রামায়ণ তেমনই একটি গ্রন্থ, যেখানে মানুষের কাছে লজিকের চেয়ে ম্যাজিকের কদর পায়। লজিক আর ম্যাজিকের চিরন্তন দ্বন্দ্বও আছে। রামের ভক্তরা রামায়ণ’ গ্রন্থটিকে ‘ধর্মশাস্ত্র’ ভাবতেই পারেন, আমার কাছে কেবলই মহাকাব্য’, ইতিহাসের উপাদান-আধার। অনেকে মনে করেন, রামকথা বেদের যুগ থেকেই লোকের মুখে মুখেই ফিরত। পরে বাল্মীকি তাঁর প্রতিভায় রামকথা পরিমার্জিত রূপ দেন, সুচারুভাবে সংকলিত হয় অতিরিক্ত সংযোজনের প্রাবল্যে। রামকথার প্রথম বক্তা নারদ। বাল্মীকি উদগীত শ্লোকের সমর্থনদাতা ব্রহ্মা। গায়ক লব ও কুশ। শ্রোতা প্রথমে ব্রাহ্মণ ঋষিকুল। পরে অযোধ্যার জনগণ এবং সবশেষে রাজা রামচন্দ্র। প্রসঙ্গত জানাই “মা নিষাদ প্রতিষ্ঠাং ত্বমগমঃ শাশ্বতীঃ সমাঃ।/যৎ ক্রৌঞ্চমিথুনাদেকমবধীঃ কামমোহিতম৷৷”–এটাই বাল্মীকির মুখনিঃসৃত প্রথম শ্লোক বলে জেনে আসছে অনেকে। অনেকে ব্যাখ্যা করে বলেন–ব্যাধ কর্তৃক কৌঞ্চ নিহত হলে যে শোক উৎপাদন হয়, তা থেকেই নাকি শ্লোকের সৃষ্টি। না, এ জানা সঠিক নয়। শ্লোক আরও আগেই সৃষ্টি হয়ে গেছে। এই শ্লোকটি রামায়ণের প্রথম কাণ্ডের দ্বিতীয় সর্গের পঞ্চদশতম শ্লোক। রামায়ণের আদি বা প্রথম শ্লোকটি হল–“তপঃ সাধ্যায়নিরতং তপস্বী বাগ্বিদাং বরম্।/নারদং পরিপপ্রচ্ছ বাল্মীকিমুনিপুঙ্গব৷৷” বাল্মীকি রচিত রামায়ণের প্রথম পংক্তিজোড়াই যে প্রথম শ্লোক তা কিন্তু বলা যাচ্ছে না। কারণ রামায়ণের বহু আগেই বেদ রচনা হয়েছে। বেদের বহু মন্ত্রে ‘শ্লোক’ শব্দের ব্যবহার দেখতে পাওয়া যায়। বেদ থেকে একটি শ্লোক দেখুন–“মিনীহি শ্লোক মাস্যে পর্জন্য ইবততনঃ।” অতএব ক্রৌঞ্চ মিথুনের বধ থেকে শোক, শোক থেকে শ্লোক–এ মিথ ধোপে টেকে না।
নিরুক্তকারের মতে, শ্রু ধাতু থেকে উৎপন্নের কারণে শ্রবণযোগ্য যা, তাই-ই শ্লোক। কবি বাল্মীকি স্বধ্যায়সম্পন্ন বেদবিদদের অগ্রগণ্য নারদকে সম্বোধন করে এবং সম্প্রতিকালে লোকে সর্বগুণে বিভূষিত শ্রেষ্ঠ কে সম্যক জেনে রামকথা শুরু করেন। নারদের কাছ থেকে রামকথার বিস্তারিত জেনেই রামায়ণ গ্রন্থের ছয়টি কাণ্ডে (উত্তরকাণ্ড বাদে) প্রসারিত করেছেন। অতএব বাল্মীকি মহাকাব্যের স্রষ্টা বটে, কিন্তু রামকথার স্রষ্টা নন। যিনি গ্রন্থটি সংস্কারের কাজ করেছিলেন তিনি বাল্মীকির সম্পূর্ণ রামকথা বা গীত সংগ্রহ পারেননি। তিনি যা সংগ্রহ পারেননি, সেখানে তিনি নিজ কল্পনার আশ্রয় নিয়ে গ্রন্থখানি সমৃদ্ধ ও বর্ধিত করেছিলেন।
লক্ষ করার বিষয়, রামায়ণ পুথিগুলির পাঠে নানা স্থলে বিভিন্নতা দেখা যায়। শুধু তাই-ই নয়, অনেক জায়গাতেই অনেক পাঠে সাধারণ বিচারবুদ্ধিতে অসংগতিপূর্ণ মনে হয়। বোঝা যায়, বিভিন্ন সময়ের বিভিন্ন যুগের লেখকরা ‘স্বাভিপ্রায়ানুযায়ী পরিবর্তন বা সংযোজন করেছেন। এইসব সংগতিবিহীন পাঠকে বিশেষজ্ঞরা ‘প্রক্ষিপ্ত বলেন। সাহিত্যসম্রাট ঋষি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় প্রক্ষিপ্ত বিষয়ে বলেন–“(১) যদি কোনো গ্রন্থে দেখা যায় যে, কোনো ঘটনা দুই বা ততোধিক বার বিবৃত হইয়াছে, অথচ সেই বিবরণ পরস্পর বিরোধী, তাহা হইলে একটি প্রক্ষিপ্ত বিবেচনা করিতে হইবে। কারণ কোনো লেখকই অনর্থক পুনরুক্তি করিয়া আত্মবিরোধ উপস্থিত করেন না। অনাবধানতা বা অক্ষমতা প্রযুক্ত যে পুনরুক্তি বা আত্মবিরোধ উপস্থিত হয়, সে স্বতন্ত্র কথা। সেরূপ ত্রুটি অনায়াসে নির্বাচন করা যায়।(২) শ্রেষ্ঠ কবিদিগের রচনা প্রণালীতে প্রায়ই কতকগুলি বিশেষ লক্ষণ থাকে। যদি ঐরূপ রচনা কোনো শ্রেষ্ঠ কবির কোনো রচনার অংশে এরূপ দেখা যায় যে, সেই সেই লক্ষণ তাহাতে নাই; তৎপরিবর্তে এমন সকল লক্ষণ আছে যে, পূর্বোক্ত লক্ষণ সকলের সঙ্গে সংগতি রক্ষিত হয় না, তবে সেই অসংগত লক্ষণযুক্ত রচনাকে প্রক্ষিপ্ত বিবেচনা করিবার কারণ উপস্থিত হয়। (৩) যদি কোনো শ্লোকে এমন শব্দ প্রযুক্ত থাকে, যে শব্দের মূলীভূত বস্তুর উল্লেখ ঐ গ্রন্থে বা উহার সমসাময়িক গ্রন্থে দৃষ্ট হয় না, তাহা হইলে ঐ শব্দ প্রক্ষিপ্ত বলিয়া সন্দেহ হইবে। (৪) যদি শ্লোকাদিতে গ্রন্থকর্তার সমকালীন পরিজ্ঞাত ও বিশ্বসিত বস্তু অথবা ভাবের অতিরিক্ত কোনো বস্তুর বা ভাবের বর্ণনা বা অভিব্যক্তি দেখা যায়। তবে সেই বস্তু ও ভাবকে প্রক্ষিপ্ত বলিয়া সন্দেহ করিবার বিষয় হইবে। (৫) শ্রেষ্ঠ কবিদিগের বর্ণিত চরিত্রগুলির সর্বাংশ পরস্পর সুসংগত হয়। যদি কোথাও তাহার ব্যতিক্রম দেখা যায়, সে অংশ প্রক্ষিপ্ত বলিয়া সন্দেহ করা যাইতে পারে। (৬) যাহা অপ্রাসঙ্গিক তাহা প্রক্ষিপ্ত হইলেও হইতে পারে, নাও হইতে পারে। কিন্তু অপ্রাসঙ্গিক বিষয়ে যদি পূর্বোক্ত লক্ষণগুলির মধ্যে কোনো লক্ষণ পাওয়া যায়, তবে তাহা প্রক্ষিপ্ত বলিয়া বিবেচনা করিবার কারণ হইবে। (৭) যাহা অনৈতিহাসিক, অথবা অস্বাভাবিক তাহা প্রক্ষিপ্ত হউক বা না হউক, ইতিহাসের আলোচনায় তাহা পরিত্যাগ করা উচিত। তাহা বুঝিবার উপায় সমসাময়িক ইতিহাস, ভাব ও সমাজ৷”
নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ীর প্রক্ষিপ্ত ব্যাপারে কিছুটা ভিন্ন মত। তিনি লিখেছেন–“অনেক অগ্র-পশ্চাৎ বিবেচনা করে বাল্মীকি রামায়ণের অগ্র এবং পশ্চাৎ অর্থাৎ আদিকাণ্ড এবং উত্তরকাণ্ড ঘেঁটে ফেলা হয়েছে। এর সবচেয়ে বড়ো কারণ হল–রামকে যে একেবারে ভগবান বিষ্ণুর অবতার করে ফেলা হয়েছে তা নাকি প্রধানত এই কাণ্ড দুটিতেই। অযোধ্যাকাণ্ড থেকে লঙ্কাকাণ্ড পর্যন্ত রামের এই ভগবদ্ উপাধি জোটেনি। ব্যাপারটা প্রথম বোধহয় পণ্ডিতদের মাথায় ঢুকিয়েছিলেন হারমান জ্যাকোবি।” তাঁর মতে–“রামের দেবায়ন এবং ক্রমশঃ বিষ্ণুর সঙ্গে একাত্মতা–এই পুরো বাপারটাই ছিল সেই কবির হৃদয়ে যিনি রামায়ণের আদি এবং উত্তরকাণ্ডটি লিখেছিলেন। মূল কাণ্ডপঞ্চকে দেবায়নী ভূমিকা নেই কোনো, বরঞ্চ তিনি সেখানে অনেক মানুষোচিত।” মূল কাণ্ড-পঞ্চকের কতগুলি শ্লোকে এবং আদিকাণ্ড তথা উত্তরকাণ্ডে তো বটেই, যেখানেই রামকে ভগবানের মর্যাদা দেওয়া হয়েছে সেই অংশটাই প্রক্ষিপ্ত। এই নিরিখে এমন কথা অবশ্যই বলা যায় যে, পণ্ডিতেরা যদি তাঁদের প্রতিপাদ্য সম্বন্ধে পূর্বাহ্নেই সংকল্পিত থাকেন তাহলে তাঁদের যুক্তিও সেই মতেই চলবে এবং সত্যি কথা বলতে কি, তাই চলেছে। যেখানেই পণ্ডিতদের অসুবিধে হয়েছে সেখানেই শ্লোকের পর শ্লোক বাদ পড়ে গেছে। কনটেকস’ মিলছে না, অন্যরকম, শ্লোক বাদ দিয়ে দাও; অবতারবাদ আছে–সব বাদ দাও।… পণ্ডিতদের কথা শুনে বাল এবং উত্তরকাণ্ডের অলংকৃত শৈলীর নিরিখে মূল কাণ্ড-পঞ্চকের অলংকার দুষ্ট অংশগুলি আমরা পরিত্যাগ করব, নাকি পাঁচ কাণ্ডের স্থল বিশেষ অলংকৃত শৈলীর নিরিখে বাল কিংবা উত্তরকাণ্ডের অংশগুলিও আমরা গ্রহণ করব। আমার ধারণা–গ্রহণ করাই ভালো, কেননা তাতে মহাকাব্যশরীরের হানি হয় না। তা ছাড়া কবি কোথায় অলংকৃত ভাষা ব্যবহার করবেন, কোথায় করবেন না, কোথায় তিনি বড়ো বড়ো সমাসবদ্ধ পদ ব্যবহার করবেন এবং কোথায় লঘু সমাস, কোথায় উপমার মালা তৈরি করবেন, কোথায় রূপক–এসব তো আর তিনি ভবিষ্যৎ ভাষাতাত্ত্বিকের গবেষণায় ফমূলা বুঝে করবেন না।”