ভোজরাজ রচিত ‘সমরাঙ্গনসূত্ৰধার’ গ্রন্থের যন্ত্রবিধান অধ্যায়ে ‘ব্যোমচারী বিহঙ্গযন্ত্র’, ‘আকাশগামী দারুময় বিমানযন্ত্র’-এর উল্লেখ আছে। তবে রামায়ণে পুষ্পক রথ ও মহাভারতে অপূর্ব নানা যন্ত্রের বর্ণনা থাকলেও তাতে ততটা বাস্তবসম্মত বর্ণনা নেই, যা এখানে আছে। এখানে পারদ ব্যবহার করে বিমান চালানোর কথা বলা হয়েছে। এই গ্রন্থে আকাশযানের বিবরণে শূন্যমার্গে যন্ত্রচালনার সমস্যা, শূন্যে অবস্থান এমনভাবে বর্ণনা করা হয়েছে যে, তখনকার দিনে শিক্ষাদান পদ্ধতি হাতেকলমে হত বোঝা যায়। ভরদ্বাজ ঋষির বিমানশাস্ত্রের উপর একটি পুরো গ্রন্থই রচনা করে রেখেছেন। গ্রন্থটির নাম ‘বৈমানিকশাস্ত্রম্’। এই গ্রন্থটি থেকে বেশ কিছু পৌরাণিক বিমানের কারিগরি সংবাদ পাওয়া যায়। বিমানের সংজ্ঞা দিয়ে ভরদ্বাজ বলেছেন–
“পৃথিব্যপস্বন্তরীক্ষে খগবদ্বেগত স্বয়ম্।
যসসমর্থো ভবদ্বম্ভং স বিমান ইতি মৃতঃ।”
অর্থাৎ যা আপন শক্তিতে পাখির মতো জলে-স্থলে-অন্তরীক্ষে বিচরণ করতে পারে তারই নাম বিমান। বিমানকে শূন্যপথে একই জায়গায় স্থির করে রাখার কৌশলের নাম–“বিমানস্তম্ভনক্রিয়ারহস্যম”। এরকম বেশ কিছু সংস্কৃত ভাষায় গ্রন্থ পাওয়া যায়, যেখানে বিমান বিষয়ক আলোচনা করা হয়েছে।
রামায়ণের যেরূপ যুদ্ধের বর্ণনা পাওয়া যায়, তা স্থলযুদ্ধ ছাড়াও বৈমানিক যুদ্ধেরও পরিচয় পাওয়া যায়। রামায়ণে উল্লেখ আছে–“ওই সময় দেবতা, গন্ধর্ব, সিদ্ধ ও চারণগণ তথায় বিমানে আরোহণপূর্বক অবস্থান করিতেছিলেন।” আর্যদেবতারা তাঁদের বিমান থেকে কী ধরনের অস্ত্র নিক্ষেপ করে খরের সেনাবাহিনী ধ্বংস করেছিলেন, সেকথা স্পষ্টতই রামায়ণে উল্লেখ আছে। খরের কাছেও বিমানযুদ্ধ মোকাবিলা করার মতো অস্ত্র যে ছিল, সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। খর অবিচলিতভাবে আকাশপথের আর্যদেবতাদের আক্রমণ প্রতিহত করতে করতে পঞ্চবটিতে প্রবেশ করেছেন এবং শেষপর্যন্ত রামশিবির আক্রমণ করতে সমর্থ হয়েছেন। যদিও শেষরক্ষা তিনি করতে পারেননি। সীতা অপহরণের সময় জটায়ুও রাবণের সঙ্গে বিমানে চেপে যুদ্ধ করেছিলেন। জটায়ুর ভগ্ন আকাশযানটি রাবণের সঙ্গে আকাশযুদ্ধের সাক্ষ্যস্বরূপ তখনও পড়ে ছিল। উল্লেখ্য, জটায়ু কোনো পাখিবিশেষ নয়। জটায়ু সম্পূর্ণভাবে মানুষ। তিনি আর্যদেবতা অরুণের ঔরসে স্যেনী বা মহাশ্বেতা নামক নারীর গর্ভজাত। জটায়ুর বড় ভাই সম্পাতি, ইনিও দক্ষ বিমানচালক ছিলেন। প্রসঙ্গত। উল্লেখ্য, জটায়ু অযোধ্যার রাজা দশরথের বিশ্বস্ত বন্ধু ছিলেন।
রামায়ণের বিমানের উপস্থিতি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষে নানাভাবে প্রকাশ করা হয়েছে। বিমানের কম্পন এবং শব্দ বা গর্জনের কথা উল্লেখ আছে। বলা হয়েছে–“ওই প্রদীপ্ত পাবকতূল্য মহাবল ঘনঘন কম্পিত হইতেছেন এবং সর্বাঙ্গের নোম স্পন্দন পূর্বক জলদগম্ভীর রবে গর্জন করিতেছেন।” ‘জলদগম্ভীর’ বলতে মেঘগর্জনই বোঝায়। বিমানের ইঞ্জিন চালু হলে মেঘগর্জনের মতোই শোনায়। রামায়ণকার হনুমানের বিমানের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেছেন–“উহার কক্ষ্যান্তরাগত বায়ু জলবৎ গম্ভীর রবে গর্জন করিতেছে।” একজন বিমানযাত্রী যেভাবে উড়তে উড়তে অপসৃয়মাণ নীচের দৃশ্যাবলি দেখেন, ঠিক সেইভাবেই হনুমান লঙ্কা দেখছিলেন। হনুমানের লংকা দেখার বিবরণ ঠিক সেইভাবেই দেওয়া হয়েছে। হনুমানের ক্ষুদ্র থেকে বৃহদাকার এবং বৃহদাকার থেকে ক্ষুদ্র হয়ে যাওয়াটি বিমানের ভিতর প্রবেশ ও প্রস্থানের চিত্রটিই প্রকট হয়। সীতার অন্বেষণ করে ফেরার পথে হনুমান বিমানে চড়েছেন কথা বর্ণনাতেই আছে। গমনে আর আগমনে এরকম বর্ণনা বিমানে চেপে সমুদ্র লঙ্ঘন করেছিলেন এটাই প্রমাণ হয়। সেই বিমানের শব্দ শুনে অঙ্গদবাহিনী কী বলছে কবির লেখনীতে জানা যাক–“দূর হইতে বায়ু ক্ষুভিত মেঘের গভীর নির্ঘোষের ন্যায় উহার … সিংহনাদ শুনিতে পাইল। এই শব্দ শুনিবামাত্র সকলেই উহাকে দেখিবার নিমিত্ত ব্যগ্র হইয়া উঠিল।”
কুম্ভকর্ণও ‘কুম্ভকর্ণ’ নামক বিমানে চড়েই হনুমানের সঙ্গে যুদ্ধ করেছেন এমন বর্ণনাই আছে। প্রাচীনকালে যিনি বিমানের মালিক বা চালক তাঁর নামেই বিমানের নাম হত। যেমন কুম্ভকর্ণ-বিমান, ইন্দ্রজিৎ-বিমান, হনুমান বিমান, গরুড়-বিমান, ইন্দ্র-বিমান ইত্যাদি। ইন্দ্রজিৎও বিমানে চড়ে যুদ্ধ করেছিলেন এবং বিমানেই ‘ড্যামি’ সীতাকে এনেছিলেন রণক্ষেত্রে এবং বিমানেই তাঁকে খাঘাত করে হত্যা করেছেন। লক্ষ্মণ হনুমান-বিমানে চড়ে বিমানারূঢ় ইন্দ্রজিতের সঙ্গে যুদ্ধ করেছেন। বাল্মীকি বলেছেন–“উঁহারা অন্তরীক্ষগত দুইটি গ্রহের … ঘোরতর যুদ্ধ করিতে লাগিলেন।” রাবণও বিমানে চড়েই যুদ্ধ করেছেন। সে সময় ইন্দ্র-বিমানে চড়ে ইন্দ্র উপস্থিত হলে ইন্দ্রের চালক মাতলি রামকে বিমানে তুলে নিয়েছিলেন। রামকে ঘিরে “বিমানচারী দেব, দানব, গন্ধর্ব, উরগ, ঋষি”-রাও রণস্থলের উপর অবস্থান করছিলেন। লঙ্কাযুদ্ধের পর সীতাকে নিয়ে রাম বিমানেই। অযোধ্যায় ফিরেছিলেন। শুধু রাম-সীতাই নয়, অন্য বিমানে চড়ে হনুমান-লক্ষ্মণ-সুগ্রীব-জাম্ববান-বিভীষণ সকলেই রামের সঙ্গে এসেছিলেন। এ বিষয়ে বাল্মীকির রামায়ণে পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা আছে।