তর্কের শেষ নেই। এক পণ্ডিত যা বলেন, অন্য পণ্ডিত তা প্রত্যাখ্যান করেন। মূল রামায়ণের থেকেও প্রাদেশিক রামায়ণ এবং তার কবিই হয়ে উঠেছে প্রিয়তম। মূল সংস্কৃত ভাষায় রচিত রামায়ণের খোঁজ কেই-বা রেখেছেন। বাঙালিজীবনে যেমন রামায়ণ বলতে কৃত্তিবাসের প্রভাব, তেমনই হিন্দিবলয়ে তুলসীদাস। অনুরূপ কাশ্মীরে দিবাকর ভট্টের রামায়ণ বা দাক্ষিণাত্যের প্রদেশগুলিতে কম্বনের রামায়ণ অথবা রঙ্গনাথনের রামায়ণ। আছে ভিল রামায়ণ, মোল্লা রামায়ণ এবং দুরন্ত রামায়ণও। ওডিশা, নেপাল, তিব্বত, থাইল্যান্ড, আসাম–প্রত্যেকের একটি করে নিজস্ব রামায়ণ আছে। সেসব রামায়ণ কখনো চমৎকার, কখনো অদ্ভুত, কখনো-বা অর্থহীন–তবুও মান্য।
বেদ, পুরাণ, রামায়ণ, মহাভারত, কোরান, বাইবেল ইত্যাদি সারা পৃথিবীর শাস্ত্র তথা কিংবদন্তীগুলি নতুন নতুন ব্যাখ্যায় আমাদের সামনে হাজির হচ্ছে, জানতে পাচ্ছি নবতম তথ্য। চোখের ঠুলি আস্তে আস্তে সরে যাচ্ছে খোলা চোখের বিশ্লেষণে। কেউ বলেন রামায়ণ ধর্মগ্রন্থ, কেউ বলেন মহাকাব্য, কেউ বলেন ইতিহাস।
বাল্মীকির রাম কোনো দেবতা নন, দৈত্যদানবও নন৷ বাল্মীকির রামায়ণের রাম সুখে-দুঃখে কাতর মর্তমানব। তিনি মানৰশ্রেষ্ঠ, নরচন্দ্রমা। বাল্মীকির তাঁর কাহিনি বর্ণনার মধ্য দিয়ে মানবজীবনের ও মানবগৃহধর্মের বিজয়বার্তা ঘোষণা করেছেন। রামায়ণ গৃহাশ্রমের কাব্য। যাঁরা কথায় কথায় কারও ভাবাবেগে বা বিশ্বাসে আঘাত করা ঠিক নয় বলেন, তাদেরকে বলি–কোপারনিকাস, ব্রুনো, গ্যলিলিও প্রমুখরা খ্রিস্টান ভাবাবেগকে আঘাত দিয়েছিলেন, বলেছিলেন পৃথিবীর চারদিকে সূর্য ঘোরে না, সূর্যের চারদিকেই পৃথিবী ঘোরে। বিদ্যাসাগর, বিবেকানন্দ, রামমোহন প্রমুখ পূজনীয় ব্যক্তিগণ বহু লোকের ভাবাবেগকে আঘাত দিয়ে সমুদ্রপার করেছিলেন। বিদ্যাসাগর ও রামমোহন প্রমুখ তো বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ, সতীদাহ, বিধবাবিবাহের বিরুদ্ধে গর্জে উঠে অসংখ্য মানুষের শতাব্দী প্রাচীন বিশ্বাসকে ভেঙে দিয়েছিলেন। এক শ্রেণির দুষ্কৃতিরা বাবর-ই-মসজিদ ভেঙে, বামিয়ানে বুদ্ধমূর্তি ভেঙে আর-এক শ্রেণির মানুষের বিশ্বাসে কুঠারাঘাত করেছেন। যাঁরা বাইবেল পোড়ায়, যাঁরা বেদ পোড়ায়, যাঁরা কোরান পোড়ায়–তাঁরা কারা? তাঁরা অন্যের ভাবাবেগে বা বিশ্বাসে আঘাত করেন না? লেখকরা কাতোর বিশ্বাসে আঘাত করে না, আঘাত করার জন্যেও লেখেন না–এটা একটা চাপিয়ে দেওয়া অভিযোগ, মূলত ব্যক্তিগত আক্রোশকেই চরিতার্থ করেন। যাঁরা করেন তাঁরা লেখক পদবাচ্যই নয়। লেখক কেবল প্রচলিত মিথ ভাঙে, মিথ ভেঙে সত্যের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেন পাঠককে। সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকেই লেখক সাধারণ পাঠকদের চিনিয়ে দেয় মিথ্যাসংস্কৃতির ধারক ও বাহকদের। সত্যটা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিলে কারো-না-কারো বিশ্বাসে আঘাত লাগে। লেখক সত্যসন্ধানী। আমি যাকে জন্ম থেকে বিশ্বাস করে এসেছি যে ব্যক্তিটি আমার বাবা, পরে জানতে পারলাম তিনি আমার বাবা নন, আমি তাঁর ঔরসজাত নই, তিনি কেবলই আমার মায়ের স্বামী–এটাও কি বিশ্বাসে বা ভাবাবেগে আঘাত নয়? আঘাত হলেও, এ সত্য সন্তানকে জানাতেই হবে। সত্য উন্মোচনের মাধ্যমে এই আঘাত না-দিলে সমাজ বর্বর তথা অন্ধকার যুগেই স্থির হয়ে থাকত, প্রগতি বলে কিছু থাকত না। তাই প্রগতির স্বার্থে এ বিশ্বাসে আঘাত দেওয়াও আবশ্যক হয়ে পড়ে। কী বিশ্বাস করবেন, কী বিশ্বাস করবেন না–তা নির্ভর করে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির শিক্ষার উপর। যেমন ধরুন–নারদ বাল্মীকিকে যে রাম-কথা শুনিয়েছিলেন (বালকাণ্ড, প্রথম সর্গ), সেই রামকথা রামের রাজ্যলাভেই ইতি হয়েছে। এরপর ১১,০০০ বছর রাজত্ব করার পর রাম ব্রহ্মলোকে গমন করবেন এবং রাজত্বকালে রাম শত সংখ্যক অশ্বমেধ যজ্ঞ, বর্ণাশ্রম প্রতিষ্ঠা ও ব্রাহ্মণদিগকে প্রচুর সংখ্যক গো ও পর্যাপ্ত ধনাদি দান করবেন–নারদ ভবিষ্যত্বাণী করেছিলেন মাত্র। কিন্তু নারদের ভবিষ্যৎবাণীতে সীতার বনবাস, শক্রম্নর যৌবরাজ্যে অভিষেক, লবকুশের জন্ম, রামের অশ্বমেধ যজ্ঞে পিতাপুরে মিলন, সীতার পাতাল প্রবেশ, কুশকে কোশলের সিংহাসনে অধিষ্ঠিত করা, রামের পরিশেষে লক্ষ্মণকে বর্জন এবং ভরত ও শত্রুঘ্ন সহ সরযূ নদীতে আত্মবিসর্জন–এইসব তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনাবলির কোনো উল্লেখ নাই। ভেবে দেখতে বলি।
‘গঙ্গার মতো তীর্থ নেই, মায়ের মতো গুরু নেই, বিষ্ণুর মতো দেবতা নেই আর রামায়ণের মতো শ্রেষ্ঠ কিছু নেই”–পুরাণের আপ্তবাক্যটির ততদিন গ্রহণযোগ্যতা থাকবে, যতদিন ভারত থাকবে, যতদিন ভারতের নদনদী প্রবাহিত হবে, যতদিন ভারতের পর্বতমালা উত্তুঙ্গ মহিমায় বিরাজ, যতদিন সুপ্রাচীন আরণ্যক সভ্যতার মূল মর্মকথাটি অনুপ্রাণিতহতে থাকবে মানুষের হৃদয়ে। জাতিধর্মনির্বিশেষ রামায়ণ থাকবে অপ্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবেই। আদি বাল্মীকির রামায়ণ থেকে আধুনিক চন্দ্রাবতীর রামায়ণ পর্যন্ত–সবই আপামর মানুষ বুকে করে রেখেছে। রামায়ণ কেবলমাত্র হিন্দুদেরই সম্পদ নয়–সব ধর্মাবলম্বীদের কাছেই আগ্রহের বিষয়। বস্তুত আমাদের প্রধানত রাষ্ট্র-পরিবর্তনের ইতিহাস। কোন রাজার কোন্ রাজার শাসনকাল শুরু এবং শেষ হল তারই ‘অধসত্য’ বিবরণের পুনর্মূল্যায়ণই আমাদের ইতিহাস রচনার কাজ, যা রাষ্ট্রবিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান ও নৃতত্ত্ববিজ্ঞান দিয়ে বুঝতে হবে। রাজার ইতিহাস ষড়যন্ত্রের ইতিহাস। নানারকম কূট ষড়যন্ত্র, দুরভিসন্ধি, প্রতিহিংসা, রাজনৈতিক দাবাখেলার ভিতর দিয়েই রাজাদের উত্থান-পতন রচিত হয়। রামায়ণের কাহিনিও তার ব্যতিক্রম নয়।