মহাভারত অনুসারে, যোগবলে যাঁরা বিশুদ্ধচিত্ত লাভ করেছেন তাঁরা গো-হত্যা করলে কোনো পাপ হয় না–“যাহারা যোগবলে এইরূপ বিশুদ্ধচিত্ত হইয়াছেন, তাহারা যোগবলে গো-হত্যা করিলেও করিতে পারেন। কারণ তাহাদিগকে গো-বধজনিত পাপে লিপ্ত হইতে হয় না।” (শান্তিপর্ব/২৬৩) নহুষের গো-বধ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে–“রাজপুরোহিত, স্নাতক ব্রাহ্মণ, গুরু ও শ্বশুর এক বৎসর গৃহে বাস করিলেও মধুপর্ক দ্বারা তাহাদিগের পূজা করা কর্তব্য”। (অনুশাসন/৯৭) প্রাচীনকালে অতিথিদের মধুপর্ক দ্বারা আপ্যায়ণ করার বিধান ছিল। মধুপর্কে গো-মাংসের প্রয়োজন হত। মহাভারতে মধুপর্কের জন্য নহুষের গো-বধ করার কথা পাওয়া যায়। তবে নহুষের সময়ের ঋষিরা নহুষের এই কর্মের বিরোধিতাও করেন–“পূর্বে মহারাজ নহুষ মধুপর্ক দান সময়ে গো-বধ করাতে মহাত্মা তত্ত্বদর্শী ঋষিগণ তাহারে কহিয়াছিলেন, মহারাজ তুমি মাতৃতুল্য গাভী ও প্রজাপতিতুল্য বৃষকে নষ্ট করিয়া যাহার পর নাই গর্হিত কার্যের অনুষ্ঠান করিয়াছ; অতএব তোমার যজ্ঞে হোম করিতে আমাদের প্রবৃত্তি নাই, তোমার নিমিত্ত আমরা অতিশয় ব্যথিত হইলাম।” (শান্তিপর্ব/২৬২)
শান্তিপর্বের ২৬৮ তম অধ্যায়েও নহুষের গোবধের কথা পাওয়া যায়। এখানে নহুষ গোহত্যা করতে গেলে কপিল ঋষি তাঁর বিরোধ করেন। তা নিয়ে স্মরশ্মি ঋষি ও কপিল ঋষির মধ্যে এক দীর্ঘ তর্কের সূচনা হয়–“একদা মহর্ষি তৃষ্টা নরপতি নহুষের গৃহে আতিথ্য স্বীকার করিলে তিনি শাশ্বত বেদ বিধানানুসারে তাহারে মধুপর্ক প্রদানার্থ গো-বধ করিতে উদ্যত হইয়াছেন, এমন সময়ে জ্ঞানবান সংযমী মহাত্মা কপিল যদৃচ্ছাক্রমে তথায় সমাগত হইয়া নহুষকে গো-বধে উদ্যত দেখিয়া স্বীয় শুভকরি নৈষ্ঠিক বুদ্ধিপ্রভাবে, “হা বেদ!” এই শব্দ উচ্চারণ করিলেন। ঐ সময় স্মরশ্মি নামে এক মহর্ষি স্বীয় যোগবলে সেই গো-দেহে প্রবিষ্ট হইয়া কপিলকে সম্বোধনপূর্বক কহিলেন, “মহর্ষে! আপনি বেদবিহিত হিংসা অবলোকন করিয়া বেদে অবজ্ঞা প্রদর্শন করিলেন, কিন্তু আপনি যে হিংসাশূন্য ধর্ম অবলম্বন করিয়া রহিয়াছেন, উহা কি বেদবিহিত নহে? ধৈর্যশালী বিজ্ঞানসম্পন্ন তপস্বীরা সমুদায় বেদকেই পরমেশ্বরের বাক্য বলিয়া কীর্তন করিয়াছেন। পরমেশ্বরের কোনো বিষয়েই অনুরাগ, বিরাগ বা স্পৃহা নাই। সুতরাং কী কর্মকাণ্ড, কী জ্ঞানকাণ্ড তাহার নিকট উভয়ই তুল্য। অতএব কোনো বেদই অপ্রমাণ হইতে পারে না।” স্মরশ্মির কথার প্রত্যুত্তরে কপিল বলেন–“আমি বেদের নিন্দা করিতেছি না এবং কর্মকাণ্ড ও জ্ঞানকাণ্ড এই উভয়বিধ বেদের তারতম্য নির্দেশ করাও আমার অভিপ্রেত নহে। কী সন্ন্যাস, কী বানপ্রস্থ, কী গার্হস্থ, কী ব্রহ্মচর্য লোকে যে ধর্ম অনুসারে কার্য করুন না-কেন, পরিণামে অবশ্যই তাহার গতিলাভ হইয়া থাকে। সন্ন্যাসাদি চারিপ্রকার আশ্রমবাসীদিগের চারি প্রকার গতি নির্দিষ্ট আছে। তন্মধ্যে সন্ন্যাসী মোক্ষ, বানপ্রস্থ ব্ৰহ্মলোক, গৃহস্থ স্বর্গলোক এবং ব্রহ্মচারী ঋষিলোক লাভ করিয়া থাকেন। বেদেকার্য আরম্ভ করা ও না-করা উভয়েরই বিধি আছে। ঐ বিধি দ্বারা কার্যের আরম্ভ ও অনারম্ভ উভয়ই দোষাবহ বলিয়া প্রতিপন্ন হইতেছে। সুতরাং বেদানুসারে কার্যের বলাবল নির্ণয় করা নিতান্ত দুঃসাধ্য। অতএব যদি তুমি বেদশাস্ত্র ভিন্ন যুক্তি বা অনুমান দ্বারা অহিংসা অপেক্ষা কোনো উৎকৃষ্ট ধর্ম স্থির করিয়া থাক, তাহা কীর্তন করো।”
তবে ব্রাহ্মণ্য ধর্মাবলম্বীরা একটা সময় গো-মাংস খাওয়া ত্যাগ করেছিল, সেটারও উল্লেখ পাই মহাভারতে।
উল্লেখ আছে–“পূর্বকালে মহাত্মা রন্তিদেব স্বীয় যজ্ঞে গোসমুদায়কে পশু রূপে কল্পিত করিয়া ছেদন করাতে উহাদিগের চর্মরসে চর্মণবতী নদী প্রবর্তিত হইয়াছে। এক্ষণে উহারা আর যজ্ঞীয় পশুত্বে কল্পিত হয় না। উহারা এক্ষণে দানের বিষয় হইয়াছে।” (অনুশাসন/৬৬)।
রামায়ণের মুনিঋষিরাও ব্যাপক মাংস পছন্দ করতেন এবং ভক্ষণ করতেন। মৃত্যুশয্যায় কিষ্কিন্ধ্যার রাজা বালী রামকে বলেছেন–আমাকে মেরে তোমার কী লাভ হল? আমার মাংস তোমার খাওয়া চলবে না। কারণ ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয়রা একযোগে যে পাঁচনখওয়ালা প্রাণীর মাংসগুলি খায়–তা হল শজারু, গোসাপ, খরগোস আর কচ্ছপের মাংস (“পঞ্চ পঞ্চখা ভক্ষ্যা ব্ৰহ্মক্ষত্রেণ রাঘব।/শল্যকঃ শ্বাবিধো গোধা শশঃ কূর্মশ্চ পঞ্চম্।”)। বনবাসের তৃতীয় দিনে সারথি সুমন্ত্র ও বন্ধু গুহককে বিদায় দিয়ে অরণ্যের গভীরে প্রবেশ করে হরিণ, শুয়োর মেরে নিলেন–
“তৌ তত্র হত্বা চতুরো মহামৃগান্ বরাহমৃষ্যং পৃষং মহাররুম।”
রাম মদও খেতেন। বাল্মীকি তাই-ই বলছেন। লঙ্কার অশোকবনে সীতাকে রামের খবর দিয়ে হনুমান বলছেন–
“ন মাংসং রাঘববা ভুঙক্তে ন চৈবং মধু সেবতে।”
সীতা নেই মদ খাওয়াও নেই। অর্থাৎ সীতা যখন কাছে ছিলেন তখন মদ-মাংস দুইই চলত। রামই শুধু নয়–সীতা, কৌশল্যা, কৈকেয়ী সকলেরই মদ্যপানের অভ্যেস ছিল। রামায়ণে বাল্মীকি অন্যান্য সম্প্রদায়ের খাদ্যাভাস কী ছিল, সেটাও বর্ণনা করেছেন।
রাক্ষসদের খাদ্য (লঙ্কার বাসিন্দা) : গন্ডারের মাংস, গিরগিটি, হরিণের মাংস, ময়ূরের মাংস, কুকুটের মাংস, ছাগলের মাংস, শুয়োরের মাংস, খরগোশ, মাছ, মহিষের মাংস, মদ, ভাত, রক্ত ইত্যাদি। পাঠক লক্ষ করুন, রাক্ষসদের খাদ্যতালিকায় যেসব খাদ্য রামায়ণের কবি উল্লেখ করেছেন, তা তো মানুষেরই খাদ্য। মানুষ তো সাপ, ব্যাঙ, আরশোলা, মুরগি তিমি, হাঙর, কচ্ছপ, শুয়োর সব খায়। তাহলে রাক্ষস কী অপরাধ করল! রাক্ষসরা তো মানুষই।