লাতিন); জন অব হভিলে প্রণীত ‘আর্কিট্রেনিয়াস’ (লাতিন বিদ্রুপাত্মক কাব্য); পিটার অব এবোলি প্রণীত “লিবার অ্যাড অনুরেম অগাস্টি’; বাইলিনাস প্রণীত ‘দ্য টেল অব ইগোর’স ক্যাম্পেইন’ (একাদশ থকে ঊনবিংশ শতক)। ত্রয়োদশ শতক–‘নিবেলানজেনলাইড’ (জার্মান ভাষা); ওলফ্রাম ভন ইসেনব্যাচ প্রণীত ‘পার্জিভাল’ (জার্মান ভাষা); লায়ামন প্রণীত ‘ব্রুট’; অকসিটান ভাষায় রচিত ‘চ্যানসন ডি লা ক্রোইসেড আলিবিজিওইস’, ‘অন্তরা ইবনে সাদ্দাদ ও “সিরাত আল-জহির বাইবারস’ (আরবি ভাষা); ‘সান্দিয়েতা কেইতা’; ‘এল ক্যান্টার ডি মাইও সিড’ (প্রাচীন স্পেনিশ); জোহানেস ডি গারল্যাডিয়া প্রণীত ‘ডি ট্রামফিস একক্লেসিয়ে’ (লাতিন); উইলিয়াম অব রেনেস প্রণীত ‘গেস্টা রেগাম ব্রিটানিয়ে’ (লাতিন); ই সিয়াং-হাইও প্রণীত ‘জিওয়াং আংগি’ (কোরিয়ান) চতুর্দশ শতক–জন গাউয়ার রচিত ‘কনফেসিও অ্যাম্যানটিস’; জনৈক পাদ্রি রচিত ‘কার্সর মান্ডি’; দান্তে আলিগিয়েরি রচিত ‘ডিভিনা কমেডিয়া’ বা দ্য ডিভাইন কমেডি(ইতালীয় ভাষায়); পেট্রাখি রচিত ‘আফ্রিকা; জাপানিদের যুদ্ধের পৌরাণিক কাহিনিকে ঘিরে রচিত ‘দ্য টেল অব দ্য হিয়েকি’। পঞ্চদশ শতক–অ্যালিটারেটিভ মোর্তে আর্থার; ম্যাটিও মারিয়া বোয়ার্দো রচিত অরল্যান্ডো ইনামোরাতে (১৪৯৫); স্যামুয়েল বুখ; স্লোখিম বুখ; বুক অব ডিডি কোরকুট।
রামায়ণ কি ধর্মগ্রন্থ? রামায়ণ প্রাচীনকালে রচিত (প্রাচীনকাল’ মানে পণ্ডিতগণের মতে আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ১০০০ বছর আগে, অর্থাৎ আজ থেকে প্রায় ৩০০০ হাজার বছর আগে।)। প্রাচীন যুগের পুরো ইতিহাসের না হলেও অংশত আকর (ইতিহাসের অনেক উপাদান এখান থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, এই বইটির অনেক তথ্য সত্যি প্রতিপন্ন করে ঐতিহাসিকরা তত্ত্বও বানিয়ে নিয়েছেন)। যদিও এইচ জি ওয়েলস, টয়েন বি, কান, রমেশচন্দ্র দত্ত প্রমুখ বিখ্যাত ঐতিহাসিকদের ব্যাখ্যানুসারে–“কেবল ঘটনাপঞ্জী ইতিহাসই ইতিহাস নহে। সন তারিখ সহ কোনো রাজারাজড়ার কাহিনিকেই কেবলমাত্র ইতিহাস বলতে পারি না, যুগধর্মের ইতিহাস ও প্রাচীন সমাজজীবনের চিত্রপটকেও ইতিহাসের সংজ্ঞা দেওয়া যেতে পারে।” গ্রন্থটি হিন্দুদের ধর্মগ্রন্থ হিসাবে মেনে নেওয়া হয়েছে (রাম, সীতা, হনুমানের বিরোধিতা করলেই গর্দান। রামের জন্য বাবরি মসজিদ পর্যন্ত ভাঙা সম্ভব হয়)। রামায়ণ প্রথমে সংস্কৃত ভাষায় রচিত হয়। পরে তামিল এবং তারও পরে ভারত তথা বিশ্বের অন্যান্য ভাষাতেও ভাবানুবাদ হয়। অবশ্য মূল সংস্কৃত রামায়ণ অন্য ভাষায় কাহিনি সংযোজন ও বর্জন হয়ে বদলাতে থাকল। মূল সংস্কৃত ভাষায় রামায়ণ রচনা করেন বাল্মীকি নামে ঋষিকবি। বইটি রচিত হলেও লিখিত আকারে ছিল না। লিখিত না-থাকার কারণ তখনও লিপির জন্ম হয়নি। তাই মুখে মুখে মুখস্থ করেই বংশানুক্রমে কাব্যটির সংরক্ষণ চলছিল। অন্তত পণ্ডিতেরা এমনই বলেন। দুনিয়ার পণ্ডিতরাও এই ধারণাগুলিকে পরম সত্য বলে মেনেও নিয়েছেন।