পণ্ডিত শুভাশিস চিরকল্যাণ পাত্র মনে করেন–“রামায়ণের কাহিনি আসলে ভারতের মানুষের মুক্তিসংগ্রামের কথা। রামায়ণে আছে দেশের রাজনৈতিক পরিবর্তনের কথা, মৌলবাদী প্রাচীন শাসককে তার ক্ষমতার কেন্দ্র (লঙ্কা) থেকে বের করে রামরাজত্ব প্রতিষ্ঠার কাহিনি। এখানে রামরাজত্ব মানে বড়ো রাজত্ব বুঝতে হবে যে রাজত্বে লক্ষ্মীপুঁজির বিকাশ হয়েছিল এবং প্রজারা আরামে ছিল। লঙ্কা মানে শ্রীলঙ্কা দেশ নয় বরং রাক্ষসের রমণস্থান’ (রাক্ষস মানে দুষ্ট শাসক/ যে জনগণের সম্পদ রক্ষা করার নামে ভক্ষণ করে) তথা দেশের তৎকালীন শাসনকেন্দ্র। নিম্নবর্ণের মানুষ যেমন চণ্ডাল, শবর প্রভৃতিরাও রামরাজত্বে সম্মান পেয়েছিল। বাল্মীকিরা ছিলেন এই পরিবর্তনের হোতা। সবাই জানেন কয়েক বছর মাত্র আগে বাঙালি কবি ও বিদ্বজনেরাও শ্লোগান তুলেছিলেন ‘পরিবর্তন চাই’। তারপর আমাদের রাজ্যে রাজনৈতিক পালাবদল ঘটেছিল। তেমনিভাবে বাল্মীকিরা রামায়ণ রচনা করার পর এই দেশে রামরাজত্ব এসেছিল বলে ভাবা যায়। কবিরা শুধু বসে বসে কবিতা লেখেন না, তাঁরা যে সমাজপরিবর্তনের কারিগর হতে পারেন সে কথা বলাই বাহুল্য। বাল্মীকিরা রামায়ণ লিখে ব্রাহ্মণ্যবাদী শাসনের অবসান ঘোষণা করেন। তারপর আসে বৌদ্ধযুগ। বৌদ্ধযুগে বর্ণভেদের তীব্রতা হ্রাস পায়। রামচন্দ্রকে আমরা চণ্ডালের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে এবং তার বাড়ি গিয়ে খাবার খেতে দেখি। নিম্নবর্ণের শবর প্রভৃতিদেরও তিনি বন্ধুরূপে চিত্রিত। শম্বুক হত্যা একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা এবং কেবলমাত্র তাই দিয়ে রামচন্দ্রের বিচার করা চলে না। হতে পারে এই ঘটনা রামায়ণে প্রক্ষিপ্ত অথবা বেদবাদীদের চাপে এই কাহিনি রামায়ণে ঢুকানো হয়েছিল।”
এক রামায়ণ, অনেক দৃষ্টিভঙ্গি, অনেক অভিমুখ। যদিও খুব কম সংখ্যক মানুষ বাল্মীকির রামায়ণ পাঠ করেছেন। বেশিরভাগ ভাগ মানুষ অতিরঞ্জিত আঞ্চলিক ভাষার রামায়ণ পাঠ করে রাম ও রামায়ণ বিষয়ে জ্ঞানধারণ করেন। তবে একটা বড়ো অংশের মানুষ রামায়ণ পাঠ করা তো দূরের কথা, রামায়ণ ছুঁয়ে দেখারও উৎসাহ বোধ করেননি। এরকম মিশ্র ভারতীয়দের কাছে রাম নানারূপে বর্ণিত হয়ে আছে। আঞ্চলিক রামায়ণগুলিতে যতই অতিরঞ্জিত থাক না-কেন, ভারতবাসীর কাছে রামায়ণ চিরনতুন। কোনোদিন পুরোনো হয়নি, হয় না।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘রামায়ণ’ নিবন্ধে কী লিখেছেন, দেখা যাক–“দেবতার অবতারলীলা লইয়াই যে এ কাব্য রচিত তাহাও নহে। কবি বাল্মীকির কাছে রাম অবতার ছিলেন না, তিনি মানুষই ছিলেন–পণ্ডিতেরা ইহার প্রমাণ করিবেন। এই ভূমিকায় পাণ্ডিত্যের অবকাশ নাই; এখানে এইটুকু সংক্ষেপে বলিতেছি যে, কবি যদি রামায়ণে নরচরিত্র বর্ণনা না করিয়া দেবচরিত্র বর্ণনা করিতেন তবে তাহাতে রামায়ণের গৌরব হ্রাস হইত, সুতরাং তাহা কাব্যাংশে ক্ষতিগ্রস্ত হইত। মানুষ বলিয়াই রামচরিত্র মহিমান্বিত।”
তিনি মানুষ হোক কিংবা দেবতা, অথবা অবতার হোক–আধুনিক ভারতবর্ষে তাঁর রাজত্বকাল ফিরে চায় দেশের একটা অংশ, একটা রাজনৈতিক দল। রাম-রাজত্ব’ শব্দযুগল আমরা প্রথম শুনতে পেয়েছিলাম গান্ধিজির মুখে, বোধ হয়। ব্রিটিশ-মুক্ত ভারতবর্ষে নাকি রাম-রাজত্ব চলবে। কিন্তু কী সেই রাম-রাজত্ব? কেমন সেই রাম-রাজত্ব? রাম-রাজত্বে কী এমন বৈশিষ্ট্য আছে, যা নেতা-নেত্রীরা বারবার স্বপ্ন দেখায়, সাধারণ মানুষ বারবার স্বপ্ন দেখে? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে বেশিদূর যাওয়ার প্রয়োজন নেই। যে হিন্দুর ঘরে বাল্মীকির রামায়ণ’ আছে তাঁরা পাতা উলটাতে পারেন। আমিও উলটাচ্ছি আসুন। আমি এখন বালকাণ্ডমের (অনেকের মতে এই কাণ্ডটি বাল্মীকি রচনা করেননি, এই কাণ্ডটি উত্তরকাণ্ডের মতোই প্রক্ষিপ্ত) প্রথম সর্গে আছি। কী উল্লেখ আছে? আসুন মহর্ষি নারদের বয়ানটি বাংলা তর্জমায় পড়ি।
নারদের মুখে রামচন্দ্রের শাসিত রাজ্য অযোধ্যার এক মনোরম সুখসমৃদ্ধির ছবি প্রদর্শিত হয়েছে। দেবর্ষি নারদ বাল্মীকিকে বলছেন, “রাম-বিরহে এতকাল প্রজারা দুর্বিষহ মনঃকষ্ট ভোগ করেছিল। এখন রাম অযোধ্যার সিংহাসনে বসেছেন। তাঁর আদর্শ সুশাসনে প্রজাদের সুখসমৃদ্ধির সীমা থাকবে না। প্রথম তাদের মনের কষ্ট দূর হওয়ায় প্রজারা আদিমুক্ত হল। শ্রীরামের রাজত্বে আধ্যাত্মিক আধিদৈবিক এবং আধিভৌতিক সন্তাপ থেকে মুক্ত হবে অযোধ্যার নগরবাসী। নীরোগ দেহে তারা রামকে রাজা হতে দেখে অত্যন্ত সন্তুষ্ট, আনন্দে, রোমাঞ্চে অত্যুচ্ছ্বাসে পরিপূর্ণ হল। কারণ রাম প্রজাপালনে সদা ব্রতী, সর্বজনরক্ষক। তাঁর সুশাসনে সকল প্রজা ধনসম্পদে সমৃদ্ধ হয়ে ক্ষোভমুক্ত, আনন্দিত, সন্তুষ্ট। কোনো প্রজাকেই দারিদ্র্যের জ্বালা ভোগ করবে হবে না। রামের সতর্ক দৃষ্টির ফলে প্রজারা সকলে নিজের নিজের কর্মে লিপ্ত থাকবে। তাদের অপুষ্টিজনিত রোগ কোনোদিন থাকবে না। শরীর নীরোগ থাকার সুস্থদেহে তারা সুন্দরভাবে ধর্মাচরণ করতে পারবে। দুর্ভিক্ষের ভয় না-থাকার সমৃদ্ধিতে পরিপূর্ণ রাম-রাজত্বে আকালের কোনো সম্ভাবনা থাকবে না। পিতৃহৃদয়ের আকুলতা নিয়ে তিনি প্রজাদের রক্ষণাবেক্ষণ করতে থাকবেন। ফলে সকল প্রজা শারীরিক ও মানসিক সর্বপ্রকার ব্যাধিমুক্ত, নীরোগ, সুস্থ জীবনযাপন করবে। চারদিকে শান্তির বাতাবরণ সৃষ্টি হবে।”