আর্যসমাজের খাদ্য : তণ্ডুল সিদ্ধ বা ভাত, সঙ্গে নানাবিধ ব্যঞ্জন, যব, গম, মিষ্টি, হরিণ, ময়ূর, শর্করা, আখের রস, মধু, মদ, দই, দুধ, ডাল, চণক বা ছোলা, কুলখ বা কলাই, কৃশর বা খিচুড়ি, পিষ্টক বা পিঠা, ভোজ্যতেল, সুগন্ধি তেল, সৌরের মদ, সৌরীক মদ, সুরা ইত্যাদি। রাম-লক্ষ্মণরা মৃগয়া থেকে প্রাপ্ত শুয়োর, ঋষ্য বা কৃষ্ণসার হরিণ, পৃষৎ, গন্ডার, শল্যকী বা শজারু, গোধা বা গোসাপ, খরগোশ, কচ্ছপ, মহারুরু ও পাখির মাংস খাওয়ার প্রচলন ছিল।”পঞ্চ পঞ্চক্ষা ভক্ষ্যা ব্ৰহ্মক্ষত্রেণ রাঘবা/শল্যকঃ শ্বাবিধো গোধা শশ কূৰ্মশ্চ পঞ্চম৷”–এই পাঁচটি ছাড়া অন্য পঞ্চনখ বিশিষ্ট প্রাণী অভক্ষ্য ছিল। ছাগলের মাংস, পায়েস, খিচুড়ি যজ্ঞ ছাড়া নিষিদ্ধ, অভক্ষ্য–“পায়সং কৃশরং ছাগং বৃথা সোহশ্নাতু নির্ঘণঃ।” হুইলার প্রমুখ সাহেবরা রামায়ণের যুগে যে গো-মাংস ভক্ষণের ব্যবস্থা ছিল, একথা উল্লেখ করতে দ্বিধা করেননি।
বানরদের খাদ্য : মধু, ফলমূল, নিবার ধানের কাঞ্জিক, মদ, পশুপক্ষীর মাংস ইত্যাদি।
মুনিঋষিদের খাদ্য : বিশ্ব বা বেল, কপিঙ্খ বা কয়েতবেল, পনস বা কাঁঠাল, বীজপুরক, আমলকী, আম, কন্দমূল, মেষ, হবিষ্যান্ন, মাংস ইত্যাদি।
রামায়ণে বিমানের ব্যবহার
রামায়ণের যুগে কি বিমানের ব্যবহার ছিল? বাল্মীকির রামায়ণের কিন্তু বহু জায়গায় বিমানের উল্লেখ আছে। ২৪,০০০ শ্লোকে লেখা রামায়ণ দেবতাদের মহাকাশ পরিক্রমা বিবরণে সমৃদ্ধ। রামায়ণে এমন একটি আশ্চর্যজনক রথের উল্লেখ আছে, তা পাঠ করে মনে হয় রথ এক মহাকাশযান। সেই রথ আকাশে বিচরণ। করছে একসঙ্গে অনেকগুলো লোক নিয়ে। সেই যানের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে ‘উড়ন্ত পিরামিড’ বলে, যা উল্লম্বভাবে আকাশে উঠত। নিঃসন্দেহে মাটি ছেড়ে আকাশে ওঠার সময় সেই যান বিকট শব্দ করত। বাল্মীকি রামায়ণের বর্ণনায়–“প্রভাত উদয়ে রামচন্দ্র সেই স্বর্গীয় বিমানে আরোহণ করিলেন। যানের অসীম শক্তি। বিমানটি দ্বিতল, তাহাতে বহু বিভাগ এবং অসংখ্য গবাক্ষ ছিল। … বিমানটি সুশোভিত এবং শক্তিশালী ছিল। … তাহা যখন আকাশমার্গে গমন করিল, তখন তাহা হইতে স্বর্গীয় শব্দ প্রকাশিত হইতে লাগিল।” সংস্কৃত ভাষায় রচিত ‘সমরাঙ্গনসূত্রধার’ নামে এই প্রাচীন গ্রন্থটি বিমান নিয়ে লিখেছে–“দেহটি যেন বেশ শক্তসামর্থ্য, টেকসই এবং যথেষ্ট স্বল্পভার বস্তু দিয়ে গঠিত হয়। … পারদে যে শক্তি সুপ্ত রয়েছে, তাকে জাগিয়েই মানুষ দূর-দূরান্তের আকাশ পাড়ি দিতে পারে। পারদই বিমানের চালিকাশক্তি। চেষ্টা করলে দেবমন্দিরের মতো বিশাল বিমানও গঠন করা সম্ভব। বিমানের মধ্যে পারদের চারটি আধার থাকবে। তারপর লৌহের আধার থেকে নিয়ন্ত্রিত অগ্নিসংযোগে পারদ থেকে বিদ্যুৎশক্তি লাভ করে বিমান যখন ঊধ্বাকাশে উঠে যাবে, তখন তাকে দেখলে মনে হবে যেন একটি উজ্জ্বল মুক্তাবিন্দু।”
রামায়ণে কোথাও উড্ডীন যন্ত্র, কোথাও স্বর্গীয় যান বা কোথাও দেবযান বলে উল্লেখ আছে। অরণ্যকাণ্ডে বলা হয়েছে, দুবৃত্ত রাবণ ঠিক কেমন করে সূর্য সদৃশ বিমানে মনোরমা সীতাকে অপহরণ করে নিয়ে গিয়েছিল। সেই বিমান উড়ল উপত্যকা, বন-উপবন, পাহাড়-পর্বত অতিক্রম করে। বানররাজ হনুমান ছিলেন ব্যোমযান চালক হিসাবে অসমসাহসী। বাল্মীকির বয়ানে রামায়ণ বলছে–“তিনি যখন পর্বত শীর্ষ হইতে ব্যোমযান চালনা করেন, তখন পর্বতশীর্ষ ভাঙিয়া পড়ে, তাহার ভিত্তি কম্পিত হইতে থাকে, সুবিশাল তরুশ্রেণি শাখাপ্রশাখাহীন হইয়া ভাঙিয়া পড়ে, শাখা-প্রশাখা-কাণ্ড-পত্রের বৃষ্টি ঝরিতে থাকে, পর্বতের পক্ষিকুল এবং জীবজন্তু তাহাদের গুপ্ত আশ্রয়ে পলাইয়া যায়।”
আর্য, অনার্য, রাক্ষস, বানর, হনুমান সকলেই বিমানের ব্যবহার করেছেন বলে জানা যাচ্ছে বাল্মীকির রামায়ণে। বাল্মীকির রামায়ণে কুম্ভকর্ণ, রাবণ, ইন্দ্রজিৎ প্রমুখরা বিমানে চড়ে যুদ্ধ করেছেন বলে জানা যায়। ইন্দ্রজিতের সঙ্গে লক্ষ্মণের যুদ্ধ উভয় উভয়ের বিমান থেকেই হয়েছে। ইন্দ্রজিতের অন্য নাম মেঘনাদ। তার কারণ তিনি মেঘের আড়াল থেকে যুদ্ধ করতে পারতেন। মেঘের আড়াল থেকে যুদ্ধ করা সম্ভব একমাত্র বিমানে চড়লেই–বিমান কখনো মেঘের নীচে, কখনো মেঘের নীচে, এ তো হয়েই থাকে। রাবণও রামের (মতান্তরে ইন্দ্রের সঙ্গে) সঙ্গে যুদ্ধ করেছেন বিমানে চড়েই। হনুমান লঙ্কায় অশোকবনে সীতার সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে অপদস্থ হয়ে ফেরার সময় বিমানে চড়ে রামশিবিরে ফেরেন বলে জানা যায়। বাল্মীকির রামায়ণ থেকে আরও জানা যায়, তাড়কার সঙ্গে যুদ্ধের সময় আর্যদেবতারা তাঁদের ‘উড়ন্ত রথে চেপে সমরাঙ্গনের উপর চক্কর দিচ্ছিলেন। আকাশপথ থেকে তাঁরাও তাড়কাসৈন্যদের হত্যা করেছেন। দণ্ডকারণ্যে অগ্নিদাহনের সময়ও উড়ন্ত অবস্থায় ইন্দ্র নাগকুল নিকেষ করেছিলেন। মরু ও গন্ধর্বরাও আকাশপথ থেকে আগ্নেয়াস্ত্র নিক্ষেপ করতেন। মরুরা তো জলে-স্থলে-আকাশে বিচরণশালী দুর্ধর্ষ যোদ্ধারূপেই প্রাচীন যুগে প্রসিদ্ধি লাভ করে। বিষ্ণুরও আকাশযান বা বিমান ছিল, তাঁর বিমানচালক গরুড়। বাল্মীকির রামায়ণে বিরাধ-যানেরও উল্লেখ আছে, যে যানের চালক গন্ধর্বজাতি তুম্বুরু। ‘উড়ন্ত যান’ পরশুরামেরও ছিল, যে যান ‘প্রচুর হাওয়া ছুটিয়ে গাছের ডালপালা ভেঙে মেঘগর্জনের গম্ভীর শব্দ তুলে’ অবতরণ করেছিল।