রাম-সীতা অযোধ্যায় ফেরার পথে যে যে দৃশ্য দেখে সীতাকে বর্ণনা দিচ্ছিলেন, তা উপর থেকে দেখেই বলা সম্ভব, নীচ থেকে কোনোভাবেই নয়। সামান্য নমুনা দিই। রাম বলছেন–“পুষ্পকরথ মহানাদে গমনমার্গে উত্থিত হইল। তখন রাম চতুর্দিকে দৃষ্টিনিক্ষেপপূর্বক চন্দ্রাননা জানকীকে কহিলেন, প্রিয়ে ঐ দেখ … ত্রিকূটশিখরে বিশ্বকর্মানির্মিত লঙ্কাপুরী। ঐ দেখ … যুদ্ধভূমি।” ইত্যাদি ইত্যাদি। আর-একটু পড়ুন–“ঐ যে সমুদ্রে একটি অবতরণ পথ দেখিতেছ, আমরা সমুদ্র পার হইয়া ঐ স্থানে রাত্রিবাস করিয়াছিলাম। ঐ দেখ … লবণ সমুদ্রে সেতুবন্ধন করিয়াছি, ইহা নল নির্মিত ও অন্যের অসাধ্য। এই দেখ … মহাসমুদ্র … ঐ স্বর্ণবর্ণ গিরিবর মৈনাক। এই দেখ সমুদ্রের উত্তর তীরবর্তী সেনানিবেশ।” এরপর কিষ্কিন্ধ্যা নগরী, রাম দেখালেন কোথায় বালীকে হত্যা করেছিলেন। দেখা গেল ঋষ্যমূক পর্বত, যেখানে তিনি সুগ্রীবের সাক্ষাৎ পেয়েছিলেন। এরপর দৃশ্যমান হল পম্পা নদী, সীতাকে এখানে শবরী ও কবন্ধের কথা বললেন। এরপর দৃশ্যমান হল তাঁদের আশ্রমশিবির, যা এখন পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। একে একে গোদবরী, অগস্ত্যের আশ্রম, শরভঙ্গের ডেরা, চিত্রকূট পর্বত, যমুনা নদী, ভরদ্বাজের আশ্রম, পুণ্যসলিলা গঙ্গা, শৃঙ্গবের পুর, অবশেষে গন্তব্য অযোধ্যা।
বিমান যত সামনে এগিয়েছে, দৃশ্য তেমনই পালটে পালটে গেছে। বিমান বিষয়ে বিস্তারিত জানতে অবশ্যই বাল্মীকির রামায়ণটি পাঠ করতে হবে। বিকল্পে হেমচন্দ্র ভট্টাচার্যের অনূদিত বাংলা রামায়ণ পড়া যেতে পারে। এর সঙ্গে যুক্তিবাদী প্রাবন্ধিক ও রামায়ণ গবেষক বীরেন্দ্র মিত্রের রামায়ণে দেবশিবির’-ও পড়ে নিন। এরপর যদি কেউ বলেন রামায়ণের যুগে বিমান তো দূরের কথা, বিমানের জ্বণও ছিল না–তাহলে মেনে নিতে হয় রামায়ণ প্রাচীন যুগে হয়নি, এটি রচিত হয়েছে ১৯০৩ সালের পর। কারণ ১৯০৩ সালের পরই বর্তমানে যে বিমান দেখি সেই বিমান আবিষ্কার করেছেন রাইট ভ্রাতৃদ্বয়।
দানিকেন বলেন–“প্রাচীন ভারতের পুঁথিপত্রে যে বিমানের বর্ণনা পাওয়া যায়, সেই বর্ণনাকে যাঁরা নেহাত বুজরুকি মনে কতটা ভাবতে জানে সে বিষয়ে সন্দেহ থেকেই যায়। প্রাচীন পুঁথিপত্রে যেসব ‘উদ্ভট বস্তুর দেখা মেলে, অভিব্যক্তিবাদের সঙ্গে যাদের খাপ খাওয়ানো যায় না, তা থেকে আর-একটি তত্ত্বের হদিস মিললে তাকে বাজে বলে বাতিল করা হয়ে থাকে। নতুন সেই তত্ত্ব মতে মানবকদের ‘মানুষ’ করেছিল বহির্জাগতিকেরা, তাদের মস্তিষ্ককে। কিন্তু সুদীর্ঘ মানবেতিহাসের পরিপ্রেক্ষিতে সে উন্নতি ঘটেছিল, বলতে গেলে, একেবারেই হঠাৎ।”
রামায়ণের যুগে যদি বাস্তবিক বিমানের অস্তিত্ব না থাকত, তাহলে সে সময়কার মানুষ কীভাবে স্বর্গীয় যানের বর্ণনা করতে পারল এত নিখুঁতভাবে? আকাশে অর্থাৎ শূন্যে বিমানের মতো যান ওড়াতে কী কী বস্তুর প্রয়োজন, সেটাই-বা জানল কীভাবে? বিমান চালানোর যন্ত্রপাতিই-বা আসত কোথাও থেকে? যেসব ব্যোমযান স্বর্গকেও চমকে দিত, সে সব তো ছেলেখেলার বিষয় ছিল না। প্রাচীন পুঁথিগুলোতে যে স্বর্গীয় ব্যোমযানের বর্ণনা পাওয়া যায়, সেগুলি ছিল বহুতলবিশিষ্ট, সেই যানের ভিতরটা ছিল মন্দিরের মতো বিশাল। এসব তো ঘরে নিত্য ব্যবহৃত হাতা-খুন্তি-সাঁড়াশি দিয়ে বানানো সম্ভব নয়! দানিকেন বলেছেন–“নির্মাণকৌশলের দিক থেকে বিচার করলে আধুনিক স্পেস শাটলের চেয়ে ভারতীয় পুঁথিপত্রে বর্ণিত বিমানের ক্ষমতা ছিল অনেক বেশি। পৃথিবীর চারদিকে তাঁরা ঘুরে বেড়াতে পারত, আকাশে দাঁড়িয়ে থাকতে পারত, মিশে যেতে পারত তারাদের সঙ্গে এবং এমন তীব্র আলো ফেলতে পারত যে, মনে হত আকাশে দুটো সূর্য রয়েছে।” আক্ষেপের বিষয় এটাই যে, সেইসব প্রাচীন প্রযুক্তিবিদরা তাঁদের প্রযুক্তির নির্মাণ-কৌশলের বিবরণ কোথাও রেখে যাননি।
মানুষ সেই সৃষ্টির শুরু থেকে আজ পর্যন্ত যেসব স্বপ্ন দেখে আসছে তার মধ্যে আকাশে ডানা মেলার স্বপ্নই সবচেয়ে বেশি প্রাচীন। সভ্যতার শুরুতে অনেক জীবনযাপন পশুপাখির কাছ থেকে শিখেছে। মানুষের অনেক আগে পশুপাখিরা পৃথিবীতে এসেছে। মানুষই সর্বশেষ প্রাণী, যাঁরা পৃথিবীতে এসেছেন। যাই হোক, পাখিকে আকাশে উড়তে দেখে মানুষেরও সাধ হয়েছে পাখির মতোই তাঁরাও আকাশে অবাধে উড়ে বেড়াবে। তারপর দীর্ঘদিন অনেক মানুষের অনেক কষ্ট, পরিশ্রম ও ত্যাগের বিনিময়ে আজ মানুষ আকাশে চড়ে বেড়াচ্ছে। মহাশূন্য, চাঁদ জয় করে চলেছে। তবুও তার সেই প্রাচীনতম আকাঙ্ক্ষার মৃত্যু হয়নি। সে চায় আরও দৃপ্ত, আরও নিরাপদ, আরও সুনিয়ন্ত্রিত উপায়ে আকাশে ডানা মেলে বেড়াতে। আর এজন্য যথারীতি চলছে বিজ্ঞানীদের নিরলস প্রচেষ্টা কীভাবে আকাশ আরও নিরাপদ, আনন্দদায়ক ও দ্রুত করা যায় তার জন্য। আর বিজ্ঞানীদের নিরলস চেষ্টায় প্রতিনিয়তই নতুন নতুন সাফল্য এসে ধরা দিচ্ছে। তৈরি হচ্ছে বিশালাকার, দ্রুতগতির ও আরামদায়ক বিমানের।
ভেবে দেখুন, প্রাচীনকাল থেকেই মানুষ উড়ার জন্য যে কতটা ব্যাকুল ছিল তা বোঝা যায় বিভিন্ন প্রাচীন উপকথার দিকে তাকালেই। সেখানেও বিভিন্নভাবে এসেছে মানুষের আকাশে ভ্রমণের কথা। গ্রিক পুরাণের একটি গল্প শোনাই–প্রাচীন যুগে ডিডালুস ও তার ছেলে ইকারাস পাখির পালক দিয়ে ডানাসদৃশ বস্তু তৈরি করে তা মোম দিয়ে পরস্পরকে দিয়ে আকাশে উড়তে সক্ষম হয়েছিল। এইভাবে একসময় ইকারাস বেশি উপরে উঠে গেলে সূর্যের উত্তাপে তার ডানার মোম গলে গেলে তা থেকে থেকে পালক খসে পড়ে গেলে সে নদীতে পড়ে যায়।