Facts বা ঘটনাই হল ইতিহাস –ইতিহাসের দেহ, মন এবং আত্মা। ইতিহাসে সেইসব ঘটনাসমূহের প্রাধান্য থাকা উচিত, যা দেশ ও জাতির জীবনে সুগভীর প্রভাব ছিল। ভারতের ইতিহাস বাস্তবে তেমনভাবে রচিত হয়নি, যা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলা যায়। মধ্য ও আধুনিক যুগের ইতিহাস রচনায় মুখ্য ঘটনাকে সযত্নে পরিহার করে যা নিতান্তই গৌণ, সেগুলিকেই উল্লেখ করা হয়েছে। তাতে কল্পনার রং মিশিয়ে অভিনব ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করে গরম গরম পরিবেশন করা হয়েছে। আমরা পেয়েছি একটি বিকৃতি ইতিহাস। এই বিকৃতি ইতিহাস প্রথম শুরু হয়েছিল ব্রিটিশ ভারতের ব্রিটিশ শাসকদের হাত ধরেই। পরবর্তীতে অন্যান্য ঐতিহাসিকরা প্রভুতুল্য ব্রিটিশ রচিত ইতিহাস বেদবাক্য ভেবে নিয়ে বিকৃত ইতিহাসকে সম্প্রসারণ করে যাচ্ছেন। বস্তুত সংঘর্ষ হত্যালীলা যেমন মুসলিম শাসকদের সঙ্গে হিন্দু শাসকের সঙ্গে হয়েছে, ঠিক তেমনি মুসলিম শাসকদের সঙ্গে মুসলিম শাসকেরও হয়েছে। আবার হিন্দু শাসকের সঙ্গে হিন্দু শাসকদেরও যুদ্ধ হয়েছে। বৌদ্ধ শাসকদের সঙ্গে হিন্দু শাসকদের যুদ্ধও কিছু কম হয়নি। উপর্যুপরি হয়েছে। এমন নজির মোটেই বিরল নয়। হিন্দুশাসক যেমন মন্দির ভেঙেছে, ঠিক তেমনি মুসলিম শাসকরাও মসজিদ ভেঙেছে। এমন নজিরও বিরল নয়। এ তো রাজায় রাজায় বিষয়। রাজায় রাজায় যুদ্ধ হয়েছে। ঠিকই (যুদ্ধ করা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না সেই যুগে), কিন্তু নীচের তলায় হিন্দু-মুসলমানরা শতাব্দীর পর শতাব্দী বাস করেছে একসঙ্গে। বিবাদ-বিসংবাদ যে তাঁদের মধ্যে হয়নি, একথা কখনোই বলব না। তেমন বাদ বিবাদ তো সমধর্মী প্রতিবেশীদের মধ্যেও হয়। খুনোখুনি, রক্তারক্তি হয়েছে এবং আজও হয়।
ইতিহাসের সব উপাদান রক্ষিত আছে বিভিন্ন গ্রন্থাগার, সমসাময়িক পত্রপত্রিকা, মিউজিয়াম, ভারত সরকারের পুরাতত্ত্ব বিভাগ, দিল্লির ন্যাশনাল আর্কাইভস, বিভিন্ন নথি ও দলিলে। যেহেতু আমার এই গ্রন্থখানির মূল উপজীব্য ভারতের ইসলাম ও মুসলিম, সেই কারণে আমার প্রয়োজন হয়েছে মুসলিম সম্রাটদের আত্মজীবনী, সম্রাটদের ঘনিষ্টদের কর্তৃক রচিত জীবনী, দিনলিপি, বিভিন্ন সময়ে ভারতের আসা পরিব্রাজকদের রচনা এবং মুসলিম ঐতিহাসিকদের ইতিহাস। মুসলিম ঐতিহাসিকদের ইতিহাস আমি খুব গুরুত্ব সহকারে অনুধাবন করেছি। মুসলিম ঐতিহাসিকরা সবিস্তারে মধ্যযুগের ইতিহাস বর্ণনা করেছেন, এ বিষয়ে নিশ্চয়ই কারোর দ্বিমত থাকার কথা নয়। ইতিহাসের বিপুল আকর গ্রন্থ থেকে তথ্য চয়ন করেই আমার এই গ্রন্থের প্রাণসঞ্চার করেছি। ভারত অতিক্রম করে বিশ্বভ্রমণও করতে হয়েছে। আলোচিত হয়েছে স্বাধীনতা-পরবর্তী ভারতের হিন্দু-মুসলিমের অবস্থান বিষয়েও।
পশ্চিমের প্রচার মাধ্যম দীর্ঘদিন ধরে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মুসলিমদের খুনি, সন্ত্রাসী, অপহরণকারী হিসাবে চিত্রিত করে আসছে। ফলে সারা পৃথিবী জুড়ে ইসলাম-বিদ্বেষীদের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। আর এই বিদ্বেষ থেকে তুলে আনা তথ্য বিকৃতি করা ‘ইতিহাস’। অথচ বাস্তবে কেবল একদল মুসলিমই সন্ত্রাসী তৎপরতায় জড়িত। তাঁদের অধিকাংশরই শুরু হয় কোনো-না-কোনোভাবে প্রত্যক্ষ মার্কিন সহায়তায় সন্ত্রাসী গোষ্ঠী। আবার প্রতিটি মুসলিম দেশেই যে চরমপন্থী মুসলিম সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে বিশাল উদারনৈতিক গোষ্ঠী সদা তৎপর সে ঘটনাগুলিও আলোচিত হয় না। পাশাপাশি এটাও আলোচিত হয় না যে, শুধু একটি দেশই (আমেরিকা) ১৯৪৫ সাল থেকে এখন পর্যন্ত অর্থনৈতিক ও সামরিক পরাশক্তি দেশটির অস্ত্রে নিহত হয়েছে ২ থেকে ৩ কোটি বেশি নিরীহ বেসামরিক মানুষ। এটা প্রথম বিশ্বযুদ্ধে নিহত মানুষের প্রায় দ্বিগুণ। ১০০ বছর আগের ভয়াবহ ওই যুদ্ধে নিহত হয় প্রায় দেড় কোটি মানুষ। সম্প্রতি ‘Global Research : Centre for Research on Globalization’ প্রকাশিত এক গবেষণা রিপোর্টে গত ৭৩ বছরে বিশ্বব্যাপী যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকার লঙ্ঘন ও হত্যাযজ্ঞের এ চিত্র উঠে এসেছে। কোনো কোনো বিশেষজ্ঞের মতে, যুদ্ধে প্রত্যেক নিহত ব্যক্তির বিপরীতে অন্তত ১০ জন আহত হয়েছে। এর মানে মার্কিন বাহিনীর হাতে আহত হয়েছে আরও অন্তত ২০ থেকে ৩০ কোটি মানুষ। সিরিয়ার কোনো সন্ত্রাসী হত্যাযজ্ঞ করলে সব মুসলিমকেই সন্ত্রাসবাদী বলা হয়। কিন্তু আমেরিকার সন্ত্রাসীরা হত্যাযজ্ঞ করলে সব খ্রিস্টানকে সন্ত্রাসবাদী বলার রীতি নেই। উলফার (ULFA) ৯৮% সদস্য যাঁরা হিন্দু, তাঁরা সন্ত্রাসবাদী নন। তাঁরা স্বাধীনতা সংগ্রামী। বরো জঙ্গিগোষ্ঠীর ১০০% সদস্য হিন্দু, তাঁরা সন্ত্রাসবাদী নয়, স্বাধীনতা সংগ্রামী। সারা দেশের এক তৃতীয়াংশ জেলা মাওবাদীদের দখলে এবং ওই মাওবাদী সংগঠনের ৯৫% সদস্য হিন্দু সন্ত্রাসসৃষ্টিকারী নন। তাঁরাও দেশপ্রেমিক। পশ্চিমবঙ্গে কামতাপুরী সন্ত্রাসবাদীর ১০০% সদস্যই হিন্দু, যাঁদের কাছে AK47 দুধ ভাত, তাঁরা সন্ত্রাসবাদী নয়, স্বাধীনতা সংগ্রামী। গান্ধীজির হত্যাকারী নাথুরাম গডসে সন্ত্রাসী নন। আলোচনায় আসে না, জাতিসংঘ মানবাধিকার সংস্থা বলছে ১৯৮৯ সালের জানুয়ারি মাস থেকে ২০১৬ সালের ৩১ আগস্ট পর্যন্ত কাশ্মীরে ইন্ডিয়ান আর্মির নির্যাতনে নিহত কাশ্মীরের নাগরিক ৯৪,৫০৪ জন, থানা হেফাজতে মৃত্যু ৭,০৬২ জন, ঘরবাড়ি ধ্বংস ১,০৬,২৬১ টি, বিধবা হয়েছে ২২,৮২৪ জন নারী, অনাথ হয়েছে ১,০৭,৫৮৬ জন শিশু, ইন্ডিয়ান আর্মি কর্তৃক গণধর্ষণের ঘটনা ১০,৪৩৩ জন। এই ক্ষুদ্র এলাকার বিদ্রোহ দমনে রাখতে ভারত মোতায়েন করেছে প্রায় দশ লক্ষ সেনাসদস্য। কাশ্মীরিরা যুগের পর যুগ জীবন দিয়ে যাচ্ছে, আর আমাদের অনেক মিডিয়া হেডলাইন করেছে তাঁরা সন্ত্রাসী, স্বাধীনতা সংগ্রামী হতেই পারে না। নেতারা বলছেন ওরা সন্ত্রাসী। আচ্ছা, কাশ্মীরিরা যদি মুসলিম না-হয়ে হিন্দু বা অন্য ধর্মের নাগরিক হত, তাহলেও কি তাঁদের সন্ত্রাসী বলতাম এমন অবলীলায়? দেশভাগের পটভূমি, বাংলাদেশ যুদ্ধ ইত্যাদি যুগসন্ধিক্ষণে পাকিস্তানি খান সেনাদের নৃশংস ধ্বংসলীলা যা বিশ্বের ইতিহাসে বেনজির বললে অত্যুক্তি হবে না। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের অন্তিম লগ্নে সর্বহারার লাল ফৌজ কেবল বার্লিনে প্রবেশ করার পর কী ভয়াবহ ধর্ষণ লীলায় মেতে উঠেছিল, সেটাও আমরা ভুলে যাইনি। এন্টোনি বিভরের “Berlin : The Downfall 1945” শীর্ষক গ্রন্থটিতে এসব তথ্য দলিল হিসাবে নথিভুক্ত করা আছে। ৮ থেকে ৮০ কোনো নারী রেহাই সেদিন পাননি। প্রখ্যাত নাট্যকার জাখর আগ্ৰানেনকো প্রথম জীবনে পূর্ব প্রাশিয়াতে পদাতিক বাহিনীর অফিসার হিসাবে কর্মরত ছিলেন। তাঁর ডায়েরির এই পাশবিক বিবরণে তিনি কী লিখেছেন– “Red Army soldiers don’t believe in ‘individual liaisons’ with German women–nine, ten, twelve men at a time– they rape them on a collective basis.” একজন নারীকে একজন নয়, দশ এমনকি বারো জন মিলে ধর্ষণ করা হত। পঁচানব্বই হাজার থেকে এক লক্ষ তিরিশ হাজার নারীকে এই ভাবে ভোগ করেছিল সেই বিজয়ী লাল ফৌজ। এঁরা সন্ত্রাসী নয়?