তবে সেই সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে আরবসমাজে কোরানের মতো অনুশাসনের প্রয়োজন যতটা ছিল, পরে আর তেমন প্রয়োজনে আসে না। কারণ জীবনধারা বদলে গেছে নানা প্রযুক্তির কারণে। কিছু জীবনবিধান ছাড়া কোরান আর অক্ষরে অক্ষরে অনুসরণ করা সম্ভব হয় না। তাল কেটে যায়। সময়ের দাবিতে কোরান অনেকটাই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছে। এখন ধর্মচর্চাতেই কোরানের সীমাবদ্ধতা। শুধু কোরান কেন, পৃথিবীর কোনো ধর্মগ্রন্থেরই আর প্রাসঙ্গিকতা নেই। পড়া আর পড়ে শোনানো ছাড়া। যেটুকু আছে, সেটুকু ধর্মব্যাবসা আর আধ্যাত্মিক উত্তরণের ক্ষেত্রেই। আর যুদ্ধনীতি আর প্রতিপক্ষ দমন? সেই যুদ্ধনীতি আর প্রতিপক্ষ দমন এখন আধুনিক রাষ্ট্রে সামরিক ক্ষেত্রে এর অন্যথা হয় না। কোরানের যুদ্ধনীতিতে এমন কিছু কি উল্লেখ আছে, যা আধুনিক সামরিকনীতিতে সেগুলি প্রয়োগ হয় না? কোরানে প্রতিপক্ষকে যেভাবে হত্যা করতে বলা হয়েছে, আধুনিক রাষ্ট্রযন্ত্রের সৈনিকরাও ঠিক সেইভাবেই প্রতিপক্ষকে হত্যা করে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আরও বেশি নৃশংস। অস্ত্র বদলেছে মাত্র। তলোয়ার, বল্লমের বদলে বুলেট ও বেয়োনেট এবং রাসায়নিক ও জীবাণু বোমা।
এবার আসি ‘গনিমতের মাল’ প্রসঙ্গে। অমুসলমানেরা অনেক সময়েই এই গণিমতের মাল প্রসঙ্গটা তুলে আনেন মুসলমান সম্প্রদায়কে হেয় করার জন্যে। আসলে এই গনিমতের মাল বিষয়টা কী? ‘গনিমতের মাল’ মানে হল যুদ্ধে শত্রুপক্ষের স্থাবর অস্থাবর সব সম্পদ, যা বিজয়ী দলের সদস্যদের মধ্যে ভাগ বাটোয়ারা করে দেওয়া হয়। সে সময় আরব উপত্যকায় অনেক যুদ্ধ হত। সেই যুদ্ধে পরাজিত দলের সব সম্পদ বিজয়ী দল নিজের করে নিত।
হজরত মোহাম্মদকে তখন তিনি ও তাঁর মুসলমান বাহিনী যুদ্ধে শত্রুপক্ষকে পরাজিত করলে যুদ্ধে পরাজিত দলের সব রেখে যাওয়া সম্পদের মালিকানা মুসলমান বাহিনীর দখলে আসত। তিনি সেই সম্পদের এক-চতুর্থাংশ নিজে রাখতেন পরিবারের জন্য, বাকি কিছু মুসলমান বাহিনীর সদস্যদের জন্য এবং বাকি সম্পদ তিনি দান করে দিতেন আরবের দরিদ্রদের জন্য। এমন নির্দেশ স্বয়ং কোরানেই আছে। কোরানে আছে মানে আল্লাহর নির্দেশ বলেই ধরে নেওয়া হয়। বলা আছে, ১/৪ অংশ আল্লাহ ও নবির, বাকি অংশ মুমিনদের ও গরিবদের।
সুরা আনফালে বলা হয়েছে– “গনিমতের মালের এক-পঞ্চমাংশ খোমস হিসেবে দিয়ে দেবে।” সুরা আনফাল মদিনায় অবতীর্ণ একটি সুরা। এতে রয়েছে ৭৫টি আয়াত ও ১০টি রুকু। অবতীর্ণ হওয়ার ধারাক্রম অনুযায়ী এ সুরা হল ৮৮ নম্বর সুরা। কিন্তু চূড়ান্ত সংকলন বা বিন্যাসে এই সুরা পবিত্র কোরানের অষ্টম সুরা হিসাবে স্থান পেয়েছে। ‘আনফাল’ নাফল শব্দের বহুবচন। এর আভিধানিক অর্থ অতিরিক্ত ও অনুগ্রহ। আর প্রচলিত অর্থে গনিমতের মালকে বলা হয় ‘আনফাল’। মিলের দিকটি হল আনফালও ‘মহান আল্লাহর এক অনুগ্রহ। আর ইসলামি শরিয়তের দৃষ্টিতে আনফাল বলা হয় কয়েকটি জিনিসকে। যেমন– প্রথমত, দারুল হারব বা কাফের শত্রুদের শাসিত অঞ্চলের যে সম্পদ বিনাযুদ্ধে অর্জিত হয়। দ্বিতীয়ত, সেই ভূখণ্ড যার অধিবাসীরা বিনাযুদ্ধে বহিষ্কৃত হয়েছে।
তৃতীয়ত, সেই ভূখণ্ড যা বিনাযুদ্ধে মুসলমানদের অধীনে এসেছে। চতুর্থত, মুসলমান ও কাফের নির্বিশেষে যে ভূখণ্ডের সব অধিবাসী মারা গেছে। পঞ্চমত, সেইসব অরণ্য, মরুদ্যান, মরুভূমি ও ঘর যার কোনো মালিক নেই। ষষ্ঠত, পাহাড়ের পাদদেশ। সপ্তমত, রাজা-বাদশাহদের রাজকীয় ও শাহী আসবাবপত্র, যা তাঁরা নানা ব্যক্তিকে উপহার হিসাবে দিয়েছে ও বর্তমানে তাঁর মালিক নেই এবং অষ্টমত, খনি ইত্যাদি।
.
সুরা আনফালের প্রথম আয়াত বলছে— “হে রসুল! তাঁরা আপনার কাছে জিজ্ঞেস করে, আনফাল বা গনিমত (তথা ব্যক্তি মালিকানাধীন সম্পদ ছাড়া অন্য যে-কোনো সম্পদ) সম্পর্কে। বলে দিন, গনিমতের মাল হল আল্লাহ এবং রসুলের জন্য নির্দিষ্ট। অতএব তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং তোমাদের পারস্পরিক সম্পর্কের বিষয়গুলো সংশোধন করে নাও। আর আল্লাহ এবং তাঁর রসুলের হুকুম মান্য করো, যদি ঈমানদার হয়ে থাক।” এই আয়াত বদর যুদ্ধে এসেছিল। এই যুদ্ধে পরাজয়ের মুখে কাফেররা পালিয়ে গেলে তাঁদের বহু জিনিসপত্র গনিমত হিসাবে মুসলমানদের হস্তগত হয় এবং বন্দি হয় অনেক কাফের। সাহাবিরা সে সময় তিন ধরনের দায়িত্ব পালন করছিলেন— সাহাবি সাদ বিন মায়াজসহ কেউ কেউ নবির তাঁবুর চারদিকে পাহারায় ছিলেন। হজরত আলি সহ কেউ কেউ কাফের নিধনে মশগুল ছিলেন। আর কেউ কেউ গনিমতের মাল জমা করতে ব্যস্ত ছিলেন। একদল মুজাহিদের মনে করে যে, তাঁরা যুদ্ধ করাতেই জয় এসেছে বলে গনিমতের পুরো মাল তাদেরই প্রাপ্য। আবার যাঁরা গনিমত সংগ্রহ করছিলেন, তাঁরাও একই ধারণা করছিলেন। তখন এ আয়াত হাজির হয়। এতে বলা হয়েছে যে, এইসব মাল বা গনিমত কেবলই আল্লাহ ও তাঁর রসুলের। তাই তাঁরা যাকে যতটা যোগ্য মনে করেন তাঁকে ঠিক ততটাই গনিমতের অংশ দেবেন। সুরা আনফালের প্রথম আয়াতটিকে গনিমতের মাল সংক্রান্ত বিশেষ বিধান বলে মনে হলেও আসলে এটি একটি সামগ্রিক হুকুম বা বিধান, ব্যক্তি মালিকানাধীন সম্পদ ছাড়া সব ধরনের সম্পদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। এই আয়াতের বক্তব্য অনুযায়ী এইসব সম্পদ মহান আল্লাহ, তাঁর রাসুল এবং রাসুলের স্থলাভিষিক্তের জন্য তথা অন্য কথায় ইসলামি রাষ্ট্রের জন্য নির্দিষ্ট যাতে এইসব সম্পদকে মুসলিম জনগণের কল্যাণে ব্যবহার করা যায়। তাই আনফাল হচ্ছে ইসলামি রাষ্ট্রের বায়তুল মালের অন্যতম প্রধান উৎস। আর যুদ্ধে। অর্জিত গণিমতের ৫ ভাগের ৪ ভাগ মুজাহিদদের প্রাপ্য এবং এটা তাঁদের কষ্ট ও পরিশ্রমের আংশিক প্রতিদান। বাকি এক-পঞ্চমাংশ হচ্ছে খোমস, যার ব্যবহারের খাতগুলো এই সুরার ৪১ নম্বর আয়াতে উল্লেখ করা হয়েছে।