আগেই বলেছি আমার রাম বাল্মীকির রাম। কৃত্তিবাস বা তুলসীদাসের রাম নয়। তাই যাঁরা ভাবছেন এই গ্রন্থ পাঠ করলে পুণ্যার্জন হবে, পরিষ্কার বলে রাখি তাঁরা হতাশ হবেন। এ গ্রন্থ শুধুমাত্র যুক্তিবাদী পাঠকদের জন্য যুক্তিবাদীর উপস্থাপনা। এই গ্রন্থ শুধুমাত্র যাঁরা মহর্ষি বাল্মীকি ও তাঁর রামকে বুঝতে আগ্রহী তাঁদের জন্য। আর-একটা কথা যেটা বলা উচিত, সেটা হল আমি গ্রন্থটি বাল্মীকির রামায়ণের ভাষাগত ও কাঠামোগত বিশ্লেষণ করিনি। তা করতেও এই গ্রন্থের অবতারণা নয়। এই গ্রন্থটি পাঠ করে কোনো পাঠকের যদি মনে হয় এটি বামপন্থী ও বিজেপি-বিরোধী মানসিকতার ফসল, সেটা ভেবে নিলে ভুল হবে বলব। কারণ আমি কোনো রাজনৈতিক মতাদর্শে বিশ্বাসী বা অবিশ্বাসী নই। আমি নিজস্ব মতাদর্শেই আস্থা রাখি। সেই আস্থার ভিত্তিভূমিতে দাঁড়িয়েই প্রতিষ্ঠা করেছি আমার মত। একজন প্রাবন্ধিক হিসাবে প্রাবন্ধিকের মতই যে প্রকাশ হবে সেটাই স্বাভাবিক। সেই মতে কেউ সহমত হবেন, কেউ হবেন না। সকলেই লেখকের বক্তব্যের সঙ্গে সহমত হবেন, এমন প্রত্যাশা কোনো লেখক করেন বলে আমার জানা নেই। অনেক পাঠক বলতে পারেন, রামায়ণের তো বহু সংস্করণ আছে। সেই প্রতিটি সংস্করণে প্রতিফলিত হয়েছে স্থানীয় ইতিহাস, ভূগোল, সমাজ, ধর্মীয় আচার, জীবনযাত্রা ইত্যাদির ভিত্তিতে। সেগুলো যদি বিশ্লেষণ করে রামায়ণী কথার মাধ্যমে দক্ষিণ ও পূর্ব এশিয়ার জাতিগত ইতিহাসের উপর আলোকপাত করতেন, তাহলে ভালো হত। হ্যাঁ, অবশ্যই ভালো হত। কিন্তু এই গ্রন্থে সেই পরিসর নেই। পৃথক একটি গ্রন্থে এ বিষয়ে আলোকপাত করা যেতে পারে।
পরিশেষে জানাই, আমি পণ্ডিত নই। বরং পণ্ডিতগণের আলোয় আমি আলোকিত–এভাবেই নির্ণায়ক। আমার এ লেখা পাঠ করে যদি কোনো পাঠকের মনে হয় তাঁর অনেকদিনের আজন্ম লালিত বিশ্বাসে নাড়া লেগে গেছে, তাহলে তাঁর কাছে আমার বিনম্র নিবেদন রাখি–এ রচনায় সম্পূর্ণভাবে ইতিহাস, ভূগোল, বিজ্ঞান এবং হেমচন্দ্র ভট্টাচার্য অনূদিত রামায়ণ থেকেই আমার রসদ আহরিত হয়েছে। এই গ্রন্থে কোথাও এমন অক্ষর এমন শব্দ এমন বাক্য উল্লেখ হয়নি, যার ফলে ভক্ত-পাঠকগণের বিশ্বাসে আঘাত লাগতে পারে। এমন কোনো বর্ণনা করা হয়নি, যা কোনো বাল্মীকির রামায়ণে উল্লেখ নেই। তা সত্ত্বেও যদি কোনো পাঠকের হৃদয়ে ন্যূনতম রক্তক্ষরণ হয়, তা আমার অনিচ্ছাকৃত–উদ্দেশ্যপ্রণোদিত নয়। কোনো বিশ্বাস ও কল্পনার আশ্রয়ে এ গ্রন্থ গড়ে ওঠেনি। প্রতিটি চরিত্র আলাদা আলাদাভাবে ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ করেছি। এতে চরিত্রগুলিকে অনুধাবন করতে সুবিধা হবে বলে আমার বিশ্বাস। যতটা পেরেছি যুক্তি দিয়ে আলোচনা করেছি। যুক্তির সুরে তার বেঁধেছি, ভক্তির সুরে নয়। আমি অলৌকিকত্ব, ভগবত্তার ভক্তিরসে কলম ডোবাতে পারিনি–এটা যদি আমার ব্যর্থতা বলেন, তাহলে এ ব্যর্থতা স্বীকার করে নিতে দ্বিধা নেই।
সেইসব গ্রন্থ, যেখান থেকে প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করেছি, সেইসব গ্রন্থ, লেখক ও প্রকাশকদের কাছে আমি চিরঋণী। সবসময় সেইসব সূত্র উল্লেখ করা সম্ভব না-হলেও যতটুকু পেরেছি উল্লেখ করার চেষ্টা করেছি। অভিনন্দন জানানোর ভাষা নেই তাঁকে, যিনি এই গ্রন্থের প্রকাশক সেই Exceller Books-এর অঞ্জিতা গাঙ্গুলিকে। অঞ্জিতা আগ্রহী না-হলে আমার এই গ্রন্থখানি আপনাদের মতো বিদগ্ধ পাঠকদের কাছে পৌঁছোত কি না, সে বিষয়ে আমার সন্দেহ ছিল। এছাড়া যে শুভানুধ্যায়ীরা আমাকে অন্তরাল থেকে এ গ্রন্থ রচনায় সাহস জুগিয়েছেন, প্ররোচিত করেছেন, তাঁদের ধন্যবাদ দিয়ে ছোটো করার ধৃষ্টতা আমার আছে বলে মনে করি। শেষ কথা, আমার এ লেখা যদি বিদগ্ধ পাঠকমহলে সমাদৃত হয়, বিন্দুমাত্র চিন্তার খোরাক সরবরাহ করতে সক্ষম হয়, তাহলেই আমার দীর্ঘদিনের ঘাম ঝরানো সার্থক হবে।
–অনির্বাণ বন্দ্যোপাধ্যায়
সহায়ক গ্রন্থ ও পত্রপত্রিকা : (১) মনুসংহিতা–সুরেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, (২) বাল্মীকি রামায়ণ–পঞ্চানন তর্করত্ন সম্পাদিত (৩) কৃত্তিবাস ওঝার রামায়ণ, (৪) চন্দ্রাবতীর রামায়ণ (৫) বিষ্ণুপুরী রামায়ণ–শঙ্কর কবিচন্দ্র (৬) বাল্মীকির রাম ও রামায়ণ–নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী, (৭) রামায়ণ ও মহাভারত : নব সমীক্ষা–শ্ৰীমনোনীত সেন, (৮) বাল্মীকির রাম ফিরে দেখা–সুকুমারী ভট্টাচার্য, (৯) প্রাচীন ভারত : সমাজ ও সাহিত্য–সুকুমারী ভট্টাচার্য, (১০) তুলনামূলক আলোচনায় রামায়ণ ও মহাভারত–ড. বিবেকানন্দ মুখোপাধ্যায়, (১১) বাংলা সাহিত্য ও বাঙ্গালীর জাতীয় জীবনে রামায়ণ–লেখক অজ্ঞাত (১২) বাল্মীকি রামায়ণে রাম আদিবাসী রামায়ণে রাম–বিপ্লব মাজী, (১৩) রামায়ণের উৎস কৃষি–জিতেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, (১৪) রামায়ণের প্রকৃত কথা–শ্রীসতীশচন্দ্র দে, (১৫) রামায়ণের সমাজ–কেদারনাথ মজুমদার, (১৬) রামায়ণ ভোলা চোখে–হরপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় (১৭) বাল্মীকির জয়–হরপ্রসাদ শাস্ত্রী (১৮) ভারতবর্ষের ইতিহাস–রোমিলা থাপার (১৯) ভারতের নৃতাত্ত্বিক পরিচয়–অতুল সুর (২১) রামায়ণ : মিথ অর রিয়ালিটি–হাসমুখ ধীরাজলাল সানকালিয়া (২২) সহজিয়া রামায়ণ–মাহবুব লীলেন (২৩) বর্তমান (শারদ সংখ্যা ১৪১৫), পৃষ্ঠা ৬৪ (২৪) খাসতদন্ত (দ্বিতীয় বর্ষ/দ্বিতীয় সংখ্যা) (২৫) সাপ্তাহিক বর্তমান (১২ মার্চ, ২০১৬) (২৬) রামায়ণী কথা–দীনেশচন্দ্র সেন (২৭) বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা (অষ্টম ও নবম খণ্ড)(২৮) রামায়ণে রাক্ষস সভ্যতা–স্বামী বিবেকানন্দ (২৯) অশোকবনে সীতা–জনৈকা দুঃখিনী স্ত্রীলোক (৩০) রামলক্ষ্মণ–গোবিন্দচন্দ্র রায় (৩১) রামবিলাপ–নগেন্দ্রনারায়ণ অধিকারী (৩২) সীতাচরিত্র–কৃষ্ণেন্দ্র রায় (৩৩) ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায়–অক্ষয়কুমার দত্ত (৩৪) প্রাচীন ভারতের ইতিহাস (প্রথম খণ্ড)–সুনীল চট্টোপাধ্যায় (৩৫) হেলেন সীতা দ্রৌপদী–শেখর সেনগুপ্ত (৩৬) স্বর্গলোক ও দেবসভ্যতা–শ্রীরাজ্যেশ্বর মিত্র (৩৭) পৌরাণিক অভিধান–সুধীরচন্দ্র সরকার (৩৮) রামায়ণ-মহাভারতের দেব-গন্ধর্বরা কি ভিনগ্রহবাসী?–নিরঞ্জন সিংহ (৩৯) চরিত্রে রামায়ণ মহাভারত–শিপ্রা দত্ত (৪০) মেগাস্থিনিসের ভারতবিবরণ–সম্পাদনায় বারিদবরণ ঘোষ (৪১) হিন্দুদের দেবদেবী উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ–হংসনারায়ণ ভট্টাচার্য (৪২) রামায়ণ প্রসঙ্গে–লেখক অজ্ঞাত (৪৩) রামায়ণ সারসংগ্রহ–শ্রীকুশদেব পাল (৪৪) রামায়ণে দেবশিবির–বীরেন্দ্র মিত্র (৪৫) রামচরিতমানস–তুলসীদাস (৪৬) হিউয়েন সাঙের দেখা ভারত–প্রেমময় দাশগুপ্ত (৪৭) আলবেরুনীর দেখা ভারত–প্রেমময় দাশগুপ্ত (৪৮) ইবন বতুতার দেখা ভারত–প্রেমময় দাশগুপ্ত (৪৯) তিব্বতী পরিব্রাজকদের দেখা ভারত–প্রেমময় দাশগুপ্ত। (৫০) দ্বীপময় ভারত–সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়। (৫১) ভারতবর্ষ (প্রথম বর্ষ, প্রথম সংখ্যা) (৫২) অনালোকিত অতীত ইতিহাসে ভারতীয় মূলনিবাসীরা ও তাদের ধর্ম ভাবনা (যুদ্ধঃ আর্য বনাম আর্য, দাস ও দস্যু)–মণিমোহন বৈরাগী। (৫৩) দানিকেন প্রমাণ–অজিত দত্ত অনূদিত, (৫৪) রামায়ণ–মহেন্দ্রনাথ দত্ত অনূদিত।
গোড়ার কথা : ইতিহাস ও ধর্মকথার দ্বন্দ্ব
রামায়ণ, মহাভারত এবং পুরাণগুলি পাঠ করলে দেখা করা যায়, একই ঘটনা বিভিন্ন রূপে ভিন্ন ভাবনায় বর্ণিত হয়েছে। এমনকি একই গ্রন্থে এক অধ্যায় একরকম অন্য অধ্যায়ে অন্যরকম বর্ণনা করা হয়েছে। এটা থেকে এমন অনুমান করা অন্যায় হবে না যে, গ্রন্থগুলি একাধিকবার বিভিন্ন লেখকের লেখনী দ্বারা ভিন্ন ভিন্ন চিন্তা ও দর্শনে যুগধর্মের উপযোগী করে কখনো সম্পাদিত ও কখনো পরিবর্তিত হয়েছে। সুযোগ-সুবিধা বুঝে, স্বার্থ রক্ষার্থে এবং বিপদ বুঝে যেভাবে সংবিধান সংশোধন হয়। এ ব্যাপারে সমস্ত ঐতিহাসিকই একমত। যেহেতু গ্রন্থগুলি বেদের অনুগত, তাই এগুলি ধর্মগ্রন্থেরও পর্যবসিত হয়েছে। সনাতন ধর্ম মায় হিন্দুধর্মের সকলেরই এইসব গ্রন্থের প্রতি অচলা ভক্তি প্রদর্শন ও অটল বিশ্বাস অব্যাহত। শাস্ত্রকারদের গা-জোয়ারি, অর্বাচীন কবিদের বানোয়াট, সত্য লুকোনোর প্রয়াস এবং মিথ্যাচারের প্লাবন–এই তিন স্পর্শ মানুষের মনকে শত শত বছর ধরে স্থবির করে রেখেছে। শাস্ত্রে উল্লিখিত বিভিন্ন ঘটনার বিবরণ বিভিন্ন মধ্যে যথাযথ যুক্তি নির্ণয়ে বিমুখ হয়ে তারই অপরাপর অলৌকিক বিবরণগুলির মানুষের মনকে আকৃষ্ট করে এবং নির্বিচারে তা গ্রহণ করতে প্রলুব্ধ করে। এতটাই প্রলুব্ধ করে যে, বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যাও শুনতে চায় না। কানে আঙ্গুল দেন। যেসব পণ্ডিতগণ শাস্ত্রবচন উদ্ধৃত করে মাহাত্ম-কীর্তন পঞ্চমুখে বিতরণ করেন, তাঁরাই আবার শাস্ত্রসম্মত সত্যভাষণ মনঃপুত না-হলে অগ্নিশর্মা হয়ে তেড়ে আসেন, অসহিষ্ণু হয়ে হাতে অস্ত্র তুলে নিতেও দ্বিধান্বিত হন না। লজিক নয়, ম্যাজিকের প্রতিই তাঁদের অগাধ আস্থা।