সমগ্র পৃথিবীতে কোটি কোটি প্রজাতির কোটি কোটি প্রাণী বসবাস করেন। প্রতিটি প্রাণীকেই টিকে থাকার জন্য সুযোগের সদব্যবহার করে। এটাই দস্তুর, এটাই প্রাণের সর্বজনীন ধর্ম। যে পারে সে থাকে, যে পারে না সে বিলুপ্ত হয় চিরতরে। পৃথিবীর সব কাজই সব প্রাণীই সুযোগ বুঝে করে। এটা তার জন্মগত অধিকার। তাইসব প্রাণীই সুযোগবাদী।
নাস্তিক্যবাদী সাহিত্যিক হুমায়ুন আজাদ কী বলছেন দেখি : “বিশ্বাস কাকে বলে? আমরা কি বলি আমরা পিঁপড়ায় বিশ্বাস করি, সাপে বিশ্বাস করি, জলে বিশ্বাস করি, বা বজ্রপাতে, বা পদ্মা নদীকে বিশ্বাস করি? এসব, এবং এমন বহু ব্যপারে বিশ্বাসের কথা ওঠে না, কেননা এগুলো বাস্তব সত্য বা প্রমাণিত। যা সত্য, যা প্রমাণিত, যা সম্পর্কে কোনও সন্দেহ নেই, তাতে বিশ্বাস করতে হয় না; কেউ আমরা বলি না যে আমি বিদ্যুতে বিশ্বাস করি, বা রোদে বিশ্বাস করি, বা গাড়িতে বিশ্বাস করি, কেননা সত্য বা প্রমাণ। প্রতি ব্যপারে বিশ্বাস করতে হয় না, বিশ্বাস করতে হয় অসত্য, অপ্রমাণিত, সন্দেহজনক বিষয়ে। অসত্য, অপ্রমাণিত, কল্পিত ব্যপারে আস্থা পোষণই হচ্ছে বিশ্বাস। বিশ্বাস ক’ ক্রিয়াটি নিশ্চয়তা বোঝায় না, বোঝায় সন্দেহ; আর এ-ক্রিয়ার অকর্তা পদে দু-রকম বিভক্তি হয় এবং বাক্যের অর্থ বিস্ময়করভাবে বদলে যায়। আমি বলতে পারি “আমি ঈশ্বরে বিশ্বাস করি, কিন্তু ঈশ্বরকে বিশ্বাস করি না”। এ-বাক্যে প্রথম ঈশ্বর অধিকরণ কারক, এতে বসেছে ‘এ’ বিভক্তি; আর দ্বিতীয় ঈশ্বর কর্মকারক, এতে বসেছে ‘কে’ বিভক্তি; এবং বাক্যটি বোঝাচ্ছে ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাস করলেও আমি তার ক্রিয়াকলাপ সম্পর্কে সন্দেহ পোষণ করি। বাঙলায় কিছুর অস্তিত্বে বিশ্বাস করার জন্য অধিকরণে সপ্তমী বিভক্তি হয়। বিশ্বাস নিশ্চয়তা বোঝায় না, সন্দেহই বেশি বোঝায়; তবে বিশ্বাসীদের স্বভাব ভাষার স্বভাবের বিপরীত; ভাষা যেখানে বোঝায় অনিশ্চয়তা, বিশ্বাসীরা সেখানে বোঝেন নিশ্চয়তা। মানুষের বিশ্বাসের শেষ নেই, কোটি কোটি বিশ্বাস পোষণ করে মানুষ। এমন মনে করার কোনও কারণ নেই যে এখন যেসব বিশ্বাস চলছে, সেগুলো চিরকাল ধরে চলছে; এখনকার বিশ্বাসগুলোর বয়স খুব বেশি নয়, এগুলোর আগে লাখ লাখ বিশ্বাসের উদ্ভব ও বিনাশ ঘটেছে; দেবতা বা ঈশ্বর বা বিধাতা বা কোনও বিশেষ স্রষ্টায় বিশ্বাস সেদিনের, চার-পাঁচ হাজার বছরের কথা; মানুষের বয়স তাদের বিভিন্ন দেবতা বা বিধাতাদের বয়সের থেকে অনেক বেশি।”
ধর্ম হল তাই-ই, যা ঈশ্বর নামক অনস্তিত্বকে সাক্ষীগোপাল করে নাগরিকদের শোষণ ও শাসনের অনুশাসনপত্র। আর ধর্মগ্রন্থগুলি হল প্রাচীনকালে শাসককর্তৃক রচিত অনুশাসনমালা, যা ‘ঈশ্বর’ নামক অদৃশ্য অস্তিত্বের ভয় দেখিয়ে প্রয়োগ করা হয়।
আজকাল আস্তিক্যবাদীদের মধ্যে বলা হচ্ছে নাস্তিকতাও নাকি একটি ধর্ম। নাস্তিক্যবাদ কোনোভাবেই ধর্ম নয়, যে কারণে কলকাতা বা ঢাকা কখনো দেশ নয়। নাস্তিক্যবাদ কোনো ধর্ম-ব্যবস্থার শর্ত পালন করে না, যেমনভাবে কলকাতা বা ঢাকা দেশের কোনো শর্ত পালন করে না। আস্তিক্যবাদীরা আসলে সব গুলিয়ে দিতে বদ্ধপরিকর। যেনতেনপ্রকারেণ একই গোয়ালের গোরু বানাতে চায়, মানুষকে বিভ্রান্ত করতে চায়। নাস্তিক্যবাদকে যাঁরা ধর্মের সঙ্গে তুলনা করে থাকে, তাঁদের বলি–(১) নাস্তিক্যবাদ যদি ধর্ম হয়, তবে–মদ্যপান না-করাও একটি নেশা, টেনিস-খেলাও একটি ক্রীড়া, বনের সিংহকেও মানুষ প্রজাতির বলতে হবে, স্ট্যাম্প বা মুদ্রা না-জমানোকে হবি বলতে হয়। (২) নাস্তিক্যবাদ ধর্ম হলে ‘অফ বাটনকে টিভি চ্যানেল বলতে হয়। (৩) নাস্তিক্যবাদ ধর্ম হলে আকাশকে বলতে হয় মেঘমালা।
বস্তুত ধার্মিকরা ধর্ম দ্বারা এতই প্রভাবিত যে, কোনোপ্রকার ধর্মবিশ্বাসহীনতাও যে একটা বোধ একটা দর্শন একজন মানুষ হতে পারে, তা কল্পনা করা তাদের বোধশক্তির বাইরে। যারা নাস্তিক্যবাদকে ধর্ম বলে দাবি করে, তাদের নাস্তিক্যবাদ সম্পর্কে কোনো ধারণাই নেই এটা নিঃসংশয়ে বলা যায়। নাস্তিক্যবাদ কোনো কাঠামোবদ্ধ বিষয় নয়। নাস্তিকবাদীরা বলেন স্রষ্টা, দেবতা বা অতিপ্রাকৃত কোনোকিছুতে অবিশ্বাসই নাস্তিক্যবাদ। নাস্তিক্যবাদ
আস্তিক্যবাদের মতো কিছু সুনির্দিষ্ট লিখিত নিয়ম ও নির্দেশের সমাবেশ নয়। একজন নাস্তিকের দর্শন যে আঙ্গিকেই হোক না-কেন, গুরুদেব-জ্যোতিষ-ভূত প্রেত-ডাইনি-জিন-রত্ন-পাথর-তন্ত্র-মন্ত্র-ঈশ্বরে অবিশ্বাস করলেই সে নাস্তিক্যবাদের আওতাভুক্ত। নাস্তিক্যবাদ একটি অলিখিত দর্শন–আস্তিক্যবাদের মতো প্রমাণ ছাড়া কিছু বিশ্বাস করতে বলে না। নাস্তিক্যবাদে যে-কোনো বিষয়ে প্রশ্ন করা যায়, প্রমাণ চাওয়া যায়, প্রমাণ করতেই হয়। নাস্তিক্যবাদীরা যদি বলেন ভারতের উত্তর-পূর্ব জুড়ে হিমালয় পর্বতমালা অবস্থান করে আছে, তবে তা প্রমাণ করে দেখাতে সক্ষম। নাস্তিক্যবাদীরা কখনোই বলবেন না ভারত মহাসাগরের অনেক গভীরে যে জঙ্গল আছে সেই জঙ্গলে হাজার হাজার রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার বিচরণ করে। কারণ ওটা প্রমাণ করা যাবে না। অপরদিকে কোনো আস্তিক্যবাদীকে যদি একথা বলা যায়, তবে তা বিশ্বাস করে ফেলবে। কারণ আস্তিক্যবাদীদের যে বিশ্বাস ছাড়া কিছুই নেই–“বিশ্বাসে মিলায়ে বস্তু তর্কে বহুদূর”। নাস্তিক্যবাদীদের বিশ্বাস’ ছাড়া সবই আছে। নাস্তিক্যবাদীরা প্রশ্ন করে–উত্তর খোঁজে, খোঁজার চেষ্টা চালিয়ে যায় নিরন্তর। আস্তিক্যবাদীদের কোনো প্রশ্ন নেই, তাই প্রশ্নের উত্তরও নেই। আস্তিক্যবাদী এবং নাস্তিক্যবাদীদের মধ্যে মূলগত পার্থক্য–একপক্ষ দৃষ্টিহীন, অপরপক্ষ চক্ষুষ্মন। দৃষ্টিহীনেরা অন্যের চোখে প্রত্যক্ষ করেন, কিংবা মনে মনে গড়ে নেয় অদৃশ্য পৃথিবী–এদের সঙ্গে প্রতারকেরা খুব সহজেই প্রতারণা করে। চক্ষুম্মানদের কাছে বনকুলকে আপেল বলে বেচা যায় না। আস্তিক্যবাদীরা ভিক্ষাবৃত্তি (পুণ্যলোভে ভিক্ষা দিয়ে এই বৃত্তিকে বাঁচিয়ে রেখেছে), বেশ্যাবৃত্তির মতো পেশার সাক্ষাৎ স্রষ্টা। আস্তিক্যবাদীরা বেশ্যাবাড়ির মাটি না-পেলে দুর্গাপুজো করতে পারবেন না। তাই বেশ্যাবৃত্তিও থাকতে হবে, দুর্গাপুজোও থাকবে।