সেই আর্যসত্যকে বুঝতে হলে পিছন দিকে ফিরে যেতে হবে। অনেকটা পিছনে। প্রাচীন ভারতকে না চিনলে রামায়ণকে মূল্যায়ন করা যাবে না। সেই প্রাচীন ইতিহাসের আলোর নিচে রামায়ণকে ফেলে যদি পোস্টমর্টেম করতে পারেন, তাহলেই বেরিয়ে আসবে প্রকৃত সত্য।
হিমালয় পর্বত থেকে নিঃসৃত তিনটি নদীজলধারা বিধৌত বিশাল অঞ্চল সাধারণভাবে আর্যাবর্ত নামে পরিচিত, যা মুসলিম আগমনে হিন্দুস্তান বলে পরিচিত হয়েছে। এই অঞ্চলের পশ্চিমাংশ সিন্ধু ও তার পাঁচটি শাখা–শতদ্রু, বিপাশা, বিতস্তা, চন্দ্রভাগা ইরাবতী। মধ্যমাংশ গঙ্গা, যমুনা ও তার উপনদী। পূর্বাংশে ব্ৰহ্মপুত্র প্রবাহিত। আর্যাবর্তের প্রতীচ্য ভাগে একটি অববাহিকার পাশে সুপ্রাচীন সিন্ধু সভ্যতার উন্মেষ ও বিকাশ হয়েছিল। ভারতে আর্যরা নদীর মাহাত্ম্যে মোহিত হয়ে নদীগুলিকে দেবতাজ্ঞানে পুজো করতেন। তাই ভারতভূমির জলই গঙ্গাদেবতার মর্যাদা পায়। প্রাচীন গ্রন্থগুলি ঘাঁটাঘাঁটি করলে বেশকিছু তথ্য উঠে আসে, সেগুলি এখানে আলোচনা বা উল্লেখ করলে বিষয়টা একটু স্পষ্ট হয়।
প্রাচীনকাল থেকেই ভারতের রাজনৈতিক (পৌরাণিক সহ) ইতিহাসে উত্তর ভারতের গুরুত্ব সর্বাধিক। আর্য সভ্যতার উন্মেষ ও বিকাশ এবং প্রথম সাম্রাজ্যের বিস্তার ও প্রকাশ এখান থেকেই হয়েছিল। আর্য কারা? ইউরোপীয় পণ্ডিতেরা বলেন, আর্যরা প্রথমে পশুপালন করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। তাঁরা দলবদ্ধ হয়ে অনেকগুলো পশু সঙ্গে নিয়ে ঘাস আচ্ছাদিত অঞ্চল বা প্রদেশের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়তেন। পরে সে স্থানের ঘাস পশু খাদ্য হিসাবে নিঃশেষিত হলে তাঁরা পুনরায় অন্য অঞ্চল বা প্রদেশে যেতেন। এভাবে তাঁরা প্রতিনিয়ত এক স্থান থেকে অন্য স্থানে চলে আসতেন বলে আর্য (অর্থাৎ গমনশীল) নামে পরিচিত হয়েছেন। পরবর্তী সময়ে আর্যরা নিরন্তর এরূপ স্থান পরিবর্তন খুবই কষ্টদায়ক বিবেচনায় এনে এক স্থানে অবস্থানের উপর গুরুত্ব আরোপ করে এবং এ সমস্যা সমাধানের উপায় বের করার চেষ্টা চালায়। উপায় হিসাবে কৃষিকাজকেই তাঁরা অধিক গুরুত্ব দিয়ে ফসল উৎপাদনে নিযুক্ত হয়। এজন্যই তাঁরা আর্য (অর্থাৎ কৃষিজীবী) নামে প্রসিদ্ধ হন। শেষোক্ত পক্ষের মতবাদে আর্য শব্দের অর্থ দাঁড়ায় কৃষিকর্মকারী, কারণ ও ধাতুর কর্ষণার্থও আছে।
ভারতীয় উপমহাদেশের প্রাচীন গ্রন্থগুলির কতগুলোতে উৎকৃষ্ট গুণসম্পন্ন ব্যক্তিকে ‘আর্য’ শব্দে নির্দেশ করা হয়েছে। কোনো কোনো গ্রন্থে হিন্দুধর্মাবলম্বী লোকমাত্রেই অর্থাৎ ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র–এই চার বর্ণের লোকই ‘আর্য’ বলে লিপিবদ্ধ আছে। আবার, কোনো কোনো গ্রন্থে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য–এ তিন বর্ণকে আর্য এবং চতুর্থ বর্ণকে শূদ্র হিসাবে বিবেচনা করা হয়েছে। এতে কেউ কেউ অনুমান করেন যে, শূদ্র গোষ্ঠী আর্যবংশের নয়; আর্যেরা ভারতবর্ষে এসে ভারতের স্থানীয় ভূমিপুত্রদের শূদ্র তথা অনার্য চিহ্নিত করেছেন।
আর্য গোষ্ঠী খ্রিস্টপূর্ব প্রথম সহস্রাব্দে বাংলা অঞ্চলে প্রবেশ করতে শুরু করে। তৎকালে বাংলা অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাষ্ট্রে বা উপরাষ্ট্রে বিভক্ত ছিল। প্রত্যেক রাষ্ট্র স্বশাসিত নৃগোষ্ঠী দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হত। পূর্ববর্তী বৈদিক আর্যরা উপনিবেশ গড়ার ক্ষেত্রে নানা কারণে এ অঞ্চলের জনগোষ্ঠীর সংমিশ্রণে আসার ব্যাপারে অনাগ্রহী ছিল। কারণ তাঁদের দৃষ্টিতে পূর্বাঞ্চলীয় ভূখণ্ডে ছিল রাক্ষস, অশুচি ও দস্যু বা বর্বর জনগোষ্ঠীর বাস।
মৎস্য পূরাণের এক বর্ণনায় দেখা যায় যে, এক অন্ধ বৃদ্ধ সাধু ভুলবশত নিম্নগাঙ্গেয় উপত্যকার স্রোতে ভেলা ভাসিয়েছিলেন। বালী নামের এক নিঃসন্তান রাজা বংশ রক্ষা ও রাজ্যের উত্তরাধিকারীর জন্য বৃদ্ধ সাধুকে আশীর্বাদ করার অনুরোধ করেন। সাধুর আশীর্বাদে রাজা তাঁর বৃদ্ধা রানীর গর্ভজাত পাঁচটি পুত্র সন্তানের জনক হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করেন। পাঁচ পুত্রের নাম রাখা হয় অঙ্গ, বঙ্গ, কলিঙ্গ, পুন্ড্র ও সূক্ষ্ম। রাজার পাঁচ পুত্র সন্তানের নামে বাংলার পাঁচটি ভূখন্ডের নামকরণ হয়। বাংলা ভূখণ্ড আর্যদের নিকট এতোটাই অপবিত্র ছিল যে, তাঁরা সতর্কতার সঙ্গে এতদঞ্চলে প্রবেশ ও স্থায়ী বসবাস গড়া থেকে নিজেদের বিরত রেখেছিল। সবচেয়ে কৌতুহোলদ্দীপক হল, আরও পরবর্তী সময়ের বৈদিক সাহিত্যের বিষয়াবলিতেও ভারত তথা বাংলার জনগোষ্ঠীকে দস্যু, দৈত্য-দানো, রাক্ষস-খোক্ষস হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। মহাভারত এ বাংলার উপকূলবর্তী। অঞ্চলের জনগোষ্ঠীকে ম্লেচ্ছ হিসেবে বর্ণিত হয়েছে। ভগবত পুরাণে ও বাংলার জনগণকে বলা হয়েছে ‘পাপী। ধর্মশাস্ত্রে পুন্ড্র ও বঙ্গীয় জনগোষ্ঠীর সঙ্গে সংস্পর্শে আসার পর সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে মৃত্যুর পরবর্তী শেষ কৃত্যানুষ্ঠান আয়োজনের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। আর্যরা আর্যাবর্তের বাইরে বসবাস গড়ে তুললেও স্থানীয় ভূমিপুত্র তথা জনগণের সঙ্গে মেলামেশার ক্ষেত্রে তারা নানা ধরণের বিধিনিষেধ বজায় রেখে চলত।
আর্যসমস্যা ইতিহাসের একটি জটিল সমস্যা। একটি মত অনুসারে আর্ব বলতে একটি বিশিষ্ট ভাষাগোষ্ঠীর মানুষকে বোঝায়। অন্য মত অনুযায়ী আ কথাটি জাতি অর্থে ব্যবহার করা উচিত। বর্তমানে প্রথম মতের সমর্থকদের সংখ্যা বেশি হলেও, দ্বিতীয় অভিমতটি পুরোপুরি পরিত্যক্ত করা হয়নি।