সাম্প্রতিককালে অমীশ ত্রিপাঠি নামে একজন ‘বেস্ট সেলার’ লেখক ‘সীতা : মিথিলার যোদ্ধা’, মেহুলার মৃত্যুঞ্জয়ীগণ’, ‘বায়ুপুত্রদের শপথ’, ‘নাগরহস্য’, ‘ইক্ষ্বাকু কুলতিলক’ প্রভৃতি কয়েকখানি গ্রন্থ লিখেছেন পৌরাণিক তথা এপিক কাহিনির আধারে। লেখক সমস্ত ঘটনা কাল্পনিক বলে ঘোষণা দিলেও বিশ্বাসী ভক্তরা যে বর্ণিত ঘটনাগুলি সত্যি বলে মেনে নেবেন না, এমন গ্যারান্টি দেওয়া যাবে না।
বর্তমান ভারতে প্রায় সর্বত্রই ‘রাম রাম’ ধ্বনি শোনা যাচ্ছে। কে এই রাম? এই রাম বাল্মীকির মানুষ রাম নয়, এ রাম গোস্বামী তুলসীদাসের ‘ভগবান রাম। ব্রাহ্মণ্যধর্মের চেনা সমাজব্যবস্থার ছাঁচটা আদি শঙ্করাচার্যের সময় থেকে প্রয় ৩০০/৪০০ বছর ধরে নিষ্প্রাণতার শিকার হয়েছিল। এই নিষ্প্রাণতা থেকে উদ্ধারের জন্য যে প্রয়াস নেওয়া হয়েছিল অনেকের মধ্যে তুলসীদাসই অগ্রগণ্য। তাই তুলসীদাসে রাম ব্রাহ্মণ্যবাদের চাহিদা পূরণ করেছেন। বাল্মীকির রাম ঈশ্বরপ্রতিম কোনো অধিনায়ক নন। মহৎ, কিন্তু রজোগুণসম্পন্ন একজন মানুষের যা কিছু দোষগুণ থাকে, বাল্মীকির রামের সবই আছে। কিন্তু তুলসীদাসের রাম ‘পুরুষোত্তম’, যিনি মানুষরূপে বিষ্ণুর অবতার। তাঁর সবকিছুই উত্তম, শ্রেষ্ঠ। তাঁর কোনো দোষই থাকতে পারে না। খণ্ডিত রাজপুরুষ রামের চরিত্রটির প্রেক্ষিতই পালটে দিলেন। হিন্দি আগ্রাসনের ফলে আজকের ভারতীয় সমাজব্যবস্থা স্থাপিত হয়েছে তুলসীদাস সৃষ্ট রামভাবনার উপর। আজ ভারত যে রামকে চেনেন তিনি তুলসীদাসে রাম, বাল্মীকির রাম নয়–বিশেষ করে গোবলয়ে।
রামচরিতমানসও কিন্তু বাল্মীকি রামায়ণের অবিকল ‘অনুবাদ’ নয়। কাহিনিসূত্র অনুসরণ করা হয়েছে, কিন্তু নানা ভিন্ন মাত্রা আছে। রামায়ণ নিয়ে তুলসীদাসের নিজস্ব উদ্দেশ্য ছিল, তা হল ব্রাহ্মণ্যবাদের পুনঃপ্রতিষ্ঠা। তিনি সেগুলিকে প্রতিষ্ঠা করেছেন একেবারে ভূমিগত মানুষের ভাষা ও মানসিকতার নিরিখে। ব্রাহ্মণ্যবাদ, ভক্তিবাদ, দারিদ্র্য, অবমাননা ইত্যাদি নানা আপাতভাবে পরস্পর বিরোধী উপাদান দিয়ে তিনি বিপুল সংখ্যক মানুষের জন্য গড়ে তুলেছিলেন একটা নতুন মূল্যবোধ, যার শিকড় অনেক গভীরে প্রোথিত হয়ে আছে। কৃত্তিবাসেরও ব্রাহ্মণ্যবাদের চাপ ছিল, তবে তা ন্যূনতম। কিন্তু তুলসীদাসের ভক্তিযুদ্ধটা ছিল সম্পূর্ণ রাজনৈতিক। একেশ্বরবাদী শাসকের আর্থ-নীতিগত বলপ্রয়োগের প্রতিষেধক হিসাবে রাম চরিত্রটির স্বভাবে শক্তি সঞ্চার করার দায় ছিল তাঁর। তবে তা ছিল ভক্তিবাদী মানসিকতার আধারে। কৃত্তিবাসকে এই দায়টির বোঝা বইতে হয়নি।
আমার রাম বাল্মীকির রাম। অন্য কোনো রাম নয়। না কৃত্তিবাসের রাম, না তুলসীদাসের রাম। এ গ্রন্থটি আমি বিশেষজ্ঞ গবেষকদের জন্য লিখিনি। যাঁরা ভাবছেন এই গ্রন্থ পাঠ করলে প্রভূত পুণ্যার্জন হবে, এ গ্রন্থ তাঁদের জন্যেও লিখিনি এ গ্রন্থ কেবলমাত্র যুক্তিনির্ভর সাধারণ পাঠকদের জন্য লেখার চেষ্টা করেছি।এ গ্রন্থ কেবল তাদেরই জন্য লিখেছি, যাঁরা মহর্ষি বাল্মীকি এবং বাল্মীকির রামকে বুঝতে চান, মান্য করেন।
১৯০০ খ্রিস্টাব্দে ৩১ জানুয়ারি ক্যালিফোর্নিয়ার অন্তর্গত প্যাসাডেনায় ‘শেক্সপিয়র সভায়’ প্রদত্ত বক্তৃতায় স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন–“রামায়ণের কবির নাম মহর্ষি বাল্মীকি। পরবর্তীকালে অপরের রচিত অনেক আখ্যানমূলক কবিতা, ওই প্রাচীন কবি বাল্মিকির পরিচিত নামের সহিত জড়িত হইয়াছে। শেষে এমন দেখা যায় যে, অনেক শ্লোক বা কবিতা তাঁহার রচিত না হইলেও সেগুলি তাঁহারই বলিয়া মনে করা একটা প্রথা হইয়া দাঁড়াইয়াছিল। এই সকল প্রক্ষিপ্ত অংশ থাকিলেও আমার এখন উহা যে আকারে পাইতেছি, তাহাও অতি সুন্দরভাবে গ্রথিত, জগতের সাহিত্যে উহার তুলনা নাই।”
মোট কথা, রামায়ণ লোকমুখে গীত হওয়ার জন্যই রচিত হয়েছিল, যা কুশীলব তথা গায়কগণ কর্তৃক গীত হিসাবে প্রচারিত হয়েছিল, তাই এটা গীতিকাব্যও। বাল্মীকি এই গ্রন্থের কোনো নামকরণ করেননি। রামায়ণ’ বাল্মীকি কর্তৃক দেয় শিরোনাম নয়। তবে কে বা কারা এই গ্রন্থের নাম ‘রামায়ণ’ রেখেছিলেন, সে বিষয়ে কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। বাল্মীকির রামকথার নাম ‘পৌলস্ত্যবধ কাব্য’–“কাব্যং রামায়ণং কৃৎস্নং সীতায়াশ্চরিতং মহৎ।/পৌলস্তবধ ইত্যেবং চকার চরিত ব্ৰতঃ”–অর্থাৎ রামায়ণ গীতিকাব্যের রচয়িতা মহামুনি বাল্মীকি। পুরাণ মতে পুলস্ত মুনির বংশধর বলে রাবণের পর নাম পৌলস্ত্য। তিনি পৌলস্ত বধ নামে রাম ও সীতার চরিত সংবলিত কাব্য রচনা করেছিলেন এবং সেটি রামায়ণ নামে পরিচিত হয়েছিল। একথা রামায়ণের প্রথম সংগ্রহকারকের লিখিত মুখবন্ধ থেকেই জানা যায়। রামায়ণের রচয়িতা হিসাবে মহাকবি বাল্মীকির পরিচয় তাঁর রচিত এই কাব্যে কোথাও পাওয়া যায়নি। ভাগবতকার বাল্মীকিকে আদি কবি বলে স্বীকার করেননি। তিনি ব্রহ্মাকে আদি কবি বলে অভিহিত করেছেন–“তেনে ব্ৰহ্মহৃদায় আদি কবয়ে”। তবে আদি কবি হিসাবে ব্রহ্মা কোনো গ্রন্থ বা কাব্য লিখেছিলেন কি না তার কোনো উল্লেখ কোনো গ্রন্থে পাওয়া যায় না। তা ছাড়া বেদ ও উপনিষদ ছাড়া রামায়ণের আগে রচিত হয়েছে এমন কোনো গ্রন্থ এখনও পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। অবশ্য পাওয়া যায়নি বলে রামায়ণই আদি কাব্য, তাও হলফ করে বলা যায় না। তবে একেবারে প্রথম খ্রিস্টাব্দের কৰি অশ্বঘোষ তাঁর ‘বুদ্ধচরিত’ লিখেছেন, চ্যবনমুনিই রামায়ণ রচনা আরম্ভ করেছিলেন, কিন্তু রামায়ণটি শেষ করা সম্ভব হয়নি। বাল্মীকির পৌলস্ত্যবধ কাব্যের নায়ক-নায়িকা-খলনায়ক-শত্রু-মিত্র সকলেই ছিলেন রক্তমাংসের নিখাদ মানুষ। কালে কালে বহু কবি হাত ধরে রাম যতই অবতারের দিকে উন্নীত হন ততই তাঁর মিত্ররা নখ-লেজ-লোমওয়ালা জন্তুজানোয়ার হতে থাকে। অপরদিকে শত্রুরা রাক্ষস-খোক্ষস-ভূতভূতুমের রূপকথায় পরিণত হয়ে যায়। রামায়ণে সকল চরিত্রই কোনো-না-কোনোভাবে দেবতা, বিপুল অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী–তাঁরা হয়কে নয়, নয়কে হয় করতে দক্ষ। একজন বাদে, তিনি হলেন সীতা–জন্মের ঠিক নেই এমন এক কন্যার কোনো অলৌকিক ক্ষমতা নেই, এক অসহায় মানবী। মূলত এগারো/বারো শতক নাগাদ তামিল কবি কম্বনের (কম্বন রামায়ণ’ নামে পরিচিত) কল্পনায় রামচন্দ্র অর্ধদেবত্ব লাভ করেছেন। এরপর মোলো শতকে এসে তুলসীদাসের (‘রামচরিতমানস’ নামে পরিচিত) কল্পনায় রামচন্দ্র পূর্ণদেবত্ব তথা ভগবানত্ব প্রাপ্ত হয়েছেন। এতটাই ভগবানত্ব প্রাপ্ত হয়েছেন যে, গো-বলয়ে একে-অপরের সঙ্গে সাক্ষাৎ হলে ‘রাম রাম’ বলে সম্ভাষণ করে থাকেন। এতটাই ভগবানত্ব প্রাপ্ত হয়েছেন যে, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী স্বাধ্বী নিরাঞ্জন অবলীলায় বলে ফেলতে পারেন–“আপনারা দিল্লিতে রামজাদের সরকার চান, নাকি হারামজাদের সরকার চান?” স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও তাঁকে কঠোর ভাষায় ভর্ৎসনা করেন। অবশেষে তুমূল চাপে পড়ে বাধ্য হয়ে তিনি সংসদে ক্ষমা প্রার্থনা করে বলেছেন–“ভারতে ‘রামজাদে’ বলতে সব ভারতবাসীকেই বোঝায়। কারণ এদেশে হিন্দুরা তো বটেই, খ্রিস্টান মুসলিমরাও রামেরই সন্তান।”