প্রাচীন ভারতে হিন্দু বলে কোনো ধর্ম ছিল না। প্রকৃত অর্থে হিন্দুধর্ম বলে কোনো কথার মানেও হয় না। ভারত উপমহাদেশে এরকম কোনো ধর্মের আবির্ভাবও হয়নি। হিন্দুধর্ম বলতে বুঝতে ব্রাহ্মণ্যবাদীদের দ্বারা রচিত ব্রাহ্মণ্য অনুশাসন। বলা যায় ব্রাহ্মণ্যধর্ম। যেহেতু ব্রাহ্মণ্যধর্মের নির্দিষ্ট কোনো মুখ নেই, বহুমুখী–সেই কারণেই হিন্দুধর্মকে সনাতন ধর্ম বলাটাই সবচেয়ে বেশি নিরাপদ, সামগ্রিক।
রামায়ণ ও মহাভারতই ভারতীয় মহাদেশের ভারতত্ব। রামায়ণ ও মহাভারতেই লুকিয়ে আছে হিন্দুজাতির অস্তিত্ব, অনস্তিত্ব। ভারত উপমহাদেশে বহিরাগত আর্য তথা ব্রাহ্মণরা তাঁদের রচিত শাস্ত্র-সাহিত্য নিয়ে বহু বিস্তৃত অঞ্চলে ছড়িয়ে দিয়েছেন। এইভাবে ভারতের ভারতীয়তার প্রসারের ফলে এশিয়া ভূখণ্ডের কয়েকটি দেশকে Greater India বা বৃহত্তর ভারত নাম দিয়ে বিশালতর ভারতবর্ষের এক একটি অংশ বলে ধরে নেওয়া হয়। সেই বৃহত্তর ভারতের অংশগুলি হল ব্রহ্ম, শ্যাম, কম্বোজ, কোচিন-চিন বা চম্পা এবং লাওস। মালয় উপদ্বীপ ও ইন্দোনেশিয়া অর্থাৎ দ্বীপময় ভারত বা দ্বীপান্তরের দ্বীপ। যেমন–সুমাত্রা, যবদ্বীপ, লম্বক, সুম্বাওয়া, তিমোর, সুলাবেশি, বোর্নিও প্রভৃতি।
ভারতবর্ষ থেকে যেসব দেশে ভারত-ধর্মের ব্রাহ্মণ্যধর্ম ও বৌদ্ধধর্মের প্রচার হয়েছে, সেইসব দেশে রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণাদি পৌঁছে গেছে। এর ফলে দক্ষিণ ব্ৰহ্ম, দক্ষিণ শ্যাম, কম্বুজ দেশ (Cambodia), উত্তর ও মধ্য ব্রহ্মের থুল চুক (Thul-Cuk), উত্তর শ্যামের দৈ (Dai) বা থাই (Thai) জাতি, চম্পার চাম (Cham) জাতি, মালয় উপদ্বীপের মালাই জাতি এবং যবদ্বীপের সুন্দা, মাদুরা ও যবদ্বীপীয় জাতি বা বলিদ্বীপের ও লম্বক দ্বীপের অধিবাসীরা সকলেই এককালে ব্রাহ্মণ্য আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে ধর্ম ও সমাজ গড়ে তোলে। এই ধর্মপ্রসারে বেদ, রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণাদিই ছিল একমাত্র অস্ত্র। ব্রাহ্মণ তথা আর্যরা যে কত মহান’ জাতি, তা এই গ্রন্থগুলিতে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বর্ণিত হয়েছে। পরে অবশ্য ব্রাহ্মণ্য অনুশাসনের বিরোধিতা করে প্রতিস্পর্ধী বৌদ্ধধর্মের উত্থান হলে ব্রাহ্মণধর্ম অনেকটাই খর্ব হয়ে যায়। একদা ব্রাহ্মণ্য অনুশাসন বা ধর্মে যেসব দেশ সমাজ গড়েছিল, সেইসব দেশ এখন বৌদ্ধধর্মাবলম্বীদের বৃহৎ সংখ্যাগরিষ্ঠের দেশ। সেইসব দেশগুলি হল–চিন, থাইল্যান্ড, জাপান, মিয়ানমার, শ্রীলঙ্কা, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, মালয়েশিয়া প্রভৃতি। ভারত উপমহাদেশের মানুষ ব্রাহ্মণ্যধর্ম ত্যাগ করে কিঞ্চিৎ বৌদ্ধ এবং অনেকটাই ইসলাম ধর্মকে গ্রহণ করে নিয়েছে।
রামায়ণ, মহাভারত ও পুরাণাদি যদি যথাযথভাবে সংরক্ষিত করা না যেত, যদি এইসব গ্রন্থে প্রক্ষিপ্তভাবে ব্রাহ্মণদের আধিপত্য প্রবেশ ঘটানোনা যেত, তাহলে তথাকথিত হিন্দুধর্মের বিলোপ ঘটে যেত। ব্রাহ্মণদের মাহাত্মও প্রচার পেত না। যে রামায়ণ গ্রন্থটি নিয়ে এতক্ষণ আলোচনা করা হল সেই রামায়ণ কি একজন বাল্মীকির রচনা? না, এই বাল্মীকি রামকথাকার আদিকবি নন। আচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে, রাম আমলের প্রচেবংশীয় পুরুষ বলে নিজের পরিচয় দিয়েছে। ভারতীয় ব্রাহ্মণ সম্প্রদায় রামকে সামনে রেখে একটির পর একটি অন্যায় করে গেছেন, আর সেই অন্যায়গুলি যে অন্যায়ই নয় সেটা বোঝানোর জন্য অলৌকিক ঘটনা প্রবেশ ঘটিয়ে মাহাত্ম প্রচার করে গেছেন। তাই রাম হয়েছেন সমস্ত অপবাদ ও অপ্রশংসার লক্ষ্য। তাই রাম সমালোচনার উর্ধ্বে থাকতে পারলেন না কোনোভাবেই।
রাম অসহায় রাজা, বেবশ মানুষ। গোটা রামায়ণ জুড়ে রামের যে কার্যকলাপ রামের নিয়ন্ত্রণাধীন ছিল না। সীতাকে একাকী পঞ্চবটিতে ফেলে গভীর অরণ্যে শিকারে যাওয়া; বালীকে হত্যা করা; সুগ্রীবের সঙ্গে দোস্তি করা; পায়ে পা লাগিয়ে রাবণের যুদ্ধ করে তাঁকে হত্যার পরিকল্পনা করা; সীতার সতীত্ব যাচাই করার জন্য আগুনে ঠেলে দেওয়া; সীতাকে অপমান করা; সীতাকে জঙ্গলে পরিত্যাগ করা; লক্ষ্মণকে বর্জন করা; লব, কুশ, ভরত ও শত্রুঘ্নকে ভিনরাজ্যে ঠেলে দেওয়া; রামের সদলবলে সরযূ নদীতে আত্মবিসর্জন দেওয়া কোনোকিছুই রামের ইচ্ছামতো হয়নি–রাম ব্রহ্মাবাদী নিষ্ঠুর ব্রাহ্মণ্য-চক্রান্তে বন্দি। রাম নিজেও এসবের কিছু বোঝেননি, তা কিন্তু নয়। রাম নিজের মুখেই বলেছেন–“দেবগণের সকল কার্যে আমি ব্ৰহ্মার বশবর্তী”। বুঝলেও কিছু করারও ছিল না রামচন্দ্রের। এসব কাজে রামের যে বিন্দুমাত্র আপত্তি ছিল না একথা বলা যায় না। কে শোনে তাঁর আপত্তি! আপত্তি শোনার জন্যই কি এত পরিকল্পনা! ব্রাহ্মণ্য-চক্রান্ত যে কত নির্মম আর। নিষ্ঠুর রামকথা তারই জলন্ত প্রমাণ। এই ব্রাহ্মণ নেতাদের হুকুমেই রাম সর্বসমক্ষে সরযূ নদীতে জীবন বিসর্জন বাধ্য হয়েছেন। রামের জীবন সুখে কাটেনি, শেষ জীবন তাঁর বড়োই কঠিন অবস্থা দিয়ে গেছে। মমর্যাতনায় দিনগুলি শেষ হয়েছে তাঁর। ক্ষমতা কুক্ষিগত করে অবাধে লুণ্ঠনে পরিতৃপ্ত হয়েছেন নেপথ্যের পরিচালকবৃন্দ ব্রাহ্মণগণ। রামচন্দ্র কর্তৃক সমস্ত কর্মকাণ্ডের উপর ব্রাহ্মণদের তীক্ষ্ণ নজর ছিল। ছিল স্পষ্ট নির্দেশ। গোটা রামায়ণে ব্রাহ্মণদের অঙ্গুলিহেলন ছাড়া গাছের একটি পাতাও নড়েনি। রামের শেষ পরিণতির জন্য ব্রাহ্মণরাই দায়ী। ব্রাহ্মণরাই রামের জীবন থেকে সমস্ত প্রিয়পরিজনদের একে একে সরিয়ে দিয়েছেন। এঁদেরই অঙ্গুলিহেলনে রাম বিধ্বস্ত, রাম একাকী। আর এক ব্রাহ্মণ গোষ্ঠীরাই নয়, ব্রাহ্মণদের সঙ্গে ছিল বৃহৎ শক্তির ধারক সম্প্রসারণবাদী তথা সাম্রাজ্যবাদী আর্যদেবতাদের সেনাদল! অথচ নিজেদের গায়ে কোনো কাদাই লাগতে দেননি তাঁরা।