ইন্দ্রজিৎ বা মেঘনাদ ইন্দ্রলোক জয় করেছিলেন। ইন্দ্রলোক, দেবলোক জয় করা তো সামান্য বীরের কাজ নয়! এহেন মেঘনাদকে পরাজিত এবং হত্যা করার আগে লক্ষ্মণ ও রাম পরাস্তই হয়েছিলেন তাঁর কাছে। একবার নয়, দু-দুইবার। বহিঃশক্তি আর্যদেবতাদের সহায়তা এবং কৌশল অবলম্বন না-করলে সেই যুদ্ধে মেঘনাদকে পরাস্ত করা সহজসাধ্য ছিল না।
আবার রামায়ণ, মহাভারত এবং পুরাণকাহিনিতে এমন কিছু মন্ত্রও আছে, যা নকি উচ্চারণ করার সঙ্গে সঙ্গে মুহূর্তের মধ্যে চোখের সামনে হাজির হয় শস্ত্র হিসাবে। কখনও-বা সেই শস্ত্রের আঘাতে বিপক্ষের জীবনহানিও হয়ে যায় নিমেষে। আবার কখনও ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে সেই সকল অস্ত্রের দ্বারা অহেতুক ক্ষতিসাধনও হয়ে থাকে। আর-একটি প্রসিদ্ধ অস্ত্রের কথাও আমরা জানি, তা হল ‘ব্রহ্মাস্ত্র’। এই অস্ত্রের ব্যবহার ছিল একেবারে শেষ পর্যায়ে। আধুনিক যুগে পরমাণু বোমার মতো। যুদ্ধের শেষ অস্ত্র। এই অস্ত্র ব্যবহারের কিছু বিধিনিষেধও ছিল। বিপক্ষকে কোনওভাবেই পরাস্ত করতে না-পারলে, বিপক্ষের সঙ্গে যুদ্ধে মৃত্যু আসন্ন হলে এবং সমগ্র বাহিনী পরাজয়ের সম্মুখীন হলে তবেই এই অস্ত্র ব্যবহার করা হত। তবে কি এই অস্ত্র ছিল একালের নিউক্লিয়ার বোমা বা পরমাণু অস্ত্র, যার প্রয়োগ সম্বন্ধে আছে অনেক বিধিনিষেধ! হঠকারিতা যে হয় না, তা নয়–সেযুগেও হয়েছে, এযুগে হয়। ১৯৪৫ সালের ৬ আগস্ট হিরোসিমা ও নাগাসাকির বিরুদ্ধে ব্ৰহ্মাস্ত্র (নিউক্লীয় বোমা) প্রয়োগ করে এমনই হঠকারিতা করেছিল আমেরিকা।
এছাড়া ছিল ‘যমাস্ত্র’। নাম শুনেই মনে হয় একেবারে ইহলীলা সাঙ্গ করার জন্যই এর ব্যবহার। যম মানেই যে মৃত্যু, শমন। এই অস্ত্রটি মেঘনাদ বিভীষণের প্রতি ব্যবহৃত হয়েছিল। বিভীষণ রাম-লক্ষ্মণদের জানিয়ে দিয়েছেন মেঘনাদকে তাঁদের শক্তি দিয়ে হত্যা করা সহজ কাজ নয়। মেঘনাদ এখন যজ্ঞে বসেছেন এবং যজ্ঞ সম্পন্ন হলে তিনি অমরত্ব লাভ করবেন–কেউ আর তাঁকে পরাস্ত করতে পারবেন না। এদিকে রাম-লক্ষ্মণ মেঘনাদের অস্ত্রপ্রয়োগে যারপরনাই বিপর্যস্ত। লক্ষ্মণকে দু-বার এবং রামচন্দ্রকেও একবার পরাস্ত করেছেন ইন্দ্রজিৎ মেঘনাদ। কোনোপ্রকারে মৃত্যুর কোল থেকে ফিরে এসেছেন রাম-লক্ষ্মণ দুই ভাই। অতএব মেঘনাদের যজ্ঞ পণ্ড করে মেঘনাদকে হত্যা করা যদি আসান হয়, সেই সুযোগ আর হাতছাড়া করা কেন! যজ্ঞ পণ্ড করলেই যদি তিনি আর অমরত্ব লাভ করতে না-পারেন, তাহলে আর দেরি কেন–অতএব শুভস্য শীঘ্রম। লক্ষ্মণ ও বিভীষণ সদলবলে মেঘনাদের যজ্ঞক্ষেত্রে হানা দিলেন। তখনই বিভীষণের বিরুদ্ধে যমাস্ত্রের প্রয়োগ করেছিলেন মেঘনাদ।
‘নাগপাশ’ আর-এক ভয়ংকর অস্ত্র। মেঘনাদের কাছে রাম এবং লক্ষ্মণ বারেবারেই পরাস্ত হচ্ছিলেন। মেঘনাদ নাগপাশ অস্ত্রের প্রভাবে রাম এবং লক্ষ্মণকে সর্পবন্ধনে বেঁধে ফেলেছিলেন। পরে গরুড়ের সাহায্যে তাঁরা মুক্ত হন। গরুড় (বিষ্ণুর বাহন বলা হয়) না-থাকলে সেদিন রাম-লক্ষ্মণ মুক্তি অসম্ভব ছিল। বহিঃশক্তি দেবতাদের পক্ষপাতিত্ব না-থাকলে রাম-লক্ষ্মণরা বড়োই অসহায়। আর-একটি ভয়ংকর অস্ত্র হল ‘শক্তি অস্ত্র বা ‘শক্তিশেল। এই অস্ত্র মেঘনাদ প্রয়োগ করেছিলেন লক্ষ্মণের বিরুদ্ধে। একপ্রকার মৃত বলেই ঘোষিত হয়েছিলেন লক্ষ্মণ। হনুমান সঞ্জীবনী’ এনে না-দিলে সেবারেই ‘খবর’ হয়ে যেতেন তাঁরা। এছাড়া সূর্যাস্ত্র, বরুণাস্ত্র, ইন্দ্রাস্ত্র ইত্যাদি অস্ত্র একা মেঘনাদের বিরুদ্ধেই ব্যবহৃত হয়েছিল। এক এক দেবতার এক একরকমের অস্ত্র, তার পাল্লা এবং বীভৎসতাও এক একরকম।
ইন্দ্রজিৎ বা মেঘনাদ এবং রামচন্দ্র ‘ব্ৰহ্মাস্ত্র’, ‘পাশুপত অস্ত্র’, ‘বৈষ্ণবাস্ত্র’ এই তিনটি অস্ত্রের অস্ত্রধারী বীর ছিলেন। এছাড়াও ছিল ‘গান্ধর্বাস্ত্র’, যা বহু সৈন্যকে একসঙ্গে হত্যা করার মতন ক্ষমতাসম্পন্ন অস্ত্র ছিল। রাম এবং রাবণ এই দুজন শক্তিধর ব্যক্তি ছাড়া আর কোনও বীরেরই এই অস্ত্রচালনা করার ক্ষমতা ছিল না।
শুধু রামায়ণ নয়, মহাভারতেও আমরা ভয়ানক সব সামরিক পরিচয় পাই। যে ধরনের অস্ত্রশস্ত্র তাঁদের কাছে ছিল, সে ধরনের অস্ত্রশস্ত্রের মারণক্ষমতা ছিল প্রলয়ংকর। মহাভারতের আদি পর্বে অগ্নিদেব বাসুদেবকে ‘সুদর্শন চক্র’ দিয়ে বলছেন–‘এই অস্ত্র শত্রু নিপাত করবে এবং কাজ শেষ হলে তাঁরই হাতে ফিরে আসবে’। সেই বাসুদেব শিশুপালের হাতে যখন প্রায় নিগৃহীত, তখন তিনি সেই সুদর্শন চক্র ব্যবহার করেছিলেন এবং সেই ‘চক্র তাঁহার দেহ হইতে মস্তক বিচ্ছিন্ন করিয়া বাসুদেবের হস্তে ফিরিয়া আসিল’। দুর্দান্ত ক্ষুরধার ব্যুমেরাং! এত বছর আগে ব্যুমেরাং!