প্রক্ষিপ্তকে অস্বীকার করে নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী রামের ‘ভগবান’ তত্ত্ব মেনে নিলেও, রামায়ণে যে প্রক্ষিপ্ত রচনায় গিজগিজ করছে না, এটা মানব কী করে! বাল্মীকি-পরবর্তী কবিরা যেভাবে তাঁদের রামায়ণে ‘ভগবান তত্ত্ব’ প্রতিষ্ঠা করেছেন, সেটা যে মূল রামায়ণের ক্ষেত্রেও হয়নি, একথা জোর দিয়ে বলা যায় না। প্রক্ষিপ্তকে অস্বীকার করা মানে রাম অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী ‘ভগবান’, এটা মেনে নিতেই হয়। আগেই বলেছি, বাল্মীকির আদি রচনা ‘পৌলস্ত্যবধ’, সেই রচনাখানির ঠিক কতটা বিস্তার ছিল তার আর বর্তমানে বিচার করা যায় না। তেমন কোনো বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণও নেই। তবে ‘পদ্মপুরাণ’-এর পাতালখণ্ডে রামায়ণের যে শ্লোকসংখ্যার উল্লেখ আছে, তা হল এক কোটি। কিন্তু পদ্মপুরাণের টীকাকারের মতে–এখন আর এক কোটি পাওয়া যায় না, মাত্র ২৪,০০০ পাওয়া যায়। টীকাকার মহাবিভাষা বলেন–মাত্র ১২,০০০। উত্তরকাণ্ডের রচয়িতা উত্তরকাণ্ডকে রামায়ণের সঙ্গে যুক্ত করে দিয়ে যে তাতে মোট ২৪,০০০ শ্লোক আর ৫০০ সর্গ পেয়েছিলেন, তাঁর প্রমাণ উত্তরকাণ্ডের রচয়িতাই উত্তরকাণ্ডের ১০৭ তম সর্গে উল্লেখ করেছেন। মহাভারতের হরিবংশ’-এর মতো রামায়ণের ‘উত্তরকাণ্ড সম্পূর্ণ একটি আলাদা গ্রন্থ, তা অনেক পণ্ডিতই স্বীকার করেন। “প্রাপ্তরাজ্যস্য রামস্য বাল্মীকিভগবানৃষিঃ।/চকার চরিতং কৃৎস্নং বিচিত্রপদমর্থবৎ।/চতুর্বিংশ সহস্রাণি শ্লোকানামুক্তবানৃষিঃ।/তথা সর্গ শতান্ পঞ্চ ষট্ কাণ্ডানি তথোত্তরম্।/কৃত্বাঃ তু তন্মহাপ্রাজ্ঞঃ সভবিষ্যং সহোত্তরম্।/চিন্তয়মানস্য মহর্ষের্ভাবিতাত্মনঃ। /অগৃহীতাং ততঃ পাদৌ মুনিবেশৌ কুশীলবৌ।/কুশীলবৌ তু ধৰ্ম্মজ্ঞে রাজপুত্রে যশস্বিনৌভ্রাতরে স্বরসম্পন্নৌ দদর্শাশ্রমবাসিনৌ।” কেদারনাথ মজুমদার তাঁর রামায়ণের সমাজ’ গ্রন্থে স্পষ্টতই বলেছেন–“শ্লোকাবলীর চতুর্থ পংক্তি দ্বারা মহর্ষি যে ছয় কাণ্ড রামায়ণ লিখিয়াছিলেন, উহা যেমন স্পষ্ট অবগত হওয়া যায়, ষট কাপ্তানির পরবর্তী ‘তথোত্তরম্’ শব্দটি দ্বারা উত্তরকাণ্ডটি যে জাল বা রামায়ণের পরে যোজনা, তাহাও তেমনই সুস্পষ্ট বুঝা যায়। পঞ্চম পংক্তির ‘সভবিষ্যং সহোত্তরম্’ শব্দদ্বয়ও তেমনই স্পষ্ট প্রক্ষিপ্ত।” “রামঃ সীতামনুপ্রাপ্য রাজ্যং পুনরবাবা।/পিলয়ামাস চৈবেমাঃ পিতৃবনূদিতাঃ প্রজাঃ।/অযোধ্যাপতিঃ শ্রীমান্ রামো দশরথাত্মজঃ।” মহাকবি তাঁর রামচরিত এভাবেই শেষ করেছেন। পরে আর কিছু ছিল না। লঙ্কাকাণ্ডের ১৩০ সর্গের ৯৬ শ্লোকে রামায়ণ শেষ করেছেন মহাকবি বাল্মীকি। এর পর আটটি শ্লোকে রামরাজ্যের কল্যাণকর বিবরণ এবং শেষ আঠেরোটি শ্লোকে রামায়ণ শ্রবণ (কেবল শ্রবণই, কারণ রামায়ণের যুগে মুদ্রণ ব্যবস্থা আবিষ্কার হয়নি, তাই পাঠের প্রশ্নই নেই।) করলে কেমন ফললাভ হবে সে কথাই বলা হয়েছে। বস্তুত নিয়মানুসারে গ্রন্থের পাঠ বা শ্রবণের ফল গ্রন্থের শেষেই নিবন্ধিত হয়।
প্রক্ষিপ্ত যে শুধুমাত্র রামায়ণের ক্ষেত্রেই হয়েছে, তা কিন্তু নয়। মহাভারত, বেদ, পুরাণ, ব্রাহ্মণ, সূত্র, গীতা, স্মৃতি, উপনিষদ–সর্বত্র প্রক্ষিপ্ত রচনা বাধাহীন প্রবেশ করেছে। কপিরাইট নেই, না! কৃত্তিবাস যেমন তাঁর রামায়ণে নিজের কল্পনাজাল বিছিয়েছেন, তেমন তুলসীদাসের রামচরিতমানসে বাল্মীকির ছায়া প্রায় অপসারিত। কয়েকটি উদাহরণ : তুলসীদাস রাম-সীতার পূর্বরাগের কথা বর্ণনা করেছেন, কিন্তু বাল্মীকির রামায়ণে হরধনুভঙ্গের আগে এবং বৈধ বিয়ের আগে রাম-সীতার পূর্বরাগ উল্লেখ করেননি। তুলসীদাস রাম-সীতার বিয়ে স্বয়ংবর সভায় হয়েছে বলে বর্ণনা করেছেন, বাল্মীকির রামায়ণে স্বয়ংবর ছাড়াই দুই পক্ষের অভিভাবকদের কথাবার্তার মধ্য দিয়ে রামসীতার বিবাহ সম্পন্ন হয়েছে। কৃত্তিবাসের রাম-সীতার বিয়ে আবার খুব স্বাভাবিকভাবেই বাঙালিদের মতো৷ কম্বন, কৃত্তিবাস স্বয়ংবর সভা করেই রাম-সীতার বিয়ে দিয়েছেন। বাল্মীকি-পরবর্তী রামায়ণগুলিতে স্বয়ংবর সভা সম্ভবত মহাভারতেরই প্রভাব। মহাভারতের প্রচুর স্বয়ংবর সভায় মাধ্যমে বিয়ের উল্লেখ আছে, বাল্মীকির রামায়ণে একটিও নেই। কৃত্তিবাসের রামায়ণে রাম-সীতাও বাঙালি। তাই রাম-সীতার বিয়ে বাঙালিদের মতো আয়োজন করেন।
অক্ষয়কুমার দত্ত তাঁর ‘ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায়’ গ্রন্থে যথার্থই বলেছেন–“রামায়ণে যে মধ্যে মধ্যে নূতন নূতন শ্লোক ও সর্গবিশেষ সন্নিবেশিত হইয়াছে, এটি একটি প্রসিদ্ধ প্রথা। টীকাকারেরাও তাহা স্বীকার করিয়াছেন ও অনেকানেক বচন ও কোনো কোনো সর্গ প্রক্ষিপ্ত বলিয়া অঙ্গীকার করিয়া গিয়াছেন। যেমন অরণ্য : ৫ স, ২৩; ৩১ স ৩৩ ও ৩৪; কিষ্কিন্ধ্যা : ৫৮ স, ২৪ ও ২৫; সুন্দর : ১ স, ৯৭, ৯৮; ২৪ স, ৪২; ২৭ স, ২০; ২৭ স, ৩১ ও ৩২; ৫৭ স ৯; ৫২ স, ১৮ ও ১৯ ইত্যাদি। রামচন্দ্রের অলৌকিক অথবা দেবসদৃশগুণ বর্ণনাত্মক কতকগুলি শ্লোক ও অবশিষ্ট কয়েকটি সর্গ প্রক্ষিপ্ত বলিয়া কতকাদি টীকাকার তাহার ব্যাখ্যা করেন নাই।”
রামায়ণ গ্রন্থটিকে মহাকাব্যও বলা হয়। এখন দেখব মহাকাব্য কাকে বলে? মহাকাব্য শ্ৰবকাব্যের একটি অংশবিশেষ। যে কাব্যে কোনো দেবতা বা অসাধারণ গুণসম্পন্ন পুরুষের কিংবা একবংশোদ্ভব বহু নৃপতি বা রাজা-বাদশাহর বিস্তারিত বিবরণ লিপিবদ্ধ করা হয়, তা মহাকাব্য নামে পরিচিত। যিনি মহাকাব্য রচনা করেন, তিনি মহাকবি। দেবতা বা দেবতুল্য নায়কের বৃত্তান্ত নিয়ে বিশেষ রীতিতে রচিত বৃহৎ কাব্য রচনাকেই মহাকাব্য’ বলা হয়। পাশ্চাত্য আদর্শে অনুসরণের মাধ্যমে আমরা মহাকাব্যের সংজ্ঞা নির্দেশ করতে গিয়ে বলতে পারি যে, নানা সর্গে বা পরিচ্ছেদে বিভক্ত যে কাব্যে কোনো সুমহান বিষয়বস্তুকে অবলম্বন করে এক বা বহু বীরোচিত চরিত্র অথবা অতিলৌকিক শক্তি সম্পাদিত কোনো নিয়তি-নির্ধারিত-ঘটনা ওজস্বী ছন্দে বর্ণিত হয়, তাকে মহাকাব্য বলে। মহাকাব্যে প্রাকৃতিক বিবিধ দৃশ্যমালা ও পরিবর্তন বর্ণিত থাকে এবং এতে কমপক্ষে আটটি কিংবা ততোধিক সৰ্গ বা ভাগ থাকে। যেমন–রামায়ণ, মহাভারত, ইলিয়াড, ওডিসি, গিলগামেস ইত্যাদি।