বাল্মীকির রামায়ণে রাম, লক্ষ্মণ ও সীতা নিরামিষভোজী ছিলেন না। তাঁরা কেবলই ফলমূল খেয়েই জীবন ধারণ করত না। না, মহামুনিরা সে কথা বলছেন না। যা সত্য তাইই বলেছেন। তাঁরা যে সত্যদ্রষ্টা। রামচন্দ্র নিজেই। আমিষ খাবার পছন্দ করতেন। ভরত যেদিন রামকে ফিরিয়ে আনতে চিত্রকূটে পর্বতে এলেন, সেদিন রাম দগ্ধ মৃগমাংসের সাহায্যে সীতা বিনোদন করছিলেন। অর্থাৎ রাম-সীতা উভয়ই হরিণের মাংস ভক্ষণ করছিলেন। লক্ষ্মণ তখন খাচ্ছিলেন না। কারণ তখন তিনি প্রহরায় ব্যস্ত ছিলেন। প্রহরায় ব্যস্ত থাকলেও এই মৃগমাংস খাদ্যাদির ব্যবস্থা তিনিই করেছিলেন। কাঠ সংগ্রহ করা, আগুন জ্বালানো, পশুপাখি মারা, খাবার বানানো, ঘর বানানো এসব কাজ লক্ষ্মণই করতেন। শুধু মাংস নয়, রামচন্দ্র মাছ খেতেও খুব পছন্দ করতেন। বাল্মীকি বলেছেন–“ঘৃতপিণ্ডেপমান্ স্থূলাংস্তান্ দ্বিজান্ ভক্ষয়িষ্যথ।/রোহিতাংশ্চক্ৰতুণ্ডাংশ্চ নলমীনাংশ্চ৷৷” অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে–চক্রতুণ্ড, নলমীন এবং রোহিত বা রুই এই তিন রকমের মাছ তিনি খেয়েছেন। পম্পা সরোবরের কাছে মাতঙ্গ ঋষির আশ্রম, কাছেই ঋষ্যমূক পর্বত, যে পর্বতে কিষ্কিন্ধ্যা থেকে বহিষ্কৃত সুগ্রীব অবস্থান করছিলেন। এই পম্পা সোবর থেকে বর্শা বা ওই ধরনের কোনো তীক্ষ্ণ কিছু দিয়ে রাম ও লক্ষ্মণ মাছ শিকার করেছেন, একথা বাল্মীকি রামায়ণে উল্লেখ আছে–
“পম্পায়ামিমুভিমৎস্যাংস্তত্র রাম বরা হতা।
নিকপক্ষানয়স্তপান্ কৃশানৈক কণ্টকা।”
রান্নাবান্না করতেন লক্ষ্মণ। খাদ্যতালিকায় ভাত যেমন থাকত, তেমনি জ্বলন্ত কাঠের উপর দই ও লবণ দিয়ে ম্যারিনেট করা ঝলসানো মাছও ছিল–
“তব ভক্ত্যা সমযুক্তো লক্ষ্মণঃ সম্প্রদাস্যতি।
ভৃশংতা খাদতো মৎস্যান পম্পায়া পুষ্পসঞ্চয়ে।
…স্থানং প্রপচতাং তত্র দৃষ্টা, নীবারতণ্ডুলা।
পিপ্পলী লবণাভ্যাং চ মৎস্যান সম্পাদপিষ্যথঃ।”
পঞ্চবটি বটে সীতা রাবণকে বলেছেন যে, আমার স্বামী এখনই অনেক বনজাত খাদ্যদ্রব্য, অনেক রুরু মৃগ, গোসাপ, শুয়োর সব মেরে মাংস নিয়ে আসবেন–
“আগমিষ্যতি মে ভর্তা বন্যমাদায় পুষ্কল।
রুরূ বরাহাংশু হত্বাদায়ামিষং বহু।”
এ প্রসঙ্গে বাল্মীকি বলেছেন–
“নিহত্য পৃষতঞ্চান্যং মাংসমাদায় রাঘবঃ।
ত্বরমাণে জনস্থানং সসারাভিমুখং তদা।”
অর্থাৎ রাম হরিণ হত্যা করে সেই মাংস কাঁধে নিয়ে ঘরের দিকে ছুটলেন।
রামায়ণের চরিত্ররা কি গো-মাংস ভক্ষণ করত? অনেকে দাবি করেন স্বয়ং রামচন্দ্রই নাকি গো-মাংস ভক্ষণ করতেন। আসুন দেখি রামায়ণ কি বলে। রামায়ণে সীতা গঙ্গা নদী পার হওয়ার সময় গঙ্গাকে গোরু নিবেদন করার কথা বলেন। বাল্মীকি রামায়ণের অযোধ্যা কাণ্ড (৫২ সর্গ)-এ বলা হয়েছে–“জানকি গঙ্গার মধ্যস্থলে গিয়া কৃতাঞ্জলিপুটে কহিলেন, “গঙ্গে! এই রাজকুমার তোমার কৃপায় নির্বিঘ্নে এই নির্দেশ পূর্ণ করুন। ইনি চতুর্দশ বৎসর অরণ্যে বাস করিয়া পুনরায় আমাদের সহিত প্রত্যাগমন করিবেন। আমি নিরাপদে আসিয়া মনের সাধে তোমার পূজা করিব। তুমি সমুদ্রের ভার্যা, স্বয়ং ব্রহ্মলোক ব্যাপিয়া আছ। দেবী! আমি তোমাকে প্রণাম করি। রাম ভালোয় ভালোয় পৌঁছিলে এবং রাজ্য পাইলে আমি ব্রাহ্মণগণকে দিয়া তোমারই প্রীতির উদ্দেশ্যে তোমাকে অসংখ্য গো ও অশ্ব দান করিব, সহস্র কলস সুরা ও পলান্ন দিব। তোমার তীরে যেসকল দেবতা রহিয়াছেন, তাহাদিগকে এবং তীর্থস্থান ও দেবালয় অর্চনা করিব।” (বাল্মীকি রামায়ণ/অযোধ্যা কাণ্ড/২৫০ সর্গ; অনুবাদক হেমচন্দ্র ভট্টাচার্য)। না, এই সংলাপে গো-মাংস ভক্ষণের কোনো আভাস পর্যন্ত নেই। গো-দানের উল্লেখই পাচ্ছি।
যমুনা নদী অতিক্রম করার সময় সীতা যমুনাকেও গোরু নিবেদন করার কথা বলেন–“এই বলিয়া রাম সীতাকে অগ্রে লইয়া লক্ষ্মণের সহিত যমুনাভিমুখে চলিলেন এবং ওই বেগবতী নদীর সন্নিহিত হইয়া উহা কি প্রকারে পার হইবেন ভাবিতে লাগিলেন। অনন্তর তাহারা বন হইতে শুষ্ক কাষ্ঠ আহরণ এবং উশীর দ্বারা তাহা বেষ্টন করিয়া ভেলা নির্মাণ করিলেন। মহাবল লক্ষ্মণ জম্বু ও বেতসের শাখা ছেদন পূর্বক জানকীর উপবেশনার্থ আসন প্রস্তুত করিয়া দিলেন। তখন রাম সাক্ষাৎ লক্ষ্মীর ন্যায় অচিন্ত্যপ্রভাবা ঈষৎ লজ্জিতা প্রিয় দয়িতাকে অগ্রে ভেলায় তুলিলেন এবং তাহার পার্শ্বে বসন ভূষণ, খন্ত্রি এবং ছাগচর্ম সংবৃত পেটক রাখিয়া লক্ষ্মণের সহিত স্বয়ং উত্থিত হইলেন এবং সেই ভেলা অবলম্বন করিয়া প্রীতমনে সাবধানে পার হইতে লাগিলেন। জানকি যমুনার মধ্যস্থলে আসিয়া তাহাকে প্রণাম করিয়া কহিলেন, “দেবী আমি তোমায় অতিক্রম করিয়া যাইতেছি, এক্ষণে যদি আমার স্বামী সুমঙ্গলে ব্রত পালন করিয়া অযোধ্যায় প্রত্যাগমন করিতে পারেন, তাহা হইলে সহস্র গো ও শত কলস সুরা দিয়া তোমার পূজা করিব। সীতা কৃতাঞ্জলিপুটে এইরূপ প্রার্থনা করত তরঙ্গবহুলা কালিন্দীর দক্ষিণ তীরে উত্তীর্ণ হইলেন।” (বাল্মীকি রামায়ণ/অযোধ্যা কাণ্ড/৪৯ সর্গ; অনুবাদক হেমচন্দ্র ভট্টাচার্য) পঞ্চানন তর্করত্নের অনুবাদ করেছেন এভাবে, বলা হয়েছে–“অনন্তর সম্যক জ্ঞানবতী সীতা দেবী সেই যমুনা নদীর। অধ্যদেশে যাইয়া তাহাকে বন্দনা করিলেন। “দেবী! আমি আপনার উপর দিয়া পরপারে যাইতেছি; আপনি আমার মঙ্গল কামনা করুন,–আমার পাতিব্রাত্য ব্রতের রক্ষাকারী হউন। ইক্ষ্বাকুবংশীয় রাজগণ পালিতা অযোধ্যা নগরীতে রাম মঙ্গলে মঙ্গলে ফিরিয়া আসিলে, আমি আপনাকে সহস্র গো ও একশত সুরাপূর্ণ কলসদ্বারা পূজা করিব।” এই বলিয়া তিনি কৃতাঞ্জলিপুটে প্রার্থনা করত দক্ষিণতীরে গিয়া উপস্থিত হইলেন।” (বাল্মীকি রামায়ণ/ অযোধ্যাকণ্ড/ ৫৫ সর্গ; অনুবাদক পঞ্চানন তর্করত্ন)।