মহাভারতে শ্রাদ্ধেও গো-মাংস দেওয়ার কথা বলা আছে–“শ্রাদ্ধকালে যে সমস্ত ভোজ্য প্রদান করা যায়, তন্মধ্যে তিলই সর্বপ্রধান। শ্রদ্ধে মৎস্য প্রদান করিলে পিতৃগণের দুই মাস, মেষমাংস প্রদান করিলে তিন মাস, ও শশ মাংস প্রদান করিলে চারি মাস, অজমাংস প্রদান করিলে পাঁচ মাস, বরাহ মাংস প্রদান করিলে ছয় মাস, পক্ষীর মাংস প্রদান করিলে সাত মাস, পৃষৎ নামক মৃগের মাংস প্রদান করিলে আট মাস, রুরু মৃগের মাংস প্রদান করিলে নয় মাস, গবয়ের মাংস প্রদান করিলে দশমাস, মহিষ মাংস প্রদান করিলে একাদশ মাস এবং গো-মাংস প্রদান করিলে এক বৎসর তৃপ্তি লাভ হইয়া থাকে। ঘৃত পায়স গো-মাংসের ন্যায় পিতৃগণের প্রীতিকর; অতএব শ্রাদ্ধে ঘৃতপায়েস প্রদান করা অবশ্য কর্তব্য। …” (অনুশাসন/ ৮৮)
রাজশেখর বসুর মহাভারতের সারানুবাদেও গো-মাংসের উল্লেখ মেলে। রাজশেখরের সারানুবাদে (সভাপর্ব/২) আছে, দেবর্ষি নারদ পারিজাত, রৈবত, সুমুখ ও সৌম্য এই চারজন ঋষির সাথে পাণ্ডবদের সভায় উপস্থিত হলে যুধিষ্ঠির তাদের গো-মধুপর্ক দিয়ে আপ্যায়ণ করেন–“একদিন দেবর্ষি নারদ পারিজাত, রৈবত, সুমুখ ও সৌম্য এই চারজন ঋষির সাথে পাণ্ডবদের সভায় উপস্থিত হলেন। যুধিষ্ঠির যথাবিধি অর্ঘ্য, গো-মধুপর্ক ও রত্নাদি দিয়ে সংবর্ধনা করলে নারদ প্রশ্নচ্ছলে ধর্ম, কাম ও অর্থ বিষয়ক এই প্রকার বহু উপদেশ দিলেন–মহারাজ, তুমি অর্থচিন্তার সাথে ধর্মচিন্তাও কর তো? কাল বিভাগ করে সমভাবে ধর্ম, অর্থ ও কামের সেবা করো তো?”
বিষ্ণুপুরাণের তৃতীয় অংশের ১৬ তম অধ্যায়ে আছে—
“ঔৰ্ব্ব উবাচ। “হবিষ্যমৎস্যমাংসৈস্তু শশস্য শকুনস্য চ।
শৌকরচ্ছাগলৈরৈণৈ-রৌরবৈর্গবয়েন চ।১
ঔরভ্রগব্যৈশ্চ তথা মাংসবৃদ্ধ্যা পিতামহাঃ।/প্রয়ন্তিতৃপ্তিং মাংসৈস্তু নিত্যং বার্ধণসামিষৈঃ।২
খামাংসমতিবাত্র কালশাকং তথা মধু।/শস্তানি কৰ্ম্মণ্যত্যন্ততৃপ্তিদানি নরেশ্বর। ৩”
অর্থাৎ, ঔৰ্ব্ব কহিলেন, শ্রাদ্ধের সময় ব্রাহ্মণদিগকে হবিষ্য করাইলে পিতৃগণ একমাস পরিতৃপ্ত থাকেন, মৎস্য দিলে দুইমাস, শশমাংস দিলে তিনমাস, পক্ষী মাংস দিলে চারি মাস, শূকর মাংস দিলে পাঁচ মাস, ছাগমাংস দিলে ছয়মাস, এণ নামক হরিণ মাংস দিলে সাত মাস, রুরুমৃগমাংস দিলে আট মাস, গবয় মাংস দিলে নয় মাস, মেষ মাংস দিলে দশ মাস, গোমাংস দিলে এগারো মাস পিতৃগণ পরিতৃপ্ত থাকেন। পরন্তু যদি বার্ধীণস মাংস দেওয়া যায়, তাহা হইলে পিতৃলোকের তৃপ্তির আর শেষ নাই। রাজন! গণ্ডারের মাংস, কৃষ্ণশাক ও মধু এই সমস্ত দ্রব্য শ্রাদ্ধ কর্মে অত্যন্ত প্রশস্ত ও যারপরনাই তৃপ্তিদায়ক। ( শ্রীবরদাপ্রসাদ বসাক কর্তৃক প্রকাশিত) এই অংশের টীকায় যা বলেছেন অনুবাদক, তা বেশ আগ্রহোদ্দীপক–“গব্য শব্দ থাকাতে কেহ কেহ গো-মাংস না-বলিয়া পায়স অর্থ করেন। এ অর্থ অযৌক্তিক, কারণ পায়স বা দুগ্ধ কখনো মাংস মধ্যে পরিগণিত হইতে পারে না। বিশেষত যখন গবয় মাংস, শূকর মাংস ভক্ষণ করিয়া পরিতৃপ্ত হইতেছেন, তখন গোমাংস ভক্ষণে বাঁধা কী? ফলত কলির পূর্বে গো-মাংস ভক্ষণ প্রচলিত ছিল। মহাভারতে ষোড়শ রাজিক স্থলে কথিত আছে, রন্তিদেব প্রতিদিন দুই সহস্র গো হত্যা করিয়া তাহার মাংস ব্রাহ্মণদিগকে ভোজন করাইতেন। বশিষ্ঠ বাল্মীকির আশ্রমে গমন করিলে তাঁহাকে একটি বৎসতরী ভোজনার্থ দেওয়া হয়। জনমেজয়ও বেদব্যাসকে একটি বৎস ভোজনার্থ দিয়াছিলেন, বেদব্যাস দয়া করিয়া তাহাকে ছাড়িয়া দিলেন। এরূপ গোমাংস ভক্ষণের অনেক প্রমাণ পাওয়া যায়।” পণ্ডিতপ্রবর শ্রীযুক্ত পঞ্চানন তর্করত্ন কর্তৃক সম্পাদিত বিষ্ণুপুরাণের অনুবাদ করে লিখেছে–“ ঔৰ্ব্ব কহিলেন, শ্রাদ্ধের দিনে ব্রাহ্মণদিগকে হবিষ্য করাইলে, পিতৃগণ একমাস পর্যন্ত পরিতৃপ্ত থাকেন, মৎস্য প্রদানে দুইমাস, শশক মাংস প্রদানে তিন মাস, পক্ষী মাংস প্রদানে চারিমা, শূকর মাংস প্রদানে পাঁচ মাস, ছাগ মাংস প্রদানে ছয় মাস, এণ মাংস দিলে সাত মাস, রুরুমৃগমাংস প্রদান করিলে আট মাস, গবয় মাংস প্রদানে নয় মাস, মেষমাংস প্রদানে দশ মাস, গো-মাংস প্রদান করিলে এগার মাস পর্যন্ত পিতৃগণ পরিতৃপ্ত থাকেন। পরন্তু যদি বাণস মাংস দেওয়া যায়, তাহা হইলে পিতৃলোক চিরদিন তৃপ্ত থাকেন। হে রাজন! গণ্ডারের মাংস, কৃষ্ণশাক ও মধু এই সমুদায় দ্রব্য শ্রাদ্ধকর্মে অত্যন্ত প্রশস্ত ও অত্যন্ত তৃপ্তিদায়ক।” (শ্রীনটবর চক্রবর্তী দ্বারা মুদ্রিত ও প্রকাশিত) শ্রী রাম সেবক বিদ্যারত্ন বিষ্ণু পুরাণের আলোচ্য অংশের অনুবাদে লিখেছেন–“হে মহারাজ! যে যে মাংস দ্বারা পিতৃগণের তৃপ্তি লাভ হয়, তাহা আপনার নিকট কীর্তন করিতেছি শ্রবণ করুন। শশক, শকুল, বন্য শূকর, ছাগ, হরিণ, রুরু নামক মৃগ, গবয়, মেষ, গো, বার্ধণস ও গণ্ডারদিগের মাংস পিতৃগণের অতিশয় প্রীতিকর।”
রাজশেখর বসুর মহাভারতের সারানুবাদে (উদ্যোগ পর্ব/৮) আছে প্রহ্লাদ সুধম্বাকে গো-মাংস দিয়ে সংবর্ধনা করতে চেয়েছিলেন। সেখানে বলা হয়েছে–“… দুজনে প্রহ্লাদের কাছে উপস্থিত হলেন। প্রহ্লাদ বললেন তোমরা পূর্বে কখনো একসঙ্গে চলতে না, এখন কি তোমাদের সখ্য হয়েছে? বিরোচন বললেন, পিতা সখ্য হয়নি, আমরা জীবন পণ রেখে তর্কের মীমাংসার জন্য আপনার কাছে এসেছি। সুধম্বার সংবর্ধনার জন্য প্রহ্লাদ পাদ্য জল, মধুপর্ক ও দুই স্কুল শ্বেত বৃষ আনতে বললেন। সুধম্বা বললেন, ওসব থাকুক, আপনি আমার প্রশ্নের যথার্থ উত্তর দিন–ব্রাহ্মণ শ্রেষ্ঠ না বিরোচন শ্রেষ্ঠ? “