সে যুগে যা ধর্মনীতি, আজ সেটাই রাষ্ট্রনীতি। কোরান নয়, এখন মুসলিম রাষ্ট্রগুলিতেও আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় আধুনিক ও সময়োপযোগী অনুশাসনকেই মান্য করতে হয়। এ কথা সব মুসলমানই জানে, বোঝে এবং মানে। দেরিতে হলেও সৌদি আরবের মতো দেশেও রাষ্ট্রব্যবস্থায় এসেছে আমূল পরিবর্তন। কোরান বহির্ভূত অনেককিছুই এখন সৌদি আরবে চালু হয়েছে এবং হচ্ছে। গোঁড়ামি দূর হচ্ছে। সৌদি আরবের বাইরে অন্য মুসলিম দেশগুলি রাষ্ট্রীয় আইনই প্রয়োগ হয়, ইসলামি শাসন নয়। যদিও আফগানিস্তানের তালিবানরা ইসলামি শাসন বহু বছর যাবৎ কায়েম করার প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সেই শাসন মুসলিম দেশগুলি সহ সারা বিশ্বেই নিন্দিত। ব্যতিক্রম কখনোই আলোচনার বিষয় হতে পারে না। ভারতে একটানা প্রায় ৮০০ বছর হাজার হাজার মুসলিম শাসক শাসন করেছেন। ইতিহাস কজন শাসকের নাম মনে রেখেছেন? কজনের নাম মনে রেখেছি? কেন মনে রাখিনি? কারণ হয় তাঁদের উল্লেখযোগ্য তেমন কোনো অবদান ছিল না, নয়তো উল্লেখযোগ্য অবদান ছিল। কিন্তু আমরা উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে চেপে গেছি। আমরা কী করলাম, বেছে বেছে কয়েকজন মুসলিম শাসককে তুলে আনলাম। যাঁদের বিরুদ্ধে হিন্দুনিধন, জোর করে ভয় দেখিয়ে ইসলামে ধর্মান্তরিত করা এবং হাজার হাজার মন্দির ধ্বংস করে ফেলার অভিযোগ লিপিবদ্ধ করা হল। কারা লিপিবদ্ধ করল? ব্রিটিশ ঐতিহাসিকরা। কেন ব্রিটিশরা মুসলমান শাসকদের ‘কুকীর্তি’ লিপিবদ্ধ করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল? কারণ ভারতের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের সঙ্গে সংখ্যালঘু মুসলমানদের আক্রোশ ও ঘৃণা ঢুকিয়ে দিয়ে নিশ্চিন্তে ভারতে শাসন কায়েম করা। তোরা ভারতীয়রা নিজেদের মধ্যে মারামারি কাটাকটি করে মর, সেই অবকাশে আমরা ভারতকে লুটেপুটে খাই। যাকে ইংরেজিতে বলা হয় ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুলস’, অর্থাৎ ভাগ করো শাসন করো। তৎকালীন ভারতে যদি হিন্দু সম্প্রদায় সংখ্যালঘু থাকত, তাহলে হিন্দুদের বিরুদ্ধেও মুসলিম নিধন, মুসলিমদের জোর করে ভয় দেখিয়ে হিন্দুধর্মে ধর্মান্তরিত করা এবং হাজার হাজার মসজিদ ধ্বংস করে ফেলার অভিযোগ লিপিবদ্ধ করা হত। এইভাবে দুই ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে ঐক্য চিরকালের মতো বিনষ্ট করে নিরঙ্কুশভাবে ভারতে তাঁরা প্রায় ২০০ বছর শাসন করে গেছে। এছাড়া বহু সংখ্যক এলিট শ্রেণির হিন্দুকর্তাদেরও ব্রিটিশরা স্তাবক তথা পা-চাটা শ্রেণিদেরও তৈরি করে ফেলেছিল, যাঁরা সাদা চামড়ায় বিমুগ্ধ হয়ে ব্রিটিশদের প্রসাদ লাভ করে ব্যাপক খুশিতে ডগমগ হতে থাকল। ব্রিটিশদের ডিভাইড অ্যান্ড রুলসকে সফলভাবে প্রয়োগ করার কাজে তাঁদের অবদানও কিছু কম নয়। শুধু শাসনই নয়, লুটপাট করে ব্রিটিশরা সব ব্রিটেনে নিয়ে যেতে থাকল। অত্যাচারের সীমা অতিক্রম না-করলে এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সংঘটিত না-হলে ব্রিটিশদের ভারত-ছাড়া করা যেত কি না এ বিষয়ে তর্ক চলতে পারে। ব্রিটিশদের তৈলমর্দন করতে গিয়ে কখন যে ভারত ভূখণ্ড টুকরো টুকরো হয়ে গেল! মাঝখান থেকে হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে বিষবৃক্ষ রোপণ হয়ে গেল চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মতো। নিস্তরঙ্গ ভারত ভূখণ্ডে উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে বিদ্বেষপূর্ণতায় অস্থির হয়েই থাকল।
ইতিহাসকে আমরা নতুন করে গড়তে পারি না, কিন্তু ইতিহাসের পুনর্মূল্যায়ন ভবিষ্যতের পথ নিরূপণের সহায়ক 360 SNTCSI “Nathing should more deeply shame the mordern student than the recency and inadequacy of his acquitance with India.”– উক্তিটি করেছেন will Durant। Will Durant-এর এই বক্তব্যের পর আমি ইতিহাসের ছাত্র বা ইতিহাসের অনুরাগী বলতে সংকোচ বোধ করছি। তবুও যেটুকু না বললেই নয়— আমার কোনো প্রতিষ্ঠান নেই। প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রিও নেই। আমি কেবলই ইতিহাসের জিজ্ঞাসু ছাত্র। প্রাচীন ইতিহাস থেকে আধুনিক ইতিহাস –কোনো কিছুতেই আমার অরুচি নেই। নিরন্তর পাঠের মধ্য দিয়ে নিজেকে ঋদ্ধ করার চেষ্টা করেছি। বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্লেষণ করেছি প্রাচীন, মধ্যযুগ এবং আধুনিক সময়ের ইতিহাসের ঘটনাসমূহকে। একটি শাসকের যেমন কালো দিক থাকে, তেমনি আলোর দিকও থাকে। আমাদের ভারতের ইতিহাসে বিশেষ করে মুসলিম শাসকদের কালো দিকগুলিকে নিয়ে সবচেয়ে বেশি আলোচিত হয়। তার মধ্যে অধিকাংশই বানোয়াট, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। মুসলিম শাসকদের যেভাবে হিংস্র দেখানো হয়েছে, সত্যিই যদি তেমন হত তাহলে যেমন সুদীর্ঘ প্রায় ৮০০ বছর টানা ভারতশাসন করতে তাঁরা সক্ষম হত না। সত্যিই যদি তেমন হত তাহলে ভারত উপমহাদেশে একটিও অমুসলিম অবশিষ্ট থাকত না এবং অবশ্যই ক্ষোভে অভিমানে পৃথক দেশের দাবিও করতে হত না। আমাদের পাঠ্যবই থেকে ইতিহাস পাঠ করে আমরা বেড়ে উঠেছি, সেই ইতিহাস জন্ম দিয়েছে হাজার জিজ্ঞাসা, আমার মতো অনুসন্ধিৎসু ইতিহাস পাঠকের মনে। সেই জিজ্ঞাসার যথার্থ উত্তর খুঁজতেই মুসলিম শাসকদের এবং মুসলিম-ভাবনা নিয়ে নাড়াচাড়া করার দুঃসাহস লিপিবদ্ধ করেছি এই গ্রন্থে। প্রকৃত ইতিহাসটি উপস্থাপন করার চেষ্টা করেছি নির্মোহ দৃষ্ঠিভঙ্গি দিয়ে। হাজার বছরের ইতিহাসের যেমন মুসলিম শাসকদের চরিত্র বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করেছি, তেমনি প্রাসঙ্গিকভাবে হিন্দু শাসক, বৌদ্ধ শাসক, খ্রিস্টান শাসকদের চরিত্রও তুলনামূলক বিশ্লেষণ করতে হয়েছে। সেই বিশ্লেষণে এসে পড়েছে দেশভাগ প্রসঙ্গও। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামীরা অকাতরে প্রাণ বিসর্জন দিয়ে একটি ব্রিটিশমুক্ত ভারত চেয়েছিলেন, কিন্তু সেটা ভারতভাগের মধ্যে দিয়ে হল কেন? এর জন্য কে বা কারা দায়ী –সেই প্রশ্নেরও উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছি।