এছাড়া রাম যখন ভরদ্বাজ মুনির আশ্রমে গিয়ে উপস্থিত হন তখন ভরদ্বাজ তাঁকে গোরু দ্বারা আপ্যায়ণ করেছিলেন—
“তস্য তদ্বচনং শ্রুত্বা রাজপুত্রস্য ধীমতঃ।
উপিনয়ত ধর্মাত্মা গামৰ্ঘমুদকং ততঃ। ১৭
নানাবিধাননুরসান বন্যমূলফলায়ান। ভেভ্যো দদৌ তপ্ততপা বাসঞ্চৈবাভ্যকল্পয়ৎ। ১৮
মৃগপক্ষিভিরাসীনো মুনিভিশ্চ সমন্ততঃ।
রামমাগতমভ্যচ্চ স্বাগতেনাগতৎ মুনিঃ। ১৯
প্রতিগৃহ্য তু তামর্জাপুবিষ্টং স রাঘবম্।
ভরদ্বাজোহব্ৰবীদ্বাক্যং ধৰ্ম্মযুক্তমিদং তদা। ২০
চিরস্য খলু কাকুৎস্থ পশ্যাম্যহমুপাগতম্।
তং তব ময়া চৈব বিবাসনমকারণম্। ২১”
– অর্থাৎ “মুনি, পক্ষী ও মৃগগণে চতুর্দিকে পরিবৃত হইয়া সমাসীন সেই সতত-তপোনুষ্ঠায়ী ধর্মাত্মা ভরদ্বাজ ঋষি সম্যক পরিজ্ঞাত ধীমান রাজনন্দন রামের কথা শুনিয়া তাহাকে “তুমি তো সুখে আসিয়াছ?” বলিয়া অর্চনা করত অর্ঘ্য উদক ও গো উপঢৌকন দিলেন। পরে তিনি তাহাদিগকে ফলমূলসস্তৃত নানাবিধ ভোজ্য প্রদান করিয়া তাহাদিগের বাসস্থান নিরূপণ করিলেন। পরে রঘুনন্দন রাম সেই সকল দ্রব্য প্রতিগ্রহ করিয়া উপবিষ্ট হইলে, ভরদ্বাজ ঋষি তাহাকে এই ধর্মযুক্ত কথা বলিলেন–“ কাকুৎস! তোমাকে সমাগত দেখিয়া, আমার বহু কালের ইচ্ছা পূর্ণ হইল! তুমি যে অকারণে বিবাসিত হইয়াছ, তাহাও আমি শুনিয়াছি… (বাল্মীকি রামায়ণ/ অযোধ্যা কাণ্ড/ ৫৪ সর্গ; অনুবাদক পঞ্চানন তর্করত্ন)। হেমচন্দ্র ভট্টাচার্যের অনুবাদে আছে–“মহর্ষি ভরদ্বাজ রামের এইরূপ বাক্য শ্রবণ করিয়া তাহাকে স্বাগতপ্রশ্ন পূর্বক অর্ঘ্য, বৃষ, নানাপ্রকার বন্য ফলমূল ও জল প্রদান করিলেন এবং তাহার অবস্থিতির নিমিত্ত স্থান নিরূপণ করিয়া অন্যান্য মুনিগণের সহিত তাহাকে বেষ্টনপূর্বক উপবিষ্ট হইলেন।” রাজশেখর বসু এই অংশের অনুবাদে লিখেছেন–“কিছুদূর যাওয়ার পর তাঁরা ভরদ্বাজ ঋষির আশ্রমে উপস্থিত হলেন। শিষ্য পরিবৃত ভরদ্বাজকে প্রণাম করে রাম নিজের পরিচয় দিলেন। ভরদ্বাজ তাঁদের স্বাগত জানিয়ে অর্ঘ্য, বৃষ, জল ও বন্য ফলমূল প্রভৃতি আহার্য দিয়ে বললেন–কাকুৎস, বহুদিন পরে তোমাকে এখানে দেখছি। তোমার নির্বাসনের কারণ আমি শুনেছি। দুই মহানদীর এই সঙ্গমস্থান অতি নির্জন, পবিত্র ও রমণীয় তুমি এখানে সুখে বাস কর।”
রাজশেখর বসুর এই অনুবাদে আমরা বৃষকে (ষাঁড়) আহার্য হিসাবে পাচ্ছি, যা রামচন্দ্র ও তাঁর সঙ্গীদের ভক্ষণের জন্য প্রদান করছেন ভরদ্বাজ ঋষি। তবে প্রাচীন যুগে গোরুকে মূল্যবান সম্পদ হিসাবে দেখা হত, বলা হত ‘গো-ধন’। যাঁর গোরু যত সংখ্যক, সে তত ধনবান বলে মনে করা হত। গোরু চুরি এবং গোরু চুরিকে কেন্দ্র করে যুদ্ধ পর্যন্ত বেধে যেত। সম্পদ হিসাবে গো-দানকে শ্রেষ্ঠ দান বলে মনে করা হত। তাই কোনো শুভ কাজে ব্রাহ্মণদের রাজারা প্রচুর গো-দান করত আনুষ্ঠানিকভাবে এই কাজকে পুণ্যকাজ বলে মনে করা হত। কিছুদিন আগে পর্যন্ত শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে ব্রাহ্মণদের স্ববৎস গো-দানের রীতি প্রচলন ছিল।
প্রাচীন যুগে গো-দানের মতো গো-মাংস ভক্ষণেরও রীতি ছিল। বেদের যুগ থেকে গো-মাংস ভক্ষণের সূত্র পাওয়া যায়। বেদ-পরবর্তী রামায়ণ যুগে গো-মাংস নিষিদ্ধ হয়েছিল, এমন কোনো সূত্র পাওয়া যায় না। রামায়ণ-পরবর্তী মহাভারত যুগে মহাভারতের নানাস্থানেই গো-হত্যা ও গো-মাংস ভক্ষণের কথা পাওয়া যায়। রন্তিদেবের ভোজনশালায় রন্তিদেব নামে এক ধার্মিক রাজার কথা বারবার মহাভারতে উল্লেখ আছে। তিনি প্রচুর পশু হত্যা করে মানুষদের খাওয়াতেন। আশ্চর্যজনকভাবে সেই পশুগুলোর মধ্যে প্রচুর গোরুও ছিল। আর সেই গো-মাংস খাওয়ার জন্য মানুষের লাইন পড়ে যেত। পাঁচকেরা তখন বাধ্য হয়ে বলতেন বেশি করে ঝোল নিতে, কারণ খুব বেশি মাংস নেই।
কালিপ্রসন্নের মহাভারতের বনপর্বের ২০৭ তম অধ্যায়ে বলা হয়েছে–“পূর্বে মহারাজ রন্তিদেবের মহানসে প্রত্যহ দুই সহস্র পশু হত্যা করিয়া প্রতিদিন অতিথি ও অন্যান্য জনগণকে সমাংস অন্নদানপূর্বক লোকে অতুল কীর্তি লাভ করিয়াছেন।” কালিপ্রসন্নের মহাভারতের দ্রোণ পর্বের ৬৭ তম অধ্যায়ে বলা হয়েছে–“নারদ কহিলেন, হে সৃঞ্জয়! সংস্কৃতিনন্দন মহাত্মা রন্তিদেবকেও শমনসদনে গমন করিতে হইয়াছে। ঐ মাহাত্মার ভবনে দুইলক্ষ পাঁচক সমাগত অতিথি ব্রাহ্মণগণকে দিবারাত্র পক্ক ও অপক্ক খাদ্যদ্রব্য পরিবেশন করিত। মহাত্মা রন্তিদেব ন্যায়োপার্জিত অপৰ্য্যাপ্ত ধন ব্রাহ্মণগণকে প্রদান করিয়াছিলেন। তিনি বেদাধ্যয়ণ করিয়া ধর্মানুসারে শত্রুগণকে বশীভূত করেন। ঐ মহাত্মার যজ্ঞসময়ে পশুগণ স্বর্গলাভেচ্ছায় স্বয়ং যজ্ঞস্থলে আগমন করিত। তাহার অগ্নিহোত্র যজ্ঞে এত পশু বিনষ্ট হইয়াছিল যে, তাহাদের চর্মরস মহানস হইতে বিনির্গত হইয়া এক মহানদী প্রস্তুত হইল। ঐ নদী চর্মনবতী নামে অদ্যপি বিখ্যাত রহিয়াছে।” এরপরে বলা হয়েছে–“সংস্কৃতিনন্দনের ভবনে (রন্তিদেবের) এত অধিক অতিথি সমাগত হইত যে মণিকুণ্ডলধারী সুদগণ একবিংশতিসহস্র বলীর্দের মাংস পাক করিয়াও অতিথিগণকে কহিত, অদ্য তোমরা অধিক পরিমাণে সুপ ভক্ষণ করো, আজি অন্যদিনের ন্যায় অপর্যাপ্ত মাংস নাই।” (দ্রোণপর্ব/৬৭) মহাভারতের অনেক জায়গাতে গো-মেধ যজ্ঞের কথা বলা আছে–(১) “এই পৃথিবীতে যে সমস্ত তীর্থ আছে, নৈমিষেও সেই সকল তীর্থ বিদ্যমান রহিয়াছে। তথায় সংযত ও নিয়তাসন হইয়া স্নান করিলে গো-মেধ যজ্ঞের ফলপ্রাপ্তি ও সপ্তম কুল পর্যন্ত পবিত্র হয়।” (বনপর্ব/৮৪) (২) “মনুষ্যের বহুপুত্র কামনা করা কর্তব্য; কারণ তাহাঁদিগের মধ্যে কেহ যদি গয়ায় গমন, অশ্বমেধ যজ্ঞানুষ্ঠান অথবা নীলকায় বৃষ উৎসর্গ করে, তাহা হইলে বাঞ্ছিত ফল লাভ হয়।” (বনপর্ব/ ৮৪) (৩) “তৎপরে তত্রস্থ শ্রান্তিশোক বিনাশন মহর্ষি মতঙ্গের আশ্রমে প্রবেশ করিলে গো-মেধযজ্ঞের ফল লাভ হয়।” [বন/৮৪]।