রামায়ণের কেবলমাত্র রামকথাই নয়, রামকথা ধর্মকথাও। অনুশাসনই ধর্মকথা, বাল্মীকি সামাজিক নানা অনুশাসনও উল্লেখ করেছেন, যা অত্যন্ত মূল্যবান। এই কারণেই বোধহয় মহাকাব্য ধর্মগ্রন্থ হয়ে উঠেছে। ধর্মশাস্ত্রের মতোই রামায়ণেও অনুশাসন উচ্চারিত হয়েছে। মহাভারতও সেই কারণেই ধর্মগ্রন্থ। রামায়ণের ছত্রে ছত্রে অনুশাসনের বিবরণ নির্দেশিত হয়েছে–কখনো গল্পের মাধ্যমে, কখনো-বা সরাসরি নির্দেশনা। কোনো প্রতিষ্ঠানকে সুনিয়মে পরিচালিত করতে হলে তার জন্য বিধিবদ্ধ নিয়মের প্রয়োজন হয়। অন্যায়ের পরিহার ও নিয়ম সংরক্ষণই সেই বিধিবিধানের উদ্দেশ্য। স্মৃতিও এই উদ্দেশ্যের জন্যই রচিত হয়েছিল। মনে রাখতে হবে প্রাচীন যুগে রাজনৈতিক, সমাজনৈতিক ইত্যাদি সকল বিষয়ে স্মৃতির অনুশাসন নিয়ন্ত্রণ করত। পাপের পরিহার ও পুণ্যের প্রতিষ্ঠাই সমাজ অনুমোদিত ধর্মশাস্ত্রের উদ্দেশ্য। তবে পক্ষপাতিত্ব যে ছিলই একথা অস্বীকার করার উপায় নেই। বর্ণভেদে একই অপরাধের শাস্তি ভিন্ন হত। আইন সকলের জন্য সমান–এ অঙ্গীকার প্রাচীন যুগের অনুশাসনে ছিল না। তবে সূর্যাভিমুখে মলমূত্র ত্যাগ করা, সন্তানের মতো পালনকারী রাজার বিরুদ্ধাচরণ বা বিদ্রোহ করা, গুরুর উপদেশ ভুলে যাওয়া, গুরুনিন্দা করা, গুরুকে অবজ্ঞা করা, পা দিয়ে গোরুকে স্পর্শ করা, কাজ করিয়ে ভৃত্যকে বেতন না-দেওয়া, পরনিন্দা করা, পায়েস ও খিচুড়ি ভক্ষণ করা, বন্ধুর সঙ্গে শত্রুতা করা, প্রত্যুপকার না-করা, পুত্রহীন হয়ে মৃত্যুমুখে পতিত হইয়া, লাক্ষা-মধু-মাংস-লৌহ-বিষ বিক্রয় করা, শিশু ও বৃদ্ধদের হত্যা করা, অনুগত ভৃত্যকে পরিত্যাগ করা, মদ-নরী-অক্ষক্রীড়ায় আসক্ত হওয়া, কাম ও ক্রোধে অভিভূত হওয়া, স্বধর্মে অনাসক্তি হওয়া, গৃহ দগ্ধ করা, গুরুপত্নী ভোগ করা, পিতামাতার শুশ্রূষা না-করা, নিজের পত্নীকে পরিত্যাগ করে পরস্ত্রীতে আসক্ত হওয়া ইত্যাদি ছিল দণ্ডনীয় অপরাধ।
রামায়ণ প্রসঙ্গে প্রাবন্ধিক প্রবোধচন্দ্র সেন লিখেছেন–“সব বিবর্তনের ন্যায় এই বিবর্তনের মধ্যেও একটি ঐক্য অপরিবর্তিত রূপে নিত্য বিরাজমান আছে। এই সূক্ষ্ম ঐক্যসূত্রই ভারতবর্ষের অতীতের সঙ্গে তার বর্তমানকে অচ্ছেদ্য রূপে গেঁথে রেখেছে। এই রূপেই রামায়ণ কাব্যখানি ভারতবর্ষের যথার্থ ইতিহাসে পরিণত হয়েছে। তথ্যগত ইতিহাস নয়, সত্যগত ইতিহাস, নিছক তথ্যগত হলে রামায়ণের প্রভাব কখনো এমন গম্ভীর হতে পারত না। কেননা তথ্য হচ্ছে বাইরের জিনিস, জাতির অন্তরাত্মাকে স্পর্শ করবার ক্ষমতা তার নেই এবং আপনার কালের সীমাকে অতিক্রম করে নিত্যকালকে সে অধিকার করতে পারে না।” রামায়ণ বা রামকথা ভারতবর্ষের প্রাণস্বরূপ। ভারতের প্রায় সব ভাষায় বাল্মীকির রামায়ণকে নতুন করে লিখেছেন বহু প্রণম্য কবি। রাম পরমপুরুষত্বের কথা স্পষ্টভাবে স্বীকার করেননি। তিনি সবসময় নিজেকে মানুষ বলেই পরিচয় করেছেন। বাল্মীকিও রামকে দেবতা বা ভগবান বলেননি। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন–”এই মহাকাব্যে রাম নিজেকে অবতার মনে করেননি, তাই তিনি মর্থ্য নায়ক। এখানে উচ্চ আধ্যাত্মিকতা অনুপস্থিত।”
অনেকে মনে করেন রামায়ণ কেবল কাহিনিমাত্র নয়, রামায়ণ একটি রূপক, প্রতীকী। কৃষি বিস্তার উপলক্ষ্যে আর্য ও অনার্যদের মধ্যে সংঘাত হল রামায়ণ বর্ণিত রাম-রাবণের যুদ্ধের মূলকথা। রাম-লক্ষ্মণ-সীতা হলেন কৃষি সভ্যতার প্রতিভূ। বিশ্বামিত্র ও জনক হলেন তাঁদের সহায়ক। রাবণ ও তাঁর স্বর্ণলঙ্কা হল শিল্প সভ্যতার প্রতীক। দক্ষিণ ভারত থেকে শিল্প সভ্যতার প্রাধান্য হ্রাস করে কৃষি সভ্যতার বিস্তার করতে গিয়ে আর্য ও অনার্যদের মধ্যে সংঘর্ষ দেখা দেয়। পরিণামে বিজয়ী আর্যরা দক্ষিণ ভারতে কৃষিনির্ভর নব সভ্যতার প্রসার করে। প্রাবন্ধিক প্রবোধচন্দ্র সেন রামায়ণের রূপকাৰ্থ নির্ণয় করে লিখেছেন–আর্যরা প্রথমে পূর্ব ভারতে ও পরে দক্ষিণ ভারতে অনার্য শক্তিকে প্রতিহত করে কৃষিনির্ভর নব সভ্যতার বিস্তার করেন।
আবার অনেকে মনে করেন–রাম, লক্ষ্মণ, জনক, রাবণ প্রভৃতি চরিত্রগুলি আসলে কোনো ঐতিহাসিক ব্যক্তিবিশেষ নয়, সত্তা মাত্র। রামচন্দ্র মানে ক্রীড়াকারী পুঁজি। রাবণ মানে যে শাসক রব করে, অর্থাৎ প্রজাদের জন্য অনেককিছু করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয় কিন্তু বাস্তবে করে দেয় না। রামায়ণে সেই শাসক পরাজিত হয় এবং দেশে লক্ষ্মীপুঁজির বিকাশ ঘটে। বৈদিক ভারতের বৌদ্ধ ভারতে উত্তরণের সঙ্গে রামায়ণের কাহিনির মিল রয়েছে। বৌদ্ধযুগেও পুঁজির বিকাশ ঘটে এবং বৈদিক যুগের অবসান ঘটে। পুরোহিত শ্রেষঠ রাবণকে বৈদিক যুগের প্রতিভু বলে বিবেচনা করা যায়। রাম তার শাসনের অবসান ঘটিয়ে রামরাজত্ব গড়ে তুলেন। রামরাজত্ব। বলতে যোড়শ মহাজনপদকে বুঝেছেন। রামায়ণের লঙ্কা আসলে শ্রীলঙ্কা দেশ নয় বরং তা ভারতের শাসনকেন্দ্রের প্রতীক যা জনসমুদ্রের মধ্যে দ্বীপ রূপে প্রতিষ্ঠিত থাকে। রামায়ণের হনুমান আসলে দক্ষ পণ্ডিতদের প্রতীক, যারা বৌদ্ধবিপ্লবে সহায়তা করেছিলেন। তার লেজটিকে সেক্ষেত্রে ডিগ্রির লেজ বলে বুঝে নিতে হবে। আর জনক মানে যিনি জন (কৃষিশ্রমিক) করে পাইকারি হারে কৃষিকার্য শুরু করেছিলেন। প্রসঙ্গত, যৌথ সমাজে একজন মানুষ আর একজন মানুষকে জন করে খাটাবে এমন ব্যাপারটি অকল্পনীয়। সীতা আসলে জনকের কৃষি মজুরদেরই প্রতিভু। ওরা অন্ন উৎপাদন করে বলে ওরাই লক্ষ্মী। রামের সঙ্গে ওদের বিবাহ মানে কাজের চুক্তি বলে বুঝতে হবে।