অতএব নদীমৃত্যুই সভ্যতা পরিত্যাগের কারণ। কারণ নদীঘিরেই মানুষের সভ্যতা। সভ্যতার কারণেই নদীকে কাটিয়ে আনা হয়েছিল উত্তর থেকে দক্ষিণে, যা ভাগিরথী বা গঙ্গা বা হুগলি নদী বলে পরিচিত। নদীকে কেন্দ্র করে নগর গড়ে ওঠে এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধি ঘটতে থাকে। উৎপাদন হ্রাসের সঙ্গে জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে খাদ্যচাহিদা খুব চরম পর্যায়ে পৌঁছে যায়। এরকম অবস্থায় নগরগুলি পরিত্যাগ করে বিভিন্নদিকে ছড়িয়ে পড়া ছাড়া অন্য কোনো উপায় থাকে না। শুধু সিন্ধুনগরই নয়, নানা কারণে এরকম বহু নগরই পরিত্যক্ত হয়ে আছে, আজও। দু-একটা নমুনা দিই–(১) জাপানের গানাকানজিমা দ্বীপ। এই দ্বীপের আসল নাম হাসিমা দ্বীপ। কিন্তু এই দ্বীপকে গানাকানজিমা নামে ডাকা হয় যার অর্থ হল ‘রণতরী দ্বীপ’। বিশ্বের ৫০৫ টি জনমানবহীন দ্বীপের মধ্য জাপানের গানাকানজিমা দ্বীপ অন্যতম। এটি নাগাসাকি থেকে মাত্র ১৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। ১৮১০ সালে প্রথম এই দ্বীপে কয়লা পাওয়া যায় এবং পরবর্তী ৫০ বছরের মধ্যে গানাকানজিমা দ্বীপ হয়ে উঠে বিশ্বের সব চেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ দ্বীপ। ১৯৫৯ সালে ১৬ একর আয়তনের দ্বীপটির জনসংখ্যা পৌঁছোয় ৫৩০০ জনে। তবে ১৯৭৪ সালের দিকে কয়লা ও অন্যান্য জীবাশ্ম কমতে থাকে এবং মানুষ ধীরে ধীরে এই দ্বীপ ছেড়ে চলে যেতে থাকে এবং দ্বীপটি এক সময় জনমানব শূন্য হয়ে পড়ে। দ্বীপটি এখনও পরিত্যক্ত। (২) নামিবিয়ার কোলমানসকোপ ঘোস্ট টাউন। এই শহর দক্ষিণ নামিবিয়ার লুদেরিটজ সমুদ্রবন্দর থেকে মাত্র ১০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। ১৯০৮ সালে এখানে হিরে পাওয়া যায়। সেই কারণে মাত্র দুই বছরের মধ্যে এই গ্রামীণ এলাকাটি জাঁকজমকপূর্ণ দৃষ্টান্তমূলক জার্মান শহরে রূপান্তরিত হয়। গ্রাম থেকে শহর–অতি দ্রুত এমন একটা শহর, যেখানে ছিল ক্যাসিনো, স্কুল, হাসপাতাল, স্টেডিয়াম, বিলাসবহুল আবাসিক ভবন। খুব স্বাভাবিকভাবেই সকলে এই হিরের উৎস সম্পর্কে উচ্চ সমৃদ্ধি ও দীর্ঘায়ু আশা করেছিল। কিন্তু হায়! অতি দ্রুতই হিরের উৎস হ্রাস পেতে থাকে এবং মানুষ এই শহর ত্যাগ করে এদিক-ওদিক চলে যেতে শুরু করে। জল আর বালুঝড়ের সমস্যার জন্যও মানুষ এই শহর পরিত্যাগ করে। ১৯৫৪ সালের মধ্যে শহরটি সম্পূর্ণভাবে পরিত্যক্ত হয়ে যায়। (৩) ইউক্রেনের রাইপিয়াট। রাইপিয়াট হল উত্তর ইউক্রেনের একটি পরিত্যক্ত শহর, যাকে বলা হয় ‘জোন অব এলিয়েন’। পরিত্যক্ত শহরটি চেরনোবিল পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে দুই মাইল দূরে অবস্থিত। ১৯৮৬ সালে চেরনোবিল পারমাণবিক প্ল্যান্টের দুর্যোগের পর শহরটি পরিত্যক্ত হয়। এই শহরটিকে দেখলে পারমাণবিক শক্তির ভয়ংকর ক্ষমতার চিত্রই ফুটে ওঠে।
ঋগ্বেদের বহু ঋকেই যে যুদ্ধের বিবরণ পাই সে যুদ্ধ খুব বড়ো ধরনের যুদ্ধ যে নয় তা সহজেই বোঝা যায়। অনেক ঐতিহাসিকগণ এগুলিকে যুদ্ধ না-বলে সংঘর্ষ বলতেই পছন্দ করেন। তথাকথিত ‘যুদ্ধবিধ্বস্ত’ পরিত্যক্ত সভ্যতাটিতে তেমন কোনো যুদ্ধাস্ত্র পাওয়া যায়নি। সিন্ধু সভ্যতাটি একটি সাম্যবাদী সভ্যতা ছিল যেখানে যুদ্ধ বিগ্রহবিমুখ একটি সভ্যতাই বিকাশ লাভ করেছিল। পূর্বের ইতিহাসবিদরা অনেকে আবার এই যুদ্ধকে আর্য এবং অনার্যদের যুদ্ধ বলে চিহ্নিত করেছেন। এই যুদ্ধকে বৈদিক ও অবৈদিক সম্প্রদায়ের যুদ্ধও বলা যেতে পারে। এই যুদ্ধে বৈদিক সম্প্রদায়রা বা আর্যদেবতারাই যে জয়যুক্ত হন, তা বেদ-রামায়ণ-মহাভারত-পুরাণগুলি পাঠ করলেই অনুধাবন হয়। এর জন্য পণ্ডিত হতে হয় না। যাঁরা চোখ বন্ধ করে থাকতে ভালোবাসেন তাঁরা অন্ধকার ছাড়া অন্য কিছু দেখবেন এটা আশা করা বিজ্ঞানভিত্তিক হয় না। যাই হোক, সম্ভবত অবৈদিক সম্প্রদায়ের যে অংশ বৈদিক সম্প্রদায়ের ধর্মসংস্কারকে মেনে নিতে পারেনি তাঁরাই দেশত্যাগ করেছিল এবং তাঁদেরই একাংশ ইরানে আবাস গড়ে।
ভারতে উপমহাদেশে দুটি মহাগ্রন্থে দুটি বিশাল মহাযুদ্ধের কথা উল্লেখ হয়েছে। একটি রাম-রাবণের ‘লঙ্কাযুদ্ধ’ বলে খ্যাত, অন্যটি কৌরব-পাণ্ডবের ‘কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ’ বলে খ্যাত। রাম-রাবণের ‘লঙ্কাযুদ্ধ’ তো দুটি যুযুধান গোষ্ঠীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল, মহাভারতের যুদ্ধ রীতিমতো বিশ্বযুদ্ধ–এ যুদ্ধেও ছিল মিত্রপক্ষ এবং শত্রুপক্ষ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আমরা যেভাবে মিত্রশক্তি এবং অক্ষশক্তিদের পাই। সত্যিই কি রামায়ণেও আমরা রাম-রাবণের যুদ্ধটি বিশাল-বৃহৎ ছিল? এ যুদ্ধ রাম-বিরাধের দণ্ডকারণ্য যুদ্ধ হয়ে কাহিনি থেমে যাওয়ার একটা সুযোগ ছিল, কিন্তু তা হয়নি।
ছোটোখাটো যে-কোনো যুদ্ধই কালে কালে পরিবর্তিত হতে হতে শেষপর্যন্ত রামায়ণ নামক এক বিশাল মহাকাব্যে লিপিবদ্ধ হয়। এরকম কোনো ছোটখাট ঘটনাই মানুষের মুখে মুখে পরিবর্তিত হতে হতে মিথে রূপান্তরিত হয়। কবিরা সবসময়ই কোনো ঘটনাকে ব্যাখ্যা করতে রূপকের আশ্রয় নেন। কেবল প্রাচীনকালেই নয়, সবকালেই। কালের পরিবর্তনে তাঁদের মস্তিষ্কপ্রসূত রূপক আর রূপকথাগুলিই বাস্তবতার দাবি করতে থাকে। কবির কল্পনায় বিকশিত চরিত্র ও রূপকের সঙ্গে মিথের মিশ্রণ এবং আমাদের সমাজের ধর্মান্ধতা এ দুটি গ্রন্থকে আজ দিয়েছে ধর্মগ্রন্থের মর্যাদা। তবুও মিথকে সত্য না-ভেবে একে বাস্তবতার আলোকে ঐতিহাসিক উপাদান হিসাবে বিচার করা উচিত। নিছক গল্পকথা ভেবে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করলে ইতিহাসের প্রতি অবিচার করা হবে। তবে মেনে নেওয়ার কাজ যতটা আয়েশে করা সম্ভব, মিথ ভেঙে সত্য উঘাটন করার কাজটা তত সহজ কাজ নয়। রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণ সমুদায় হল রাজা ও রাজত্ব, রাজ্যজয় ও গণহত্যার ইতিবৃত্ত। সেভাবেই পাঠগ্রহণ নিরাপদ। রামায়ণের গর্ভ থেকে রূপকথাগুলিকে ঠেলে সরিয়ে দিতে পারলেই প্রাচীন ইতিবৃত্ত হাতের মুঠোয় চলে আসবে।