প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর প্রতিটি জনসভায় রাম মন্দিরের কথা সযত্নে এড়িয়ে গেলেও বারাণসীতে রামরাজ্যের কথা শোনা গেল প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির গলায়। উন্নয়নের কথা বলতে গিয়ে তিনি ‘রামরাজ্য’ প্রসঙ্গ তোলেন। তাঁর সাফ কথা, মানুষই একদিন এই রাজ্যে ‘রামরাজ্য’ প্রতিষ্ঠা করবে। তাঁর বক্তব্যকে তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করেছিলেন বিভিন্ন রাজনৈতিক মহল। ‘রামরাজ্য’ বানাতে চান উমা ভারতীও। তুলসীদাসের রামচরিতমানসে রামচন্দ্রের যে ছবি আঁকা হয়েছে, সেই রামচন্দ্রই উত্তরপ্রদেশ ছাড়িয়ে সমগ্র গো-বলয়ে চরম জনপ্রিয়তার তুঙ্গে। তুলসীদাসই তাঁর রামায়ণে রামরাজ্যের মহিমা কীর্তন করে অনেক চৌপদী গেয়েছেন। ধনিক-বণিকদের হিতার্থে পরিচালিত শাসনব্যবস্থাকে রামরাজ্য আখ্যা দিয়ে করপাত্রী মহারাজও খুব প্রচার করেছেন। করপাত্রী মহারাজের রামরাজ্য ধর্ম-নিয়ন্ত্রিত।
রাহুল সাংকৃত্যায়নের রামরাজ্যের ধারণা সামান্য উল্লেখ করি–“সেই ধর্ম অনুসারে যদি কোনো শূদ্র বেদ শুনে ফেলে, তাহলে তার কানে গলন্ত সিসা ঢেলে দিতে হবে। আর কেউ যদি বেদ উচ্চারণ করে, তাহলে সেই বেদ উচ্চারণকারী শূদ্রের জিভ কেটে ফেলতে হবে।” প্রাচীন বস্তুবাদীরা বলতেন–“ভণ্ড, ধূর্ত এবং নিশাচরেরাই কেল তিন বেদের কর্তৃত্ব মেনে চলে। (ত্রয়ো বেদস্য কর্তারো ভণ্ড-ধূর্ত-নিশাচরাঃ)” করপাত্র মহারাজের রামরাজ্য এরকম–“রামরাজ্যবাদী জড় এবং চেতন উভয়কেই আধ্যাত্মিকভাবে সমন্বিত করে। তেমনভাবেই রাজতন্ত্র প্রজাতন্ত্র, ব্যক্তি-সমষ্টি, বিত্ত-বিভেদ এবং শ্রম-বিভেদেরও সমন্বয় সাধন করে। এভাবে অধ্যাত্মবাদের উপরে প্রতিষ্ঠিত, আরম্ভ থেকে অন্ত পর্যন্ত ধর্ম নিয়ন্ত্রিত, ধর্ম সাপেক্ষ, পক্ষপাতহীন শাসনতন্ত্রই সর্বোচ্চ মানব কল্যাণকারী এবং এই ব্যবস্থাই প্রগতির চরমতম সীমা৷”
আবার রাহল সাংকৃত্যায়নের কাছে যাই–“দক্ষিণ ভারত প্রাচীন রামরাজ্যের বড়ো সমর্থক। ছুৎমার্গের বিচারে তারা উত্তর ভারতের লোকের কান কাটে। বড়ো বড়ো বৈদান্তিক, মীমাংসক, বৈদিক প্রভৃতির জন্ম হয়েছে এখানকার ব্রাহ্মণকুলে। আজও এখানে লোকে হাজারে হাজারে ভগিনী-কন্যাকে অর্থাৎ ভাগ্নীকে বিয়ে করে, তাদের গর্ভে সন্তানের জন্ম দেয় এবং ধর্ম, দেশাচার পরম্পরা এই প্রথাকে সমর্থন করে। যদি বিশ্বাস না-হয়, মহারাজ স্বয়ং সেখানে গিয়ে চক্ষুকর্ণের বিবাদভঞ্জন করে আসতে পারেন।”
কিন্তু সে না-হয় হল একটা রামরাজ্য, কিন্তু রাম ছাড়া রামরাজ্য কীভাবে সম্ভব! রামচন্দ্রকে কোথায় পাওয়া যাবে? আচ্ছা, স্বয়ং রামচন্দ্রই যদি আসেন ভারতের শাসনকার্যের দায়িত্ব নিয়ে, তবে কেমন হবে সেই শাসন? রাহুল সাংকৃত্যায়ন মনে করিয়ে দেন–“আজকাল হাজার নয় লাখো লাখো তথাকথিত শূদ্র তপস্যা করে ব্রাহ্মণের কান কাটছে, বলার কেউ নেই। এক শম্বুকের তপস্যায় ব্রাহ্মণের পুত্রের মৃত্যু হল। রাজা রামের কাছে অভিযোগ গেল। রাজা রাম কিন্তু শম্বুককে তপস্যায় বিরত হতে বললেন না, তিনি শম্বুকের মুণ্ডুটাকেই ধড় থেকে আলাদা করে দিলেন। করপাত্রী মহারাজের আকাঙিক্ষত রামরাজ্যে এরকম রাজারই প্রয়োজন।”
না, রাহুল সাংকৃত্যায়নের মতো আমি নৈরাশ্যবাদী নয়। রামরাজত্বকে শুধুমাত্র শূদ্ৰহত্যা দিয়ে বিচার করলেই হবে না–সত্যনিষ্ঠা, পাতিব্রতা, পত্নীপ্রেম, সৌভ্রাত্র, প্রভুভক্তি, আশ্রিতরক্ষা, প্রজানুকূল্য, পিতৃভক্তি, ভরতের ভ্ৰাতৃভক্তি, দাদার প্রতি আনুগত্য, বিমাতা কৈকেয়ীর সপত্নী পুত্রের প্রতি আচরণ, সন্তান স্নেহকাতরা জননী কৌশল্যার মাতৃহৃদয়ের বেদনা, রামের প্রতি দশরথের অন্ধস্নেহ, স্ত্রীর জন্য হাহাকার এসবও নিশ্চয় ভারতের নাগরিকগণ আয়ত্ত করবেন। আর সাম্রাজ্যবাদীর আগ্রাসন তো আমাদের শাসকদের রক্তেই আছে। অবশ্যই সেই ত্রেতা যুগ ফিরে আসবে কী, যে যুগে মূর্তিপুজোর প্রচলন ছিল না? ভারতীয়রা নিশ্চয় আর মূর্তিপুজো করবেন না। মিসাইল, গ্রেনেড, বোফর্স কামান, অ্যাটম বোমা ছেড়ে নিশ্চয়ই তীর-ধনুকে ফিরে যাবেন। বলা, অতিবলা, ধর্মচক্র, কালচক্র, বিষ্ণুচক্র, ইন্দ্রচক্র, ব্রহ্মশির, ঐষিক, ব্রহ্মাস্ত্র (এই নামে অবশ্য আধুনিক ভারতে ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি করা হয়েছে।), ধর্মপাশ, কালপাশ, বরুণ পাশ, শুষ্ক অশনি, আর্দ্র অশনি, পৈনাক, নারায়ণ, শিখর, বায়ব্য হয়শির, ক্রৌঞ্জ, কঙ্কাল, মুষল, কপাল, শক্তি, খড়গ, গদা, শূল, বজ্র, কিঙ্কিণী, নন্দন, মোহন, প্রস্বাপন, প্রশমণ, বর্ষণ, শোষণ, সন্তাপন, বিলাপন, মাদন, মানব, তামস, সৌমন, সংবর্ত–এসব অস্ত্র কোথায় পাবেন এযুগের রামচন্দ্র। নিশ্চয় দেবতারাই দেবেন!
অনেকে বলেন সিন্ধু সভ্যতা ধ্বংস হয়েছে। কীভাবে ধ্বংস হয়েছে সে ব্যাপারে বহুমত। ধ্বংস হয়েছে, না পরিত্যক্ত হয়েছে? পরিত্যক্ত কেন হল? এমন হতে পারে, সেচব্যবস্থা ধ্বংসের পর কৃষি উৎপাদন হ্রাস পেতে শুরু করে এবং নদীগুলির গতিপথ পরিবর্তনসহ কিছু নদী ও খালের মৃত্যু এ অঞ্চলে ক্রমাগত মরুকরণ শুরু হয় যা কৃষি উৎপাদনকে চরমভাবে ব্যাহত করে। মনে রাখতে হবে ওই সমসাময়িককালেই সরস্বতী নদী ভ্যানিশ হয়েছিল। সরস্বতী নদীর উৎপত্তিস্থল হিমালয়ের সিমুর পর্বতে। এখান থেকে পাঞ্জাবের আম্বালা জেলার আদবদ্রী নামক স্থানে সমভূমিতে অবতরণ করেছিল। যে প্রস্রবন থেকে এই নদীর উৎপত্তি হয়েছিল তা ছিল প্লক্ষাবৃক্ষের কাছে, তাই একে বলা হত প্লাবতরণ। সে যুগে গঙ্গা-যমুনা ছিল অপ্রধান নদী। সরস্বতীই ছিল সর্বপ্রধান ও সর্বাপেক্ষা প্রয়োজনীয় নদী। সেই নদী মহাভারতের যুগেই রাজপুতনার মরূভূমিতে অদৃশ্য হয়ে গেলেও কয়েকটি স্রোতধারা অবশিষ্ট ছিল। এই স্রোতধারা চমসোদ্ভেদ, শিবোদ্ভেদ ও নাগোদ্ভেদ নামে পরিচিত। রাজস্থানের মরূভূমির বালির মধ্যে চলুর গ্রামের কাছে সরস্বতী শুষ্ক হয়ে হারিয়ে যায়। ভারতের বর্তমান উদয়পুর, মেওয়াড় ও রাজপুতনার পশ্চিম প্রান্তে মরূ অঞ্চলে সিরসা অতিক্রম করে ভুটানের মরূভূমিতে সরস্বতীর বিলোপ স্থানই বিনশন নাম প্রাপ্ত হন।