ফিলিস্তিনি মুসলিমদের স্বাধীনতা সংগ্রামকে অথবা সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের মুখে আত্মরক্ষার জন্য ইরানের যুদ্ধকৌশলকে সন্ত্রাসী তৎপরতা বলে ব্যাখ্যা করা হয়। কোনো অমুসলিম দেশ এই আগ্রাসনের নিন্দা করে না। প্রাচ্যতত্ত্ব মুসলিমদের সম্পর্কে যে নমুনা নির্মাণ করেছে সেটাই চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে গোটা মুসলিম জনগোষ্ঠীর উপর। একদল সন্ত্রাসী মুসলমানের নমুনা দেখিয়ে বলা হচ্ছে ইসলাম সন্ত্রাসের ধর্ম, মুসলমানেই সন্ত্রাসী। আরবি নামধারী দেখলেই অমুসলিমরা ভীত সন্ত্রস্ত! প্রধানত তেল ও ইরানকেন্দ্রিক পশ্চিমী মনোভাব আরোপিত হয় গোটা মুসলিম বিশ্বের উপর। সেইসঙ্গে আগুনে ঘি ঢালার মতো ঘটনা ঘটাতে থাকে একদল জঙ্গি মুসলমান। এঁরা বিভিন্ন দেশে বোমা বিস্ফোরণ ঘটায়, মানুষ হত্যা করে, ধ্বংসের হুমকি দেয়। ফলে এই জঙ্গি মুসলমানদের ভাবমূর্তিই আরোপিত হয় মুসলমান ও ইসলাম ধারণাটির উপর। ইসলাম ‘শান্তির ধর্ম’ ‘শান্তির ধর্ম’ বলে চিৎকার করেও মোম আর গলানো যাচ্ছে না।
ইতিহাস হল এমন একটা বিষয়, যা নিয়ে সবচেয়ে বেশি সততায় সন্দেহের উদ্রেগ করে। সবচেয়ে বেশি ইতিহাসেই বিকৃতি ঘটানো হয়েছে নির্দয়ভাবে। শাসনের ইতিহাসে ঐতিহাসিকরা যেমন খলনায়ককে নায়ক বানিয়েছেন, তেমনি নায়ককে খলনায়ক বানিয়ে ছেড়েছেন। কোনো ইতিহাসই চূড়ান্তভাবে রচিত হয়নি। তাই পুনঃপুনঃ ইতিহাস রচনার প্রয়োজন হয়ে পড়ে। নানাবিধ কারণেই জানা ইতিহাসকেই পুনরায় নতুন করে রচিত হয়েছে ভিন্ন ভিন্ন রসদ যুক্ত করে। বরং বলা ভালো যে, যে ঘটনাগুলোকে কার্পেটের নীচে লুকিয়ে রাখা হয়েছে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে, সেগুলিই টেনে আলোর নীচে উপস্থাপন করাই পুনর্লিখনের উদ্দেশ্য। খুব কম ক্ষেত্র ব্যতীত প্রায় প্রতিটি ঐতিহাসিকই নিজের বা নিজেদের আদর্শিক ও রাজনৈতিক বিশ্বাস টিকিয়ে রাখতে নিজেদের অপরাধ ও ব্যর্থতাকে গোপন করতে বা কৃতকর্মকে মানবসমাজে বৈধতাঘটিত ঘটনার ইতিহাসকে বিকৃত করেন। এই বিকৃত ইতিহাসের কারণে সমাজ ও সভ্যতায় যে ধরনের বিপর্যয় সৃষ্টি হওয়ার কথা, সেটা আমাদের দেশ পাকিস্তান বাংলাদেশকে সরেজমিন করলেই যথার্থতা অনুধাবন করা যায়। এই বিকৃতির ইতিহাসের কারণেই আদর্শিক, মনস্তাত্ত্বিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক সবকটিরই শিকার হচ্ছে ভারতের মুসলিম সমাজ। ইতিহাসের এমন অনেক খুঁটিনাটি ঘটনা, তথ্য ও উপাত্তকে অপ্রয়োজনীয় বা তুচ্ছ ভেবে ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃতভাবে এড়িয়ে যান, যেসব তথ্য-উপাত্ত পাঠকমহলে আলোকিত উপস্থাপিত হয়, তাহলে নিশ্চয় মানবমনকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে।
ইতিহাসে পক্ষপাতিত্ব থাকবে না, তা হয় না? কারোর ইতিহাস কেমনভাবে রচিত হবে তা নির্ভর করে কে রচনা করছেন তাঁর উপর, তাঁর চিন্তা-চেতনার উপর। যিনি ইতিহাস-বিশ্লেষক, তিনি বিশ্লেষণ করে প্রকৃত তথ্য উপস্থাপন করবেন। ভারতে ইসলাম ভারতীয় মুসলমান’ গ্রন্থটি সেই জরুরি একটি সামাজিক প্রয়াস বলা যেতে পারে। এই গ্রন্থের আলোচিত বিষয়গুলি হয়তো শেষ কথা বলছে না, কিন্তু প্রতিটি ক্ষেত্রে আলোচনার প্রধান প্রধান সূত্রগুলি ধরিয়ে দিতে চেষ্টা করেছি। গবেষণা চলুক, আলোচনা অব্যাহত থাক, পুরোনো তর্কগুলি নতুন করে উপস্থাপিত হোক। ইতিহাস চর্চার এটাই তো প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত।
কলেবর বৃদ্ধি হবে এই আশঙ্কায় প্রথম খণ্ডটি ৭১১ থেকে ১৮৫৭ সালের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা হল, অর্থাৎ শেষ মোগল সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ পর্যন্ত। এরপর ১৭৫৭ সালের সিরাজ-উদ্-দৌল্লা থেকে পরবর্তী স্বাধীনোত্তর ভারতের সময়কাল পর্যন্ত মুসলমান শাসক ও মুসলমানদের বর্তমান অবস্থা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করার ইচ্ছা রইল দ্বিতীয় খণ্ডে। পরিশেষে জানাই, এই গ্রন্থ প্রণয়নে যাঁদের উৎসাহ ও সহযোগিতা ছিল, যাঁরা আমার নিত্য সহচর শিক্ষানুরাগী পরম শ্রদ্ধাভাজন মানুষদের রইল আমার অকুণ্ঠ কৃতজ্ঞতা। বিশেষ করে যাঁর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ জ্ঞানদানে আমি ইসলাম সম্বন্ধ জ্ঞাত হয়েছি, সেই প্রাজ্ঞ বন্ধুবর জনাব মুহাম্মদ আব্দুল কাইয়ুমকে দিলাম আমার সর্বক্ষণের সাহচর্য। যাঁর আগ্রহে এই গ্রন্থটি পাঠকদের হাতে তুলে দেওয়া সম্ভব হয়েছে, তিনি হলেন এই গ্রন্থের প্রকাশক। তাঁর জন্য রইল অকুণ্ঠ ভালোবাসা।
সর্বোচ্চ আন্তরিকতা সত্ত্বেও গ্রন্থটিতে ত্রুটিবিচ্যুতি থেকে যেতে পারে অসতর্কতায়, সহৃদয় পাঠকদের ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখার একান্ত অনুরোধ রইল। পরবর্তী সংস্করণে বিদগ্ধ পাঠকদের গঠনমূলক সমালোচনা ও পরামর্শ অনুসারে গ্রন্থটি সংশোধন ও সংযোজন করার ইচ্ছা আমার রইল। এই গ্রন্থখানি যদি পাঠকদের সামান্যতম চিন্তার খোরাক জোগাতে সক্ষম হয়, তাহলে আমার পরিশ্রম সার্থক হয়েছে বলে মনে করব। সামাজিক প্রজ্ঞা এইসব কিছু থেকেই প্রসারিত হোক। জ্ঞানচর্চার সেটাই তো মূল উদ্দেশ্য, অন্তত এমনটাই তো হওয়া উচিত।