গ্রিকরা যে শুধু রূপকথা নিয়েই পড়ে ছিল তা কিন্তু নয়। এই রূপককে বাস্তবে রূপ দিতেও তাঁদের দেশে সেই সময়ে অনেকেই কাজ করে গেছেন। আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৪০০ সালে আর্কিটাস, যিনি ছিলেন একাধারে দার্শনিক, গণিতবিদ, জ্যোতিষী। তিনি প্রথম উড়ুক্কু মানের ডিজাইন ও মডেল নির্মাণ করেছিলেন এবং এটি নাকি ২০০ মিটার পর্যন্ত উড়তে সক্ষম হয়েছিলে। তিনি এই যন্ত্রের নাম দিয়েছিলেন পিজিয়ন।
উন্নত উড্ডয়ন যন্ত্রের চিত্র অংকন করেছিলেন শিল্পী লিওনার্দো দা ভিঞ্চি। প্রাজ্ঞজন বলেন, তিনিই সর্বপ্রথম আকাশে উড়ার একটি তাত্ত্বিক ধারণা দেন। তাঁর ডিজাইন করা গস্নাইডারে ডানার ভিতরের অংশ ছিল মূল কাঠামোর সঙ্গে শক্তভাবে লাগানো। আর ডানার নড়তে সক্ষম অংশগুলি নিয়ন্ত্রণের জন্য ছিল আলাদা নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা। এর নাম তিনি দিয়েছিলেন ‘ওরনিথপ্টার। ১৪৯৬ সালে তিনি এর পরীক্ষামূলক উড্ডয়নের চেষ্টা করলেও তা সফল হয়নি। কেননা এ যন্ত্রের সাহায্যে আকাশে পাখির মতো মুক্তভাবে উড্ডয়নের জন্য প্রয়োজনীয় শক্তি অর্জন করা সম্ভব ছিল না সেই সময়। অনেকে অবশ্য বাহুবলেই এই যন্ত্রের সাহায্যে উড়তে চেষ্টা করেছিল। কিন্তু সেই চেষ্টায় কেউ সফল হয়েছে বলে শোনা যায়নি কখনো। কেননা মানুষের বুকের ও কাঁধের পেশিগুলি এই কাজ করার মতো যথেষ্ঠ শক্তিশালী নয়। ভিঞ্চির মৃত্যুর পর অনেকদিন আর আকাশে ডানা মেলার ব্যাপারে তেমন কোনো অগ্রগতি হয়নি। ১৬৩০ সালের দিকে তুরস্কের ইস্তাম্বুলের ৬২.৫৯ মিটার উঁচু গালাতা টাওয়ার থেকে হিজাফেন আহমেদ সালাবি নামক এক ব্যক্তি নিজের তৈরি উড়ুক্কু এক যানে করে ৩ কিলোমিটার দূরত্ব পর্যন্ত পাড়ি দিতে সক্ষম হয়েছিলেন। ১৬৩৩ সালে তার আর-এক ভাই হাসান সালাবি সাতটি ডানার এক রকেটে করে আকাশ উড্ডয়ন করেছিলেন। এর উপরের অংশ ছিল গান পাউডারে পূর্ণ। এটিই মানুষের বানানো প্রথম রকেট বলে মনে করা হয়। তিনি গান পাউডার শেষ হওয়ার পর ডানাগুলিকে প্যারাসুটের মতো ব্যবহার করে নিরাপদেই অবতরণ করেছিলেন। তিনি আকাশে ছিলেন প্রায় ২০ সেকেন্ড আর ৩০০ মিটার মতো উঁচুতে উঠেছিলেন বলে জানা যায়।
বাতাসের চেয়ে ভারি কোনো উড়ুক্কু যান সম্পর্কে কোনো বৈজ্ঞানিক গবেষণাপত্র প্রথম প্রকাশিত হয় ১৭১৬ সালে, ‘স্কেচ অফ এ মেশিন ফর ইন দা এয়ার’। লিখেছিলেন ইমানুয়েল সুইডেনবর্গ। তিনি এই বইয়ে তাঁর ফ্লাইং মেশিনের বর্ণনায় বলেছিলেন এটি হাল্কা কাঠামোর শক্ত ক্যানভাসে ঢাকা একটি যন্ত্র যার দুটি বড়ো ডানা ছিল। কিন্তু তিনি জানতেন যে, এই কাঠামো আকাশে উড়ার মতো প্রয়োজনীয় শক্তির জোগান দেওয়ার মতো ব্যবস্থা এতে ছিল না। ১৯০১ ও ১৯০৩ সালে দুটি পরীক্ষামূলক ফ্লাইড পরিচালনা করলেও এগুলির ইঞ্জিনের কার্যক্ষমতা তেমন আশানুরূপ ছিল না। পরে তিনি ৫২ হর্সপাওয়ারের দুটি শক্তিশালী ইঞ্জিন ব্যবহার করে পরীক্ষা চালালেও তার এই মডেল এইক্ষেত্রে সফলতার মুখ দেখেনি। ইনিই প্রথম উড়ুক্কু যান নিয়ে আকাশে উড়ার কৃতিত্ব অর্জন করেন।
অবশেষে অরভিল রাইট আর উইলবার রাইট ভ্রাতৃদ্বয় নতুন যুগে আমেরিকার নর্থ ক্যারোলিনার কিল ডেভিল হিলসে ১৯০৩ সালের ১৮ ডিসেম্বর তারা ফ্লায়ার ওয়ানের সফল উডডয়ন করান। প্রথম ফ্লাইটের পাইলট ছিলেন অরভিল রাইট। তিনি প্রথম ফ্লাইটে ১২ সেকেন্ড ৩৭ মিটার পথ পাড়ি দেন। একই দিনের চতুর্থ ফ্লাইটে উইলবার রাইট ৫৯ সেকেন্ডের ফ্লাইটে ২৬০ মিটার পথ পাড়ি দেওয়ার কৃতিত্ব দেখান। চারটি ফ্লাইটই মাটির ১০ ফুট উপর দিয়ে পরিচালনা করা হয়। প্রথম উড্ডয়নে আকাশযানের সামনের রাডার বহনকারী কাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হলেও মূল কাঠামোটি সম্পূর্ণ অক্ষত ছিল। ১৯০৫ সালের ৫ অক্টোবর উইলবার রাইট ৩৯ মিনিট ২৩ সেকেন্ডে ২৪ মাইল পথ পাড়ি দেবার গৌরব অর্জন করেন।
শুধু রামায়ণেই তো নয়, মহাভারত ও বাইবেল পুরাণাদিতেও বারবার বিমান বিষয়ে উল্লেখ আছে। পৌরাণিক বিবরণসমৃদ্ধ বাইবেল গ্রন্থেও আকাশপথ থেকে মিশ্ৰীয় সেনাবাহিনীর উপর বিশ্বপ্রভুর আক্রমণের বর্ণনা আছে, যা আকাশযুদ্ধেরই বর্ণনা। রামায়ণ, মহাভারত, পুরাণ, বাইবেলে যেভাবে পুঙ্খানুপুঙ্খ বিমানের উল্লেখ আছে, সেটা বিমান বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা না-থাকলে কখনোই বর্ণনা করা সম্ভব হত না। পৌরাণিক যুগে ভয়ংকর ভয়ংকর যুদ্ধাস্ত্র আবিষ্কার হয়ে গেল, বিমান আবিষ্কারটাও কিন্তু দুঃসাধ্য হতে পারে না।
তাহলে এমন তো নয় পৌরাণিক যুগের পর বিমান নিয়ে কোনো গবেষণা বা প্রচেষ্টা হয়নি! মাঝের সময়গুলি কি বিজ্ঞান গবেষণায় অন্ধকারময় যুগ ছিল? তাই কি আরও অনেক সময় লেগে গেল আধুনিক বিমানে পৌঁছোতে! দানিকেন এক সংগত প্রশ্ন তুলেছেন–ক্রমবিকাশের ধারায় সেই যানগুলো আরও উন্নত হল না কেন? পারে পায়ে তাহলে তো কয়েক হাজার বছর আগেই আমরা চাঁদে যেতে পারতাম। বস্তুত ইতিহাস বলে প্রাচীন যুগ থেকে মধ্যপ্রাচ্য ও প্রাচ্যের মানুষরা ছিলেন খুবই বিজ্ঞানমনস্ক। তাঁরা বহু আবিষ্কারের হোতা হলেও তা তাঁরা সংরক্ষণ করে রাখতে পারেননি। ফলে পাশ্চাত্যের মানুষেরা যেভাবেই সেসব জ্ঞান চুরি করে নিজেদের বলে চালিয়ে দিয়েছে। ক্রুসেডের সময় খ্রিস্টান ও ইহুদি যোদ্ধারা প্রচুর তথ্য, জ্ঞান, পুঁথিপুস্তক নিয়ে চলে এসেছিল মুসলিম পণ্ডিতদের হত্যা করে। একটা বড়ো অংশের মানুষ প্রাচীন পুঁথির মূল পাঠ করতে পারেনি দুর্বোধ্য ভাষায় কারণে। আক্রমণকারীরা সেসব পুঁথি ভাবানুবাদ করেছিল নিজেদের সুবিধামতো বর্জন সংযোজন করে। বিশেষ করে প্রাচীন প্রযুক্তগত জ্ঞান নিজেদের কাছে রেখে দিয়েছিল। আমরা যে অনুবাদ পাঠ করি, তা মূল গ্রন্থের হুবহু নয়। এমনকি আমাদের দেশীয় অনুবাদরা মূল গ্রন্থকে হুবহু অনুবাদ না করে নিজেদের মতো রচনা করেছেন। যে কারণে আমরা বহু মূল্যবান জ্ঞান থেকে বঞ্চিত। বিদেশি অনুবাদকরাও ‘উদ্ভট’ বলে বহু তথ্য সরিয়ে ফেলেছে। রামায়ণের একটা জার্মান অনুবাদ আছে। সেই অনুবাদ আক্ষরিক মোটেই নয়। অনুবাদটি পরিচ্ছেদেও বিভক্ত নয় কোনো পংক্তিরও ছাড় নেই তাতে। অনুবাদকে নাম হেরমান জ্যাকোবি। কোথাও কোনো জটিল দুর্বোধ্য অংশ দেখলেই সেই অংশ বাতিল করেছেন। যেমন–কোনো উডডীন যন্ত্রের কথা দেখতে পেলেই তিনি ভেবেছেন সেগুলো অর্থহীন। বাতিল তো করেছেই, উপরন্তু উদ্ধতভাবে বলেছেন–“ওসব অর্থহীন কচকচি’, না হয় বলেছেন ‘এ জায়গাটাকে অনায়াসে বাদ দেওয়া যেতে পারে, এখানে যত উদ্ভট কথা ছাড়া আর কিছু নেই।” পৌরাণিক যুগে আবিষ্কৃত বিমান যদি গবেষণার মধ্য দিয়ে ভারতীয়রা যেত, তাহলে রাইট ভ্রাতৃদ্বয়ের অনেক অনেক আগেই ভারতীয়রাই বিমান আবিষ্কারের কৃতিত্ব অর্জন করত। পাশ্চাত্য আবিষ্কারকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে প্রাচ্যকে অস্বীকার করা তো অনেক পুরোনো অসুখ। পাশ্চাত্য অ্যালোপ্যাথিককে যেমন প্রাধান্য দিতে গিয়ে প্রাচীন ভারতীয় আয়ুর্বেদকে সুচারুভাবে কোণঠাসা করে রাখা হয়েছে। চিকিৎসাশাস্ত্রে চরক ও সুশ্রুতের আয়ুর্বেদ প্রাচীন ভারতীয়দেরই কৃতিত্ব, সেটা অস্বীকার করা যাবে কি?
শেষ পাতে, শেষ কথা
এতক্ষণ রামায়ণ ও রামায়ণ গ্রন্থে বিভিন্ন চরিত্রগুলো বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করা হল। যে আলোচনায় নানা দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছে রামায়ণ ও রামের অস্তিত্ব নিয়ে। রামায়ণকে নানা পণ্ডিত নানাদিক থেকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন। তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলেছে দেবতার তত্ত্ব। সেই হিসাবে পুরো ঘটনাকেই সত্য বলে মানে সাধারণ মানুষ। সত্যি তো বটেই। এ আমি মোটেই দ্বিমত নই। আমি অতিরঞ্জিত সত্য। অলৌকিক কাণ্ডগুলি বা উপাদানগুলি সরিয়ে পাঠ করলে সত্যের ইতিহাস বিরিয়ে আসব। যেই সত্যকে বলতে পারেন ‘আর্যসত্য’।