- বইয়ের নামঃ ভারতে ইসলাম ভারতীয় মুসলিম
- লেখকের নামঃ অনির্বাণ বন্দ্যোপাধ্যায়
- প্রকাশনাঃ ঋতবাক
- বিভাগসমূহঃ ইতিহাস
১.০০ জবাবদিহি
ভারতে ইসলাম ভারতীয় মুসলিম (প্রথম খণ্ড : ৭১১ থেকে ১৮৫৭)
উৎসর্গ : কবি সুব্রত রায়কে
আমার সাহিত্যগুরু, যাঁর হাত ধরে মসিকে অসি করে নিয়েছি
সূচিমুখ
জবাবদিহি
ইসলাম এবং মুসলিম : গোড়ার কথা
এক হাতে তলোয়ার, অন্য হাতে কোরান
প্রাচীন ভারতের রাষ্ট্রভাবনা এবং ভৌগোলিক সীমানা
মধ্যযুগ : ভারতে মুসলিম শাসন
শাসকরূপে মুসলিমদের ভারতে প্রবেশ :
মোহম্মদ বিন কাসেম, সুলতান মামুদ, বখতিয়ার খলজি, মোহম্মদ ঘুরি, কুতুবউদ্দিন আইবক, ইলতুৎমিস, গিয়াসুদ্দিন বলবন, আলাউদ্দিন খিলজি, মোহম্মদ বিন তুঘলক, ফিরোজ শাহ তুঘলক, চেঙ্গিস খান, তৈমুরল, বাবর, হুমায়ুন, শেরশাহ সুরি, আকবর, জাহাঙ্গির, শাহজাহান, আওরঙ্গজেব, শিবাজী, দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ জাফর
সহায়ক গ্রন্থ ও পত্রপত্রিকা
জবাবদিহি
এক অদ্ভুত অসহিষ্ণু সময়ে আমরা বন্দি হয়ে পড়েছি। এ যেন এক চক্রব্যুহ। ঢুকে পড়েছি, বেরিয়ে যাওয়ার পথ চিনি না। এ এমন একটা সময়, যেসময় অর্ধসত্য, বানোয়াট-মিথ্যাচারকে সত্য বলে প্রতিষ্ঠা করার প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে এক শ্রেণির উগ্র জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠী। জাতীয়তাবাদ তথা হিন্দুত্ববাদের নামে প্রকৃত ইতিহাসকে বিকৃত করে সত্য বলে উপস্থাপন করতে উদগ্র উদগ্রীব হয়ে আছে। ইতিহাসবিমুখ আয়েসী মানুষ সেসব বিকৃত ইতিহাস দায়িত্বের সঙ্গে ছড়িয়ে দিচ্ছেন বিদ্বেষী মানুষজন। যে ভারতবর্ষের স্বপ্ন দেখেছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামীরা, তা আজ ভূলুণ্ঠিত। যে বিষবৃক্ষ ব্রিটিশ তথা খ্রিস্টান শাসকরা রোপণ করে গিয়েছিলেন, তাতে আমরা নিয়মিত জলসিঞ্চন করে মহিরূহে পরিণত করে ফেলেছি। ভারত এটি বহুমাত্রিক এবং বহুজাতিক উপমহাদেশ, তাকে একরঙা (গেরুয়া) করার চেষ্টা চলছে, যা অবৈজ্ঞানিক। হাজার হাজার বছর ধরে বিভিন্ন সংস্কৃতির সমন্বয় ও ভাব আদানপ্রদানের লীলাক্ষেত্র এই ভারতভূমি। সেই সংস্কৃতির নাম হিন্দু সংস্কৃতি। হিন্দুস্তান তথা ভারতের সংস্কৃতি বলে কোনো একক সংস্কৃতি হয় না। ভারতের সংস্কৃতি বলতে একটি মিশ্র সংস্কৃতিকে বোঝায়। যেমন –অনার্য সংস্কৃতি, আর্য সংস্কৃতি, বৌদ্ধ সংস্কৃতি, জৈন সংস্কৃতি, শক সংস্কৃতি, স্থূন সংস্কৃতি, শিখ সংস্কৃতি, ইসলামি সংস্কৃতি, মোগল সংস্কৃতি, আফগান সংস্কৃতি, সুফি সংস্কৃতি, তুর্কি সংস্কৃতি, খ্রিস্টান তথা মিশনারি সংস্কৃতি, ফরাসি সংস্কৃতি, ডাচ সংস্কৃতি, পর্তুগিজ সংস্কৃতি ইত্যাদি মিলিয়েই ভারতীয় সংস্কৃতি। এখন সব সংস্কৃতি মিলেমিশে একাকার। এর মধ্যে একটিকেও পৃথক করলে ভারত আর ভারত থাকে না। সেটা করলে এ দেশের পক্ষে এ সমাজের পক্ষে মোটেই কাম্য নয়।
এক শ্রেণির বিদ্বেষী মনোভাবাপন্ন মানুষ কোরানের গুটিকয়েক খণ্ডিত আয়াত উদ্ধৃতি করে এটা প্রমাণ করতে চায় যে, ইসলাম কত খতরনাক। ভারতের ক্ষেত্রে দু-চারজন মুসলিম শাসকের বিরুদ্ধে বিষোদগার করে সমগ্র মুসলিম জাতিকে কাঠগোড়ায় তুলে উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্পর্ক বিনষ্ট করছে এবং করেই চলেছে। কোরানের আয়াত উদ্ধৃতি করে এবং মুসলিম শাসকদের কলঙ্কিত করে এমন কিছু তাঁরা বোঝাতে চায় যে, মুসলিম মানেই হিন্দুদের বুকে তলোয়ার ঠুসে দিয়ে মুসলিম বানায়, বিধর্মী বলে হিন্দুদের কচুকাটা করে এবং মন্দির ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয়। বরং বারবার এটাই প্রমাণিত হয়েছে যে, সংখ্যাগুরুরা সর্বদাই সংখ্যালঘুদের উপর আক্রমণ করেছে এবং আজও করে। তা সে হিন্দু হোক বা মুসলমান, হিন্দু হোক বা বৌদ্ধ, ব্রাহ্মণ হোক বা শূদ্র। ইতিহাস সাক্ষী। প্রকৃত ইতিহাস কখনো-কখনো লুকিয়ে রাখা যায় বটে, কিন্তু ইতিহাস কখনোই মিথ্যা বলে না। খামোকা কোরান উদ্ধৃতি করে মুসলিমদের আসামীর কাঠগোড়ায় তোলা অর্থহীন, অপ্রাসঙ্গিক। আমি মনে করি কোরান শাসক দ্বারা লিখিত। যদিও ইসলামে বিশ্বাসীরা মনে করেন কোরান আল্লাহ কর্তৃক প্রেরিত। কোরান একটি রাজনৈতিক ধর্ম। তাই কোরানের একটা বড়ো অংশ জুড়ে রয়েছে যুদ্ধ বিষয়ক নির্দেশাবলি। যেখানে বলা হয়েছে শত্রুপক্ষকে কীভাবে জব্দ বা কবজা করতে হবে, কীভাবে বশে আনতে হবে এবং কীভাবে হত্যা করতে হবে। এমনভাবে হত্যা করতে হবে, যেন শত্রুর শেষ না থাকে। শত্রু যে-কোনো ধর্মগোষ্ঠীরই হতে পারে, ধর্মই যদি মানুষের একমাত্র পরিচয় হয়। কারণ ধর্মহীন বা নাস্তিকদের কোনো যুদ্ধের ইতিহাস নেই। অতএব প্রতিপক্ষের পরিচয় প্রতিপক্ষই। সব রাজাই পৃথ্বীরাজ চৌহান হবেন কেন? হওয়া উচিতও নয়। প্রতিপক্ষ বা শত্রুর কোনো ধর্মপরিচয় বিবেচ্য হতে পারে না। যুদ্ধক্ষেত্রে শত্রু। প্রতিপক্ষ নিধনই যুদ্ধনীতি। একজন যোদ্ধা কি প্রতিপক্ষ বা শত্রুকে গাল ধরে চুমো খাবে?
দেশ চালাতে হলে, অপরাধীদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে হলে এবং শত্রুপক্ষকে উচিত শিক্ষা দিতে একটা সুনির্দিষ্ট অনুশাসনের প্রয়োজন হয়, নির্দেশিকার প্রয়োজন হয়, যা প্রাচীন বা মধ্যযুগে ঈশ্বরের নামে প্রচারিত, এখন সংবিধানের নামে। এটা সারা পৃথিবীতেই প্রয়োজন হয়েছে। এর মধ্যে কোনো অন্যায় দেখি না। প্রাচীন যুগে এটা সময়ের দাবি ছিল। কোনো গোষ্ঠীর সংশ্লিষ্ট অনুশাসন পছন্দ না-হলে নতুন অনুশাসন রচনা করে নতুন ধর্মীয় গোষ্ঠী তৈরি করেছে। এইভাবে আজ সারা বিশ্বে ধর্মপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা প্রায় ৪২০০ টি। প্রাচীন ও মধ্যযুগে আইনগ্রন্থ বলতে এই ধর্মগ্রন্থকেই বোঝাত। অদৃশ্য কোনো সর্বশক্তিমানের অস্তিত্বের ভয় দেখিয়ে সেই অনুশাসন কায়েম করা হত। এতে কাজও হত। আজও মানুষ সেই সর্বশক্তিমানের ভয়ে সর্বদা ভীত থাকেন। তাঁরা ভাবেন রাষ্ট্রীয় আইন থেকে রক্ষা পেলেও সেই ‘সর্বশক্তিমান’-এর শেষ বিচারে কারোর রেহাই নেই। তিনি সব দেখতে পান, সব জানেন। কোরান এমন একটা সময়ে প্রণয়ন হয়েছে যখন আরবে চরম হানাহানি, খুনোখুনি, রক্তারক্তি এবং সামাজিক অস্থিরতা চলছে। কোরানের অনুশাসনের মাধ্যমে সমগ্র আরব সমাজকে এক ছাতার তলায় আনা সম্ভব হয়েছে। এটা যতটা সহজে বলা গেল, কাজটা তত সহজ ছিল না। সেই অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন একা হজরত মোহম্মদ। এমন একক মানুষের কৃতিত্ব সত্যিই ঈর্ষণীয়। তিনি চূড়ান্তরূপে সফল। তিনি এমন এক ধর্মীয় অনুশাসন প্রচার করলেন, যা অত্যন্ত সুসংগঠিত ও সুসংযত, যা আর কোনো ধর্মীয় অনুশাসনে পাওয়া যায় না। এই হজরত মোহম্মদের চরিত্র নিয়ে সারা পৃথিবী সরগরম। কী না, তিনি ছয় বছরের আয়েষাকে বিয়ে করেছেন। সেই যুগে এরকম বিয়ে কোটি কোটি হয়েছে। এই ভারতেও কয়েক বছর আগেও ছোটো ছোটো কন্যাদের বিয়ে হত। অনেকক্ষেত্রেই সেইসব শিশুকন্যাদের বিয়ে করত বয়স্ক পুরুষরা। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্রের স্ত্রীর বয়স ছিল পাঁচ বছর। অনুসন্ধান করলে এরকম অজস্র উদাহরণ দেওয়া যায়। আর-একটি অভিযোগ, তিনি একাধিক বিয়ে করেছিলেন। একাধিক মানে তিনি তেরোটা বিয়ে করেছিলেন। প্রাচীন ও মধ্যযুগের শেষভাগ পর্যন্ত কোনো পুরুষদেরই একাধিক বিয়ের ব্যাপারে কোনো নিষেধাজ্ঞা ছিল না। সামর্থ্য অনুযায়ী যে যতখুশি বিয়ে করতে পারত, সারা পৃথিবীতেই। হিন্দু ম্যারেজ অ্যাক্ট প্রচলন হওয়ার আগে পর্যন্ত ভারতের পুরুষরা একাধিক বিয়ে করত। তা ছাড়া রাজরাজড়ারাও একাধিক বিয়ে করত। তাঁরা যে সবাই কামনার জ্বালায় বিয়ে করত তা তো নয়, বেশিরভাগ বিয়েই করতে হত রাজনৈতিক কারণে। নারীভোগের ইচ্ছা হলে বিশ্বের সেরা সেরা সুন্দরীদের তুলে এনে ভোগ করার ক্ষমতা রাখতেন তাঁরা। বাল্মীকি বিরচিত রামায়ণের রাবণকে আমরা এভাবেই পেয়েছি। খামোক বিয়ে করতে যাবে কেন? গোটা পৃথিবীতে এমন কোনো রাজা বা শাসক ছিলেন নাকি, যাঁকে অসংখ্য বিয়ে করতে হয়নি?