আর্যরা বহিরাগত না ভারতেই আধিবাসী এ প্রশ্নকে কেন্দ্র করেও পণ্ডিতদের মধ্যে মতভেদ আছে–(১) গঙ্গানাথ ঝাঁ, ত্রিবেদ, কাল্লা, এ.সি. দাস, পুসলকারের মতো ভারতীয় পণ্ডিতরা মনে করেন ভারতই আর্যদের আদি বাসস্থান, যদিও ভারতের কোন্ অঞ্চলে তারা বসবাস করত তা নিয়েও বিতর্ক আছে। (২) দ্বিতীয় মত অনুসারে (গাইলস, হার্ট ইত্যাদি ইউরোপীয় পণ্ডিত) ইউরোপই আর্যদের আদি বাসস্থান। এ ক্ষেত্রেও ইউরোপের কোন্ অঞ্চলে তাঁরা বসবাস করত, তা নিয়েও মত পার্থক্য আছে। (৩) তৃতীয় একটি মত অনুসারে (ব্রান্ডেনস্টিয়েন) মধ্য এশিয়ায় স্তেপি অঞ্চলেই ছিল আর্যদের আদি নিবাস এবং এখান থেকেই তাঁদের একটি শাখা ইউরোপে ও অপর একটি শাখা পারস্য হয়ে ভারতে প্রবেশ করে। বর্তমানে তৃতীয় অভিমতই অধিকাংশ পণ্ডিত গ্রহণযোগ্য বলে মনে করেন।
সংস্কৃত ভাষায় লিখিত প্রাচীন শ্লোক অনুসারে “সর্বে গত্যৰ্থাঃ জ্ঞানার্থাঃ প্রাপ্ত্যর্থাশ্চ”–সমূদায় গমনার্থক ধাতু জ্ঞানার্থক ও প্রাপ্ত্যর্থক। সুতরাং, যারা জ্ঞানশীল অথবা যারা (শাস্ত্রসীমায়) গমন করেন কিংবা যারা (শাস্ত্রের পার) প্রাপ্ত হন, তাঁরাই আর্ব। যাস্কাচার্যের মতে “আর্য’ শব্দের নিরুক্তগত অর্থ ‘ঈশ্বরপুত্র’। অর্থাৎ ঈশ্বরের যথার্থ পুত্রকে ‘আর্য’ নামে সম্বোধন করা হয়। মানবমাত্রেই ঈশ্বরের পুত্র, তথাপি সদাচারপরায়ণ পুরুষকেই ঈশ্বরপুত্র অর্থাৎ ‘আর্য’ নামে অভিহিত করা হয়ে থাকে। আর্যরা ভারতবর্ষে বিদেশি অনুপ্রবেশকারী এটি ইংরেজ আমলে প্রচারিত একটি ধারণা বলেও অনেকে মনে করেন।
বাল্মীকি রামায়ণে বলা হয়েছে–
“সর্বদাভিগতঃ সদ্ভিঃ সমুদ্র ইব সিন্ধুভিঃ। আর্যসবসমশ্চৈব সদৈব প্রিয়দর্শন।” (বাল্মীকি রামায়ণ ১/১/১৬)
অর্থাৎ, রামচন্দ্র সদাসর্বদা সৎপুরুষদের সাহচর্যে থাকতেন, যেরূপ সমুদ্র সদা নদীসমূহের সঙ্গে মিশে থাকে তথা তিনি আর্য, সমদর্শী ও সকলের প্রিয় ছিলেন।
বিদুর নীতিতে বলছে–
“আর্য কর্মাণি রজ্যন্ত ভূতি কর্মাণি কুৰ্বতে হিতং চ নাভ্যসূযন্তি পণ্ডিতা ভরতভ।
ন স্বে সুখে বৈ কুরুতে প্রহর্ষ। নান্যস্য দুঃখে ভবতি প্রহৃষ্টঃ।
দত্ত্বা ন পশ্চাৎ কুরুতেহনুতাপং স কথ্যতে সৎপুরুষার্য শীলঃ।” (বিদুর নীতি ১/৩০/১/১৮)
এই শ্লোকে অত্যন্ত ধার্মিককেই ‘আর্য’ বলা হয়েছে। চাণক্যনীতিতে উল্লেখ আছে–“অভ্যাসাদ ধার্যতে বিদ্যা কুলং শীলেন ধার্যতে। গুণেন জ্ঞাযতে আর্যঃ কোপো নেত্রেণ গম্যাতে।” (চাণক্য নীতি ৫/৮) এখানেও গুণীজনকে ‘আর্য’ বলা হয়েছে। মহাভারতের আছে–“স বাল এবামতিপোত্তমঃ।” (মহাভারত আদিপর্ব ৪০/৭) এই শ্লোকে উত্তম রাজকুমারের সাথে ‘আর্যমতি’ বিশেষণ যুক্ত করা হয়েছে যার অর্থ শ্রেষ্ঠ, বুদ্ধিমান। কৌটিল্য অর্থশাস্ত্রে পাচ্ছি–“ব্যবস্থিতামর্যাদাঃ কৃতবর্ণাশ্রমস্থিতঃ।” আর্যগণের মর্যাদাকে যে ব্যবস্থিত করতে সমর্থ সেই রাজ্যাধিকারী, এরূপ বর্ণিত হয়েছে।
মোদ্দা কথা, আর্য হচ্ছে একটি ভাষা গোষ্ঠীর নাম। আর একাধিক মানবগোষ্ঠীই এই ভাষা গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। ভাষাগত দিক দিয়ে ভারতবর্ষে দুটি আর্য জাতির অস্তিত্ব মেলে। আর গোষ্ঠীগত দিক দিয়ে যাদের একটি হল–আলপাইন মানবগোষ্ঠীভুক্ত এবং অন্যটি নর্ডিক মানবগোষ্ঠীভুক্ত। এই আলপাইন মানবগোষ্ঠীভুক্ত লোকেরা যেমন অসুর, রাক্ষস, শূদ্র নামে পরিচিত, তেমনি নর্ডিক মানবগোষ্ঠীভুক্ত লোকেরা ছিল ব্রাহ্মণ নামে পরিচিত। অনেক চিন্তাশীল লেখকেরাই ব্যাপারটাকে গুলিয়ে ফেলেন। তাঁরা বলেন, ডঃ আম্বেদকর বলেছেন বৈদিক আর্যরা। বহিরাগত বা অনুপ্রবেশকারী নয়। আসলে তাঁরা আম্বেকরের ব্যাখ্যাকে সঠিকভাবে বুঝতে পারেননি বলে মনে হয়। আসলে ডঃ আম্বেদকর বলেছেন, আলপাইন বা অসুর মানবগোষ্ঠীর আর্যভাষীরা বহিরাগত নয়। কিন্তু নর্ডিক মানবগোষ্ঠীভুক্ত আর্য ভাষীরা হলেন বহিরাগত। যদিও বর্তমানে আর্য বলতে আমরা কেবল নর্ডিক মানবগোষ্ঠীভুক্ত আর্য ব্রাহ্মণদেরই বুঝে থাকি। যারা হলেন ভারতবর্ষে অনুপ্রবেশকারী বা বহিরাগত। নর্ডিক মানবগোষ্ঠীর আর্যভাষী ব্রাহ্মণ এবং অন্যটা আলপাইন মানবগোষ্ঠীর আর্যভাষী অসুর, যা ডঃ আম্বেদকর তাঁর গবেষণা দ্বারাই প্রমাণ করেছেন।
নর্ডিক মানবগোষ্ঠীভুক্ত লোকেরা যেহেতু তাঁরা ব্রাহ্মণ নামে পরিচিত; তাই তাঁরাই মূলনিবাসীদের মধ্যে অত্যন্ত সুকৌশলে বিভেদ সৃষ্টি করে ইন্দো-ইরানি দাস এবং দস্যু সহ দেশীয় আলপাইন মানবগোষ্ঠীভুক্ত আর্যদেরও যুদ্ধে পরাজিত করে ভারতবর্ষে আধিপত্য বিস্তার করেন। কারণ ইন্দো-ইরানী দাস এবং দস্যু ও দেশীয় আলপাইন মানবগোষ্ঠীভুক্ত আর্যরা ছিলেন অযাজকীয় বা ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদে বিশ্বাসী। কিন্তু নর্ডিক মানবগোষ্ঠীভুক্ত আর্যরা ছিলেন যাজকীয় মতবাদে বিশ্বাসী। আর জয়ের পরিকল্পনাটি ঠিক এ কারণেই।
একথার সমর্থনে বলা যায় যে নর্ডিক আর্যরাই দাস এবং দস্যুসহ মূলনিবাসী আলপাইন আর্যদেরও জয় করেছিল। যার প্রমাণ ঋগবেদের উদাহরণ থেকেই পাওয়া যায়। অর্থাৎ ঋগবেদে দেখা যায় দাস এবং দস্যুরা আলপাইন আর্যদের পক্ষ নিয়ে নর্ডিক আর্যদের বিরুদ্ধে সর্বদাই যুদ্ধে লিপ্ত ছিলেন। আর নর্ডিক আর্য ব্রাহ্মণেরা যে সত্যিই দাস, দস্যু, রাক্ষস, অসুর এবং আলপাইন আর্যদের জয় করেছিলেন তা অনুপ্রবেশকারী বৈদিক নর্ডিক আর্য ব্রাহ্মণের নিত্যনতুন বৈদিক আইন প্রনয়ণ এবং বৈদিক ধর্মের উপর পরবর্তীকালীন প্রাধান্য থেকেই পরিষ্কার। অতএব ডঃ আম্বেদকরের সদ্ধান্ত থেকে প্রমাণিত নর্ডিক আর্য ব্রাহ্মণেরা বিদেশি ইউরোপিয়ান অনুপ্রবেশকারী। কিন্তু আলপাইন আর্যরা দেশীয় অসুর জাতি বলেই পরিচিত। যে আলপাইন বা অসুর জাতি নর্ডিক আর্য আগমনের অনেক পূর্বেই নগরকেন্দ্রিক সিন্ধু সভ্যতা গড়ে তুলেছিলেন।