সুরা আনফালের অনেক আয়াত বদর যুদ্ধ এবং এ যুদ্ধের প্রকৃতি সম্পর্কিত। মক্কার অন্যতম প্রধান সর্দার আবু সুফিয়ান ও তার সঙ্গী আমর ইবনুল আস সিরিয়া থেকে ব্যাবসার মালপত্র নিয়ে মক্কায় আসছিল। তখন আল্লাহর পক্ষ থেকে মহানবি এ সংবাদ জানিয়ে জিহাদের নির্দেশ দেওয়া হয়। নবি ৩১৩ জনের এক ক্ষুদ্র সেনাদল নিয়ে সেখানে রওনা হন। মক্কার মুশরিক ও কাফেররা সেখান থেকে হিজরতকারী মুসলমানদের সহায়-সম্পদ দখল করেছিল বলে আবু সুফিয়ানের এই কাফেলার উপর হামলা চালিয়ে মুসলমানরা সেইসব সম্পদের ক্ষতিপূরণ আদায় করতে পারত। কিন্তু আবু সুফিয়ানের গুপ্তচররা হামলার প্রস্তুতির খবর তাঁকে জানিয়ে দেয়। ফলে সে মক্কা থেকে কাফেরদের সাহায্য চায়। আবু জাহেল মক্কার কুরাইশদের নানাভাবে উত্তেজিত করে প্রায় ১০০০ সদস্যের একটি সেনাদল তৈরি করে যুদ্ধের জন্য রওনা হয়। পথে উভয়পক্ষের মধ্যে সাক্ষাৎ হয়। মহানবি সাহাবিদের সঙ্গে পরামর্শ করলেন। কারণ সাহাবিদের অনেকেই শত্রুর সেনাসংখ্যার আধিক্যে ভয় পেয়েছিলেন।(সূত্র : Pars Today)
অতএব গণিমতের মাল বলতে বোঝায় কোনো মুসলিম ব্যক্তি বা জনগোষ্ঠী অন্য কোনো ব্যক্তি বা জাতিগোষ্ঠির সঙ্গে যুদ্ধে অবতীর্ণ হলে এবং মুসলিমরা জয়লাভ করলে বিজিত দলের থেকে প্রাপ্ত অর্থ, দ্রব্য সামগ্রী ও দাস-দাসী প্রাপ্ত হয় সেগুলোকে। যুদ্ধের সময় পরাজিতদের সম্পদকেই গণিমতের মাল বোঝায়। ‘গণিমত’ শব্দটা ইসলামি পরিভাষায় ব্যবহার হলেও প্রাচীন যুগ থেকে মধ্যযুগ পর্যন্ত সামন্ততান্ত্রিক যুগে পরাজিত পক্ষের ধন-সম্পদ, নারী হরণ করা সব দেশে সব ধর্মেই ছিল। ভারতের তাজমহলের চেয়ে দ্বিগুণ ব্যয়ে নির্মিত সোনা, হিরে ও মরকত মণিখচিত ময়ূর সিংহাসন নাদির শাহ এবং ময়ূর সিংহাসনের কোহিনুর হিরেটি ব্রিটিশরা ‘গণিমতের মাল’ হিসাবেই লুঠ করে নিয়ে গেছে।
মধ্যযুগ ছেড়ে যদি আধুনিক যুগে এসে দেখি বাংলাদেশে যখন পাকিস্তান বাহিনী নির্মম বর্বরতা চালায় তখন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে বাংলাদেশেরই একটি বিশেষ শ্রেণির ধর্মযুদ্ধ হিসেবে নিয়েছিল। অর্থাৎ ইসলাম ও বিধর্মী কাফেরদের লড়াই। মুক্তিযোদ্ধাদের ভারতীয় হিন্দুদের দালাল ও রাজাকার এবং পাকিস্তান বাহিনীকে ইসলামের হেফাজতকারী হিসাবে মনে করা হয়েছিল। পূর্ব পাকিস্তানী রাজাকারেরা মুক্তিযোদ্ধাদের সম্পদ লুট করত ‘গনিমতের মাল’ হিসাবে। বাংলাদেশী নারীদের তুলে নিয়ে গিয়ে ভোগ করত পাকিস্তানি আর্মিদের সঙ্গে নিয়ে। এটা যে ‘কবিরা গুনাহ’ সেটা রাজাকারেরা বোঝেনি। মনে করেছিল যুদ্ধ চলছে। শত্রুপক্ষের সম্পত্তি ও নারী ভোগ করা তাঁদের অধিকারের মধ্যেই পড়ে। বাংলাদেশে ‘রাজাকার’ তাঁদেরই বলা হয়, যাঁরা উর্দুভাষী পাকিস্তানের পক্ষে বাঙালির বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিল যে বাঙালি বিভীষণরা। সুযোগসন্ধানী সেই সমস্ত বাঙালিরা বাঙালিদের হত্যার হত্যার পাশাপাশি বাঙালি মেয়েদের ধর্ষণ করেছিল। গনিমতের মালে ধর্ষণের কোনো বিধান নেই। ধর্ষণ ও গনিমতের মাল এক করে ফেলা হয়েছিল। গনিমতের মাল মানে নারী ভোগ নয়। যুদ্ধে পরাজিত দলের রেখে যাওয়া সম্পত্তির উপরে বিজয়ী দলের অধিকার। পরাজিত দলের মানুষদের বাড়িতে ঢুকে লুটপাট নয়। তাঁরা যখন কোনো কিছু রেখে স্থানত্যাগ করবে, তখন সেই সম্পদ বিজয়ী দলের মধ্যে ভাগ বাটোয়ারাই হল গনিমতে মাল। নারী কি সম্পত্তি?
ইসলামে নারীর সম্মতি ছাড়া নিজ স্ত্রীর সঙ্গে যৌনকর্ম করাও নিষিদ্ধ। স্ত্রীর শরীর খারাপ। আপনি যদি অসুস্থ স্ত্রীর সঙ্গে সেক্স করেন তবে আপনি পাপকর্ম করছেন। এটা অপরাধ। ইসলামে দাসীর সঙ্গে যৌনকর্মকে বৈধতা দিয়েছে। তার মানে এই নয় যে, এই দাসী বাড়ির কাজের মেয়ে নয়। সেই দাসী হল উপপত্নী। সেক্ষেত্রে আপনার স্ত্রীর সব অধিকার দাসীকে দিতে হবে। এক অর্থে সেই ‘দাসী’ নিজের স্ত্রীই হয়ে যায়। গনিমতের মাল হিসাবে যদি দাসী ভোগ করা যায়, তবে সেই দাসীকে আপনাকে উপপত্নী করতেই হবে। নিজের স্ত্রীর মতোই মর্যাদা দিতে হবে। এককথায় নিজের স্ত্রী করতে হবে। এই দাসপ্রথা যেহেত বহু বছর বিলুপ্ত হয়ে গেছে, তাই দাসীর সঙ্গে যৌনকর্ম করাও বর্তমানে প্রাসঙ্গিকতা।
অনেকে বলেন গনিমতের মাল হল প্রাচীন আরবের সংস্কৃতি। সেই গনিমতের মালের বিষয়টি ওই সময়ের যুদ্ধে প্রেক্ষাপটে চালু হয়েছিল, সেটা ইসলাম চালু করেনি। আগে থেকেই আরবে চালু ছিল। প্রাচীন যুগ তো এখন আর নেই। আজ থেকে ১৪০০ বছর পরে বর্তমান যুগ হবে প্রাচীন যুগ। ওই সময়ের প্রেক্ষাপট ও এখনকার প্রেক্ষাপটের মধ্যে থাকবে আকাশ পাতাল ব্যবধান। গনিমতের মালের ব্যাপারটাও সেই রকম। তবে শুধু আরবেই নয়, সমগ্র বিশ্বেই বিজয়ী পক্ষ বিজিতের সম্পদের দখল করে নিত। দখল করা হত বিজিতের রাজ্য। সম্পদ বলতে শুধু ধনসম্পদই বোঝত না, বোঝাত নারী, পুরুষ, শিশু সব। নারীদের দাসী করা হত, পুরুষদের দাসে পরিণত করা হত। এ ব্যবস্থা ভারতেও ছিল। এটা কোনো ধর্ম সম্প্রদায়ের বিষয় নয়, এটা বিজিতের প্রতি বিজয়ীর বিষয়। ভারতও একসময় যুদ্ধরত উপমহাদেশ ছিল। সে সময় যুদ্ধের সময় রাজাদের সেনাদের দলে ভিড়ে যেত সাধারণ মানুষও। তখন তো সারা বছর চাষাবাদ হত না। ফলে ঝুঁকিপূর্ণ হলেও বিজিতের সম্পদ লুঠ করার জন্য বিনা প্ররোচনায় যুদ্ধে অংশগ্রহণ করত। যা পেত তাই-ই নিয়ে চলে আসত। অতএব গণিমতের মাল বিষয়টা শুধুমাত্র মুসলিম বিজয়ীদের একচেটিয়া ছিল না।