যে সমস্ত আস্তিক্যবাদীরা নাস্তিক্যবাদীদের হেয় করেন, হত্যা করেন –তাঁরা ভুলে যাবেন না, পৃথিবী সৃষ্টির উষাকাল থেকেই আস্তিক্যবাদী শুধুমাত্র ধর্মের কারণেই লক্ষ লক্ষ নিরীহ মানুষদের হত্যা করেছেন। ব্রুনো, সক্রেটিস, গ্যালিলিয়োর মতো অসাধারণ মানুষ থেকে থাবা বাবার মতো সাধারণ মানুষদেরও নির্মমভাবে হত্যা করে আস্তিক্যবাদীরা। তবে মানবজাতির ইতিহাসে মানুষ সবচেয়ে বড় ধর্মীয় হত্যার সাক্ষী হয়েছেন ১৯৩৯ থেকে ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত, যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ নামে পরিচিত। এই ৪ বছরে কত লক্ষ মানুষের মৃত্যু হয়েছে তার সঠিক হিসাব কে রেখেছে! হাজার হাজার ইহুদি হত্যা এবং খেদানোর মধ্য দিয়েই এই যুদ্ধের সূত্রপাত। কারণ জার্মানিরাই প্রকৃত আর্য, বাকি সব ম্লেচ্ছ। আর্য তথা নাৎসি সংস্কৃতিই শ্রেষ্ঠ। অতএব বিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অ-জার্মান এবং ইহুদিদের দেশ থেকেই বিতাড়ন। সমগ্ৰজাতিকে Regimentation বা নাৎসি ছাঁচে ঢেলে ফেলা হয়। সঙ্গে তীব্র ইহুদি বিদ্বেষ প্রচারিত হয়। অসংখ্য শিশুদের ইহুদি-বিদ্বেষের দীক্ষা দেওয়া হয়। পথেঘাটে ইহুদিরা নির্যাতিত হন। বহু ইহুদি নির্যাতনের ফলে জার্মানি ছাড়তে বাধ্য হন। হিটলারের এক আদেশে ইহুদিরা জার্মানিতে অবাঞ্ছিত, ক্ষতিকারক, ঘৃণিত সম্প্রদায়ে পরিণত হয়। ঘোষণা করা হল–One people, one party, one fuehrer । শুধু মানুষ নয় –ধর্মীয় কারণে লক্ষ লক্ষ গোরু, পাঁঠা এবং অন্যান্য প্রাণীরাও হত্যার শিকার হয় বলি বা কোরবানির নামে। খাদ্য খাদকের সম্পর্কে নয়, বলি বা কোরবানি দেওয়া হয় মানুষের স্বর্গে ঠাঁই পাওয়ার লোভে। এক্ষেত্রে আমার কিছু বলার থাকত না, যদি গোরু বা পাঁঠা বা মহিষরাও স্বর্গে ঠাঁই পাওয়ার ইচ্ছায় মানুষদেরও ধরে ধরে বলি বা কোরবানি দিত। সবই একতরফা কেন হবে–ঈশ্বরের এ কেমন বিচার!
আস্তিক্যবাদ ও নাস্তিক্যবাদের তুলনামূলক ব্যবচ্ছেদ করলেই দিনের আলোর মতো পরিষ্কার হয়ে যাবে সাদৃশ্য এবং বৈসাদৃশ্য। জোর করে মানতে হবে না। কোনো চাপাচাপির বিষয় নয়, এটা চোখের চশমা নামিয়ে সাদাকে সাদা কালোকে কালো দেখতে পারলে বিতর্কের কোনো অবকাশই নেই। যুক্তি ছাড়া ব্যাখ্যা ছাড়া সত্যের প্রত্যক্ষ হয় না। আসুন দেখা যাক, মতের মিল হয় কি না-–
(১) আস্তিকদের নির্দিষ্ট পুরোহিত, ইমাম, পাদরি, পোপ ইত্যাদি থাকে। অপরদিকে নাস্তিকদের তেমন কিছু নেই যে, যাঁদের বাণীবৃষ্টি তাদের জন্য ধ্রুব সত্য। যদি অন্যদের সঙ্গে নিজের ভাববিনিময় করলে তাকে প্রচারক বলা হয়, তবে প্রত্যেক নাস্তিককেই প্রচারক বলা যায়। তাই বলে নাস্তিকদের ধর্মপ্রচারকদের সঙ্গে তুলনা করলে মহাভুল হবে। ধর্মপ্রচারকরা সুনির্দিষ্ট একটি মত প্রচার করে, যেখানে নিজেদের মত ছাড়া বাকি সব মত ফালতু। অপরদিকে নাস্তিকরা কেবলমাত্র নিজের ভাবনা বা দর্শন অন্যদের সঙ্গে বিনিময় করে মাত্র–ধার্মিকদের মতো চাপিয়ে দেয় না, গা-জোয়ারি করে না।
(২) নির্দিষ্ট ধর্মে সকল ভৌগোলিক অঞ্চলের জন্য একই এবং সুনির্দিষ্ট সংস্কৃতি পালন করতে বলা হয়। কিন্তু নাস্তিক্যবাদ ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চলে ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিকে গড়ে ওঠে এবং সে অঞ্চলের সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে যথাযথভাবে মূল্যায়ন করে।
(৩) নাস্তিকগণ যৌক্তিকচিন্তা ও বৈজ্ঞানিক তথ্য দ্বারা ধর্মের অযৌক্তিক বিষয়গুলি নিয়ে চিন্তা করতে সমর্থ্য, কিন্তু আস্তিকরা ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণ করা প্রতিস্পর্ধা মনে করেন। চোখে আঙুল দিয়ে ভণ্ডামি ধরিয়ে দিলেও চোখ খোলে না।
(৪) আস্তিকদের নির্দিষ্ট উপাসনাস্থল ও প্রার্থনাবাণী, পবিত্র তীর্থস্থান ইত্যাদি থাকে, যা নাস্তিকদের কাছে অর্থহীন।
(৫) আস্তিকরা বিশ্বাস করে তাদের একমাত্র কাজ ইষ্টদেবতার উপাসনা করা, ভালোমন্দ-পাপপুণ্য-প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি সবই ঈশ্বরের পায়ে সঁপে দেয়। অপরদিকে নাস্তিক্যবাদীরা কোনোকিছুই ঈশ্বরের কাছে সঁপে দেন না। ধৈর্য না-হারিয়ে বুদ্ধি শানিয়ে নিজের বর্তমান-ভবিষ্যৎকে নিয়ন্ত্রণে রাখে। নাস্তিকগণ ঈশ্বরের দোহাই দিয়ে হাত-পা ধুয়ে ফেলতে পারে না, নিজের অক্ষমতাকে ঢাকতে ঈশ্বরকে সাক্ষী মানে না।
(৬) প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মগুলিতে অন্ধবিশ্বাসের নানাবিধ বিষয় থাকে, যে-ব্যাপারগুলি সম্পর্কে প্রশ্ন করা অপরাধ, পাপ, তাই নিষিদ্ধ। অপরদিকে নাস্তিক্যবাদে বিশ্বাসের অন্ধত্বকে প্রশ্রয় দেয় না। (৭) আস্তিকগণ দেবতা, ভূত, জ্যোতিষ, তুকতাক, বশীকরণ, ওঝা-গুণিন, ডাইনি, ব্ল্যাক ম্যাজিক, মন্ত্রটন্ত্র ইত্যাদি অতিপ্রাকৃত বিষয় এবং ঘটনাবলিতে প্রশ্নহীনভাবে বিশ্বাস করেন। অপরদিকে নাস্তিকগণ এসব বিষয়গুলির বিরুদ্ধে অন্তহীন লড়াই করে যাচ্ছ।
(৮) আস্তিকরা কোনোরকম অস্বাভাবিক ঘটনার গন্ধ পেলে ঈশ্বরের কর্মকাণ্ড বলে বিশ্বাস করতে ভালোবাসেন। অপরদিকে নাস্তিকগণ খোঁজেন লৌকিক বা বাস্তব কারণ। কারণ নাস্তিকগণ মনে করেন পৃথিবী কেন পৃথিবীর বাইরে কোথাও অলৌকিক কাণ্ড ঘটে না, সবই লৌকিক। কারণ নাস্তিকগণ শুধু বিশ্বাসই করেন না, প্রমাণ করেন বাস্তবতা।
(৯) প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মগুলিতে সৃষ্টিকর্তার জন্য নিত্যপালনীয় কিছু কাজ করে প্রচুর সময় ব্যয় করেন, যা নাস্তিকগণের কাছে যা শুধু সময়ের অপচয়।