আস্তিকরাও প্রধানত দুই প্রকার–(১) প্রকৃত আস্তিক এবং (২) ছদ্মবেশী আস্তিক।
(১) প্রকৃত আস্তিক : সংকীর্ণ অর্থে–যিনি সব ধর্মের ঈশ্বরকেই বিশ্বাস করেন, যিনি অন্য কোনো ধর্মের মানুষদের হেয় চোখে দেখে না, যিনি ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে পূজা-পাঠ করেন –তিনিই প্রকৃত আস্তিক।
ব্যাপক অর্থে –যিনি ধর্মের নামে রক্তপাত ঘটান না। যিনি গুরুদেব, জ্যোতিষ, ভূত-প্রেত-ডাইনি-জিন-রত্ন-পাথর-তন্ত্র-মন্ত্র-মানতে আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করেন, তারাই প্রকৃত আস্তিক।
(২) ছদ্মবেশী আস্তিক : সংকীর্ণ অর্থে–যিনি নিজ ধর্ম ব্যতীত অন্য সকল ধর্ম এবং ধর্মের মানুষদের ঘৃণা করেন, যিনি নিজ ধর্মকে সর্বশ্রেষ্ঠ বলে গলা ফাটান, অন্য ধর্মকে হেয় করেন তিনিই ছদ্মবেশী আস্তিক।
ব্যাপক অর্থে –যিনি গুরুদেব-জ্যোতিষ-ভূত-প্রেত-ডাইনি-জিন-রত্ন-পাথরগুলি কখনও বিশ্বাস, আবার কখনও বিশ্বাস করেন না। যেখানে যেমন সুবিধা সেখানে তেমন সুবিধামতো বিশ্বাস-অবিশ্বাস নির্ভর করে। এঁরা ধর্মেও আছে জিরাফেও আছে। এঁদের ধর্মের নামে রক্তপাত ঘটাতে হাত কাঁপে না। এঁরা হিন্দু ধর্মের নামে মুসলিম হত্যা করে, এরা ইসলাম ধর্মের নামে হিন্দু হত্যা করে, এঁরা খ্রিস্টধর্মের নামে ইহুদি হত্যা করে। এরা ঈশ্বর এবং ধর্মে অবিশ্বাসীদের হত্যা করে। এরা কবর থেকে মহিলাদের মৃতদেহ তুলে এনে ধর্ষণ করার নির্দেশ দেয়। কারণ এঁরা ছদ্মবেশী আস্তিক। সারা বিশ্বে এই ছদ্মবেশী আস্তিকদের সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি। এঁরা সভ্যতার বোঝা, পৃথিবীর জঞ্জাল রূপে পরিগণিত হয়। এঁরা ধর্মকে নিজের সুবিধামত ব্যবহার করেন। এঁরা ধর্মের নামে ব্যাবসা ফাঁদেন। এরা অপরের ধর্ম তো দূরের কথা, স্বধর্ম এবং ধর্মগ্রন্থ বিষয়েও কিস্যু জানে না। বর্তমানে এইসব ছদ্মবেশী আস্তিকদের জন্যই মূলত সাধারণ মানুষদের মধ্যে ধর্মের প্রতি অনাস্থা বাড়ছে।
বস্তুত আমার মনে হয়, নাস্তিক হওয়াটা খুব কঠিন ব্যাপার। প্রচুর পরিশ্রম করতে হয়। প্রভূত পড়াশোনা করার প্রয়োজন হয়ে পড়ে। সমস্ত ধর্মগ্রন্থগুলি ঘেঁটে ফেলতে হয়। নৃতত্ত্ব, ভূগোল, প্রাচীন ইতিহাস, বিজ্ঞান নির্বিশেষে গ্রন্থগুলি অধ্যয়ন করে সম্যক জ্ঞান অর্জন করে যুক্তির তলোয়ার শাণিত করতে হবে। অসীম ধৈর্য এবং বিনয়ী হওয়া জরুরি। অপরদিকে আস্তিক হয়ে যাওয়াটা খুবই সহজ। শুধু বিশ্বাস করলেই হল। আর যদি কিছু বলতে চান তাহলে মন যা চায় গুছিয়ে বলে ফেলুন। আর একটু বেশি এবং গভীর কিছু বলতে চাইলে ধর্মযাজক, পুরোহিত, ধর্মধ্বজাধারীদের বলে দেওয়া বিবৃতি কপি-পেস্ট করে দিতে হবে। পরিশ্রম করে অনুসন্ধানের প্রয়োজন নেই, দায়ও নেই।
কোনো নাস্তিক যখন ধর্মকে আঘাত করে তখন গোটা সমাজ, গোটা রাষ্ট্র তাঁর বিরুদ্ধে খড়হস্ত হয়ে ওঠে; কিন্তু যখন কোনো ধর্মপ্রাণ কোনো নাস্তিককে আক্রমণ করে, তখন চুপ! বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও বলে ফেলেন–“নাস্তিকদের বরদাস্ত করা হবে না।” তাই নাস্তিকদের উচিত শিক্ষা দেওয়ার জন্য ওদেশে বিশেষ আইনও প্রস্তুত করে রাখা আছে। তাই ওদেশে নাস্তিকদের হত্যা করলে খুনিরা গ্রেফতার হয় না, কোনো শাস্তি হয় না। আস্তিকগণ যথাযথ জবাব দিন। আস্তিকদের বিশ্বাসটা বিশ্বাস, নাস্তিকদের বিশ্বাসটা কি ফাউ? ভুলে যাবেন না এই পৃথিবীতে আস্তিক্যবাদের বয়স এবং নাস্তিক্যবাদের বয়স প্রায় সমান। নাস্তিক্যবাদ কোনো ফ্যাশন নয়। নাস্তিক্যবাদও শক্ত ভিতের উপর দাঁড়িয়ে আছে। উড়ানোর চেষ্টা করবেন না। নাস্তিকরা আস্তিকদের মতো সশস্ত্র নয় বলে ভাববেন না নাস্তিক্যবাদ নিষ্ফলা। নাস্তিক্যবাদের রাষ্ট্রীয় মদত নেই বলে ভাববেন না নাস্তিক্যবাদ ভ্যানিশ হয়ে যাবে। মানুষের চাইতে বেশি মন্দির মসজিদ-গির্জ-বিহার গড়ে ফেলেছেন পৃথিবীর বুকে। তা সত্ত্বেও এত ভয় কীসের! ঈশ্বরে আস্থা নেই! সক্রেটিস, ব্রুনোদের হত্যা করে তো পরে
নিজেদের থুতু নিজেদেরই গিলতে হচ্ছে। আস্তিকদের বিশ্বাসে আঘাত করলে যদি অপরাধ হয়, তবে নাস্তিকদের বিশ্বাসে আঘাত করলেও একই অপরাধ হয়। মুদ্রার দু-পিঠের একপিঠকে অস্বীকার করলে মুদ্রা অচল হয়ে যায়! নাস্তিকরা মিথ্যা হলে, আস্তিকরাও মিথ্যা। কেবল আস্তিকরাই দিস্তাদিস্তা কাগজ খরচা করে বুকনি দিয়ে যাবেন, আর নাস্তিকরা মুখ বুজে হজম করবে? তাঁরা লিখবে না? তাঁরা তাঁদের মত প্রকাশ করবে না? কেন? আপনারা আপনাদের কথা বলছেন বলুন–ওটা আপনাদের মতাদর্শ। নাস্তিকরা বলবেন তাদের দর্শনের কথা–ওটা তাদের মতাদর্শ। সমস্যাটা কোথায়? সমস্যাটা হল আস্তিক্যবাদীরা নিজেরাই স্বঘোষিত সর্বজ্ঞানী বলে মনে করেন। আস্তিক্যবাদীরা অসহিষ্ণু, অন্যের মতবাদকে ধুলোয় মিশিয়ে দিতেচায়–অগণতান্ত্রিক। এক ধর্মের আস্তিক অন্য ধর্মের আস্তিকদেরই বিনাশ করতে খঙ্গহস্ত হয়। আস্তিক্যবাদীদের গ্রন্থ বা কিতাবে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ এবং ‘পরধর্মসহিষ্ণুতা’ বলে শব্দ নেই (এরা ধর্মনিরপেক্ষতা এবং ‘পরধর্মসহিষ্ণুতা’-র তীব্র বিরোধী)। আছে শুধু বিদ্বেষ, দাঙ্গা এবং ধর্মান্তরের সুতীব্র বাসনা। নাস্তিক্যবাদীরা কখনো কোনোদিনই ধর্মান্তরিত হয় না। নাস্তিক্যবাদীরা অন্য ধর্মের কারোকে বিবাহ করলেও ধর্মত্যাগ করে না বা করায় না। আস্তিক্যবাদীরা সবসময় যে-কোনো কারণেই হোক স্বধর্ম ত্যাগ করেন। এরা ধর্মত্যাগের মধ্য দিয়ে নতুন ধর্মকে জাতে তুলে ফেলে-আসা ধর্মকে বেজাত করে, খাটো করে। ধার্মিক বা আস্তিকদের ঈশ্বরের নাম ভাঙিয়ে সবরকম অন্যায় কর্ম করে পার পাওয়া যায়, নাস্তিকরা আর যাই-ই করুক ঈশ্বরের নাম ভাঙিয়ে কোনো সুকর্ম বা কুকর্ম কোনোটাই করেন না। সুকর্ম বা কুকর্মের সব দায় নিজের কাঁধে নেন, ঈশ্বর বা আল্লাহর কাঁধে চাপান না।