এখানেই শেষ নয়, রাম-রাজত্বে কখনও অকালমৃত্যু ঘটবে না। কোথাও কোনো স্থানে পিতা তাঁর পুত্রের মৃত্যু দেখে দুঃখকষ্ট পাবেন না। অর্থাৎ রামশাসিত রাজ্যে কোথাও কারও পুত্রশোক থাকবে না। কারণ শ্রীরামচন্দ্র হলেন নিষ্পাপ মহাপুণ্যবান রাজা। সব রমণী স্বামীর প্রতি একান্ত অনুরক্ত থাকবেন। পতিই তাঁদের ধ্যান ও জ্ঞান হবে। তাঁরা ব্যভিচারিণী হয়ে কখনও পরপুরুষে আসক্ত হবেন না। তাঁরা কখনও বৈধব্য যন্ত্রণা ভোগ করবে না। সকল নারী রাম-রাজত্বে সতীসাধ্বী পতিব্রতা হয়ে দিনযাপন করবেন। “ন পুত্রমরণং কোচিৎ দ্রক্ষ্যন্তি পুরুষা ক্কচিৎ।/নাশ্চাবিধবা নিত্যং ভবিষ্যন্তি পতিব্রতাঃ তথা”(বালকাণ্ডম–প্রথম সর্গ, শ্লোক-৯১)। রামশাসিত রাজ্য আধিদৈবিক সন্তাপমুক্ত করতে হবে। তাঁর রাজ্য অগ্নি, বায়ু এবং জলে কখনও বিপন্ন হবে না। কোনো প্রাণী বা কোনো ব্যক্তি অগ্ন্যুৎপাত, বন্যার জলোচ্ছাসে অথবা প্রবল ঝঞ্ঝায় কখনও পীড়িত হবে না। “ন চাগ্নিজন ভয়ং কিঞ্চিন্নাসু মজ্জন্তি জন্তবঃ।/ন বাতজং ভয়ং কিঞ্চিন্নাপি জ্বরকৃতং তথা”(বালকাণ্ডম–প্রথম সর্গ, শ্লোক-৯২)। রাজা, দস্যু, তস্কর, হিংস্র প্রাণী প্রভৃতির হাত থেকে রক্ষা পাবে। তাঁর রাজত্বকালে রাজ্যের কোথাও কোনো প্রাণী অনাহারে কষ্ট পাবে না। কারও ক্ষুধা-তৃষ্ণার ভয় থাকবে না। দেশ, জনপদ, নগরগুলি ধনধান্যে এমনই সমৃদ্ধ থাকবে যে লোকে চুরি করার প্রয়োজনই বোধ করবে না। ফলে চোর বা তস্কর, ডাকাতের ভয় থাকবে না। “তন চাপি ক্ষুদভয়ং তত্র ন তস্করভয়ং তথা।/নগরাণি রাষ্ট্রাণি ধনধান্যযুতানি চ তথা”(বালকাণ্ডম–প্রথম সর্গ, শ্লোক-৯৩)। ত্রিতাপমুক্ত সর্বসাধারণ পরিশুদ্ধ সত্যযুগের মতোই ত্রেতাযুগেও রাম-রাজত্বে চূড়ান্ত আনন্দে দিনযাপন করবে–“নিতং প্রমুদিতাঃ সর্বে যথা কৃতযুগে তথা”।
নারদের কথন কেবল কথার কথা, অলীক কল্পনা। ভেবে দেখুন, নারদ বলছেন–রামের রাজত্বে কোনো নারী বিধবা হন না, রামের রাজত্বে কোনো শিশুর মৃত্যু হয় না, কোনো মানুষের রোগশোক হয় না, মানুষ এহেন রাজত্বে প্রমসুখে গণ্ডায় গণ্ডায় পুত্র জন্ম দিয়ে যাচ্ছে। রামরাজত্বে সবাই সহস্ৰজীবী। চোরডাকাত নেই। মানে জরামৃত্যুহীন এক কল্পনার রাজত্ব। আসলে বাস্তবে এমন কিছু ঘটেইনি। ঘটতে পারে না। জন্ম-মৃত্যু জীবনের ধর্ম, নিয়ম। এ নিয়ম কখনোই স্তব্ধ হতে পারে না, হয়ওনি। যৌক্তিকও নয়, প্রলাপমাত্র। মূলত রামরাজত্বে প্রজারা কেমন ছিলেন, সে ব্যাপারে রামায়ণে কোনো যথার্থ চিত্র মেলে না। প্রকৃত ঘটনা, রাম-লক্ষ্মণ-ভরত প্রমুখ সরযূ নদীতে আত্মঘাতী হলে অযোধ্যা জনশূন্য হয়ে পড়েছিল।
এরপর কত যুগ কেটে গেল। রামায়ণের যুগের পর মহাভারতের যুগ, বৌদ্ধযুগ, দীর্ঘ ৮০০ বছরের মুসলিম যুগ, প্রায় ২০০ বছরের ব্রিটিশ যুগ সবই তো অতীত হয়ে গেল, রাম-রাজত্ব কোথায় গেল! নাকি সবটাই রাম রাজত্বের মধ্য দিয়েই যাচ্ছি, এখনও সেই রাম-রাজত্বটাই চলছে। রামায়ণের রাজ্যটা ঠিক কেমন তার একটা রূপরেখা তো দেওয়া গেল। রামায়ণে ‘রাজত্ব’ বলতে যা পাই, তা হল–(১) দশরথের রাজত্বের বর্ণনায়, (২) গ্রন্থখানি লেখার আগে নারদ কর্তৃক বাল্মিকীকে রামচন্দ্রের ব্যাপারে যেটুকু রূপরেখা দিয়েছিলেন। বাল্মীকির “রামায়ণম”- এ মহর্ষি নারদ বলছেন–“দশবর্ষসহস্রাণি দশবর্ষশতানি চ।/রামো রাজ্যমুপাসিত্বা ব্রহ্মলোকং গমিষ্যতি তথা”(বালকাণ্ডম–প্রথম সর্গ, শ্লোক-৯৭)। অর্থাৎ, রামচন্দ্র এগারো হাজার বছর ধর্মবোধের সঙ্গে রাজত্ব করে ব্রহ্মলোকে প্রয়াণ করবেন। তাহলে হিসাবমতো রামচন্দ্র এখনও রাজত্ব চালাচ্ছেন। এ কেমন রাম-রাজত্ব চলছে? অবশ্য ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্টের পূর্বেই ব্রিটিশ শাসনের অবসান হয়েছে। এরপর ব্রিটিশমুক্ত স্বাধীন ভারতে এ পর্যন্ত ১৮টি শাসক বা প্রধানমন্ত্রীর আবির্ভাব লক্ষ করেছি। রাম বা রামের মতো কোনো শাসককে পেলুম কী! কেমন হবে রাম-রাজত্বের আধুনিক রূপরেখা?
‘রামরাজ্য’ শব্দটির মধ্যে বর্তমানে অনেকে সাম্প্রদায়িকতার গন্ধ খুঁজে পেলেও প্রকৃতপক্ষে শান্তিময় পৃথিবীর সমার্থক হিসাবেই ভারতীয় উপমহাদেশের সর্বত্র এ শব্দটি বাগধারা হিসাবে মানুষের মুখে মুখে উচ্চারিত হয়। তবে এ শব্দটি সবচেয়ে বেশি শুনতে পাওয়া যায় ভারতের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের বক্তৃতায় এমন কি নির্বাচনী ইশতেহারেও। তারা অনেকেই একবিংশ শতাব্দীতে ভারতকে রামরাজ্যে পরিণত করতে প্রতিশ্রুতি দিয়ে থাকেন। দেন না কেবল কেমন হবে রাম-রাজত্ব, তার ধারণা। সনাতন ধর্মবিশ্বাসমতে কলিযুগের শেষে আরেকবার সত্যযুগের আবির্ভাব হওয়ার কথা। অনেক ভারতীয় জ্যোতিষ ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন যে, সে সময় অত্যাসন্ন। সে যাই হোক, মোদ্দা কথা হচ্ছে ১০ হাজার বছর পরও রামরাজত্বের মতো একটি শান্তিময় রাষ্ট্রব্যবস্থা মানুষের কাছে অতি আকাঙ্ক্ষিত বস্তু। শান্তিময় রাষ্ট্র’ মানে তো জনশূন্য অযোধ্যা, চলতি কথায় যাকে ‘শ্মশান-শান্তি’। বাল্মীকিও সেই সত্য আড়াল করেননি।
মহাত্মা গান্ধী ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের সময় ঘোষণা দিয়েছিলেন যে, দেশ স্বাধীন হলে ভারতে ‘রামরাজত্ব’ ফিরে আসবে। যখনই তিনি তার স্বপ্নের আদর্শ রাষ্ট্র সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হতেন, তিনি রামরাজ্যের কথা বলতেন। রামরাজ্যের শ্লোগানের মাধ্যমে গান্ধীজি বোঝাতে চেয়েছিলেন এমন একটি রাষ্ট্র যেখানে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ থাকবে না, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত থাকবে, মানুষে মানুষে কোনো বৈষম্য থাকবে না, কেউ কোনো কাজের কৃতিত্ব দাবি করবে না, সর্বত্র আত্মত্যাগের চর্চা হবে। রামরাজ্যের যেন কোনো অপব্যাখ্যা না-করতে পারে বা একে কেবল হিন্দু সাম্প্রদায়িক শ্লোগান হিসাবে মনে না করা হয়, এজন্য গান্ধীজি নিজেই এর ব্যাখ্যা প্রদান করেন তার লেখায় এবং বক্তব্যে–বলাই বাহুল্য, সোনার পাথরবাটি। গান্ধীজি এও বলেছিলেন, “কেউ যেন ভুলবশত মনে না-করেন যে রামরাজ্য মানে হিন্দুর শাসন। আমার কাছে রাম হচ্ছে আল্লাহ বা ঈশ্বরের অপর নাম। আমি প্রকৃতপক্ষে চাই খোদার শাসন, যা পৃথিবীর বুকে আল্লাহর রাজত্বেরই সমার্থক।”