ঈশ্বর যদি এতই করিৎকর্মা, তাহলে পৃথিবীর প্রথম মানুষটির হাত দিয়েই ঐশীগ্রন্থটি পাঠিয়ে দিতেন এবং বলে দিতেন –“তোমাদের সৃষ্টি করে পৃথিবীতে পাঠাচ্ছি। কীভাবে তোমরা জীবনযাপন করবে তা এই গ্রন্থে বিস্তারিত লিখে দিয়েছি সহজ ভাষায়। সবাই অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলবে। এই নাও সেই ঐশী গ্রন্থ, যা তোমাদের জন্য সৃষ্টি করেছি।” না, তা হয়নি। হলে নবীন হোমোস্যাপিয়েন্সের হাতে প্রাচীন নিয়ান্ডার্থালদের পৃথিবী থেকে চিরতরে বিলীন হয়ে যেতে হত না। সেই সময়কার কথা –যখন মানুষের মুখে ভাষা ছিল না, অক্ষর ছিল না। তখন কেন ঐশীগ্রন্থগুলি মানুষের তুলে দেননি সেই তথাকথিত ঈশ্বর? কেন ঐশীগ্রন্থগুলি ভিন্ন ভিন্ন ভাষায় রচিত হল? কেন সকলের জন্য একই ভাষায় একটি গ্রন্থ রচিত হল না? কেন সংস্কৃত, হিব্রু, আরবির মতো দুবোধ্য ভাষায় গ্রন্থগুলি লেখা হল? আস্তিকরা কি কখনো এইসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছেন? না, খোঁজার চেষ্টা করেন না। কারণ একদা আস্তিকরাই বিশ্বাস করতেন পৃথিবীর চারপাশে সূর্য ঘোরে। উত্তর খুঁজেছিল নাস্তিকরা। নাস্তিকরা যেদিন প্রথম বলেছিল –“ভুল, পৃথিবীর চারপাশে সূর্য ঘোরে না। সূর্যের চারপাশে পৃথিবী ও অন্যান্য গ্রহ-গ্রহাণুরা নিরন্তর ঘুরে চলেছে।” সেইসব নাস্তিকদের উপর কম তো নির্যাতন করেনি আস্তিকরা। এমনকি হত্যা পর্যন্ত করেছে। আজও হত্যা করে চলেছে। অন্ধরা অন্ধকারে থাকতেই পছন্দ করে। আলোতে তাঁরা ঝলসে যায়। তাই ভয়ে ভীত হয়ে ব্রুনোদেরই ঝলসে দেয়। গ্যালিলিওদের কারাগারে নিক্ষেপ করে। সক্রেটিসদের হেমলক বিষ পান করতে বাধ্য করে।
জৈন দার্শনিক হরিভদ্র সুরীর ‘ষজ্ঞর্শনসমুচ্চয়’ গ্রন্থে ‘আস্তিকবাদিনা সূত্রের দেখা পাই। টীকাকার সোমতিলক সুরীর মতে পদটির অর্থ হল–“পরলোকগতিপুণ্য-পাপাস্তিক্যবাদিনা”। অর্থাৎ আস্তিকবাদী বলতে তাঁদেরকেই বোঝায় যাঁদের জন্মান্তরবাদ, পরলোক, পুণ্য, পাপ ইত্যাদিতে আস্থা আছে। অপরদিকে প্রাচীন ভারতের ‘আস্তিক নাস্তিক’-এর সংজ্ঞা ভিন্নরকম। পরলোকতত্ত্বে বিশ্বাসীদের ‘আস্তিক’ আর অবিশ্বাসীদের নাস্তিক বলা হত। পাণিনি রচিত ‘অষ্টাধ্যায়ী’-র নাম হয়তো কেউ কেউ জানবেন। এটি প্রাচীন ভারতীয় ব্যাকরণের একটি নির্ভুল গ্রন্থ হিসাবে সুবিদিত। পাণিনি ব্যাকরণ সূত্রে পাই : “অস্তিনাস্তিদিষ্টং মতিঃ” (৪/৪/৬০)। অর্থাৎ, পরলোক আছে ধারণায় প্রভাবিত ব্যক্তিকে ‘আস্তিক’ (দিষ্টং পরলোকো অস্তি) এবং “দিষ্টং পরলোকো নাস্তি”, অর্থাৎ পরলোক নেই ধারণায় প্রভাবিত ব্যক্তিকে ‘নাস্তিক’ বলা হয়েছে। (অস্তিগতিরস্য = আস্তিকঃ, পরলোকোহস্তি ইতি যস্য গতিরস্তি স আস্তিকঃ) পাণিনি সূত্রের ব্যাখ্যাকার ব্যাকরণবিদ মহর্ষি পতঞ্জলির ‘মহাভাষ্য’ গ্রন্থের মতানুসারে ‘অস্তি’ (আছে) ধারণার বশবর্তী ব্যক্তিগণ আস্তিক এবং ‘ন অস্তি’ (নেই) ধারণায় বশবর্তী ব্যক্তিগণ নাস্তিক পদের দ্বারা অভিধেয় (মহাভাষ্য ৪/৪/১)। আর-একটু খুলে লেখা যাক–বেদে বিশ্বাস এবং অবিশ্বাস দ্বারা নাস্তিক এবং আস্তিক বলা ছাড়াও আর কী কী কারণে নাস্তিক এবং আস্তিক বলা যায়? প্রতিটি ধর্মেই এই বিশ্বাস ও অবিশ্বাসের উপরে নানা বিভাজন আছে। যেমন খ্রিস্টধর্মে মূল দুই ভাগে ভাগ হয়ে আছ। একটি ক্যাথলিক, অপরটি প্রোটেস্ট্যান্ট। প্রোটেস্ট্যান্টরা পুণ্যপিতার কর্তৃত্ব অস্বীকার করে। আমি চেষ্টা করব আমার মতো করে এ বিষয়ে বিশ্লেষণ করার। প্রথমেই নাস্তিকদের আর আস্তিকদের একটু বুঝে নিই।
নাস্তিকরা প্রধানত দুই প্রকার –(১) প্রকৃত নাস্তিক এবং (২) ছদ্মবেশী নাস্তিক। আমরা জানব এই প্রকৃত’ এবং ছদ্মবেশী ব্যাপারটা কী। কাদের বলব প্রকৃত, কাদের বলব ছদ্মবেশী?
(১) প্রকৃত নাস্তিক : সংকীর্ণ অর্থে–যিনি ধর্ম এবং ধর্মগ্রন্থের সমস্ত গলিখুঁজি বিষয়ে সম্যকভাবে ওয়াকিবহাল এবং যিনি কোনো ধর্মের ঈশ্বরকেই (তিনি ভগবান-আল্লাহ-গড যেই-ই হোন-না-কেন) বিশ্বাস করেন না, তিনিই প্রকৃত নাস্তিক। প্রকৃত নাস্তিক সে জ্ঞানী। তাঁর সব ধর্মে সম্যক জ্ঞান আবশ্যিক। তাঁদের এই ধর্মীয় জ্ঞানের সঙ্গে পৃথিবীর কোনো পুরোহিত-পণ্ডিত-মুমিন-ইমাম পাদরিদের জ্ঞানের তুলনা চলে না। এইসব পুরোহিত-পণ্ডিত-মুমিন-ইমাম পাদরিরা কেবল নিজধর্মেই জ্ঞানী হতে পারেন, আবার নাও হতে পারেন। কিন্তু অন্য ধর্মে আকাট মূর্খ। দু-চারজন ব্যতিক্রম থাকতেই পারেন। ব্যতিক্রমরা আলোচ্য নয়। পুরোহিত-পণ্ডিতদের ঘরে বেদ-মনুসংহিতা-উপনিষদ না-ই থাকতে পারে, পাদরি-পোপের ঘরে বাইবেল না-ই থাকতে পারে, মুমিন ইমামের ঘরে কোরান-হাদিস না-ই থাকতে পারে –কিন্তু প্রকৃত নাস্তিকের ঘরে বেদ, উপনিষদ, মনুসংহিতা, কোরান, হাদিস, বাইবেল সব থাকতে হবে এবং নিবিড় অধ্যয়ন করবে। কজন আস্তিকের ঘরে একটি ধর্মগ্রন্থ পাওয়া যাবে? কিন্তু প্রতিটি নাস্তিকের ঘরে ধর্মগ্রন্থ পাওয়া সম্ভব। একটি নয়, একাধিক ধর্মগ্রন্থ থাকা স্বাভাবিক।
ব্যাপক অর্থে –যিনি গুরুদেব তথা গুরুবাদ, জ্যোতিষ, রত্ন-পাথর, ভুত-প্রেত জিন, পরি-পশ্লীরাজ, জলপড়া-তেলপড়া, বাটিচালান-হাতচালান বিশ্বাস করে না এবং যিনি সহিষ্ণু, তিনিই প্রকৃত নাস্তিক। এঁরা কোনো ধর্মীয় বা শাস্ত্রীয় বিধি বিধান পালন করেন না। এঁরা নিজের এবং অন্যের ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদিতে অংশগ্রহণ করেন না। প্রকৃত নাস্তিকরা জন্মান্তরবাদ, আত্মা-পরমাত্মা, ইহলোক পরলোক, পাপ-পূণ্য, স্বর্গ-নরক বিশ্বাস করেন না। প্রকৃত নাস্তিকরা মরণোত্তর দেহদান করে থাকে। মরণোত্তর দেহদানের মাধ্যমেই তাঁরা মানবকল্যাণে নিয়োজিত হন। বস্তুত আস্তিকদের মরণোত্তর দেহদান করার প্রবণতা কম। কারণ তাঁরা মনে করেন দেহ দেহাংশ দান করলে পরজন্মে ওই দেহাংশটি ছাড়াই জন্মাতে হবে। অর্থাৎ চোখ দান করলে অন্ধ হয়ে জন্মাতে হবে। কারণ আস্তিকরা পরজন্মে বিশ্বাসী। কিন্তু অঙ্গ প্রতিস্থাপনের প্রয়োজন হলে তখন অঙ্গের জন্য হাত পেতে থাকে। একবারের জন্যেও মনে হয় না অঙ্গ কোথা আসবে? অভিজিৎ রায়, ওয়াশিকুর, অনন্ত, হুমায়ুন আজাদ প্রমুখের মতো নাস্তিকরা চাপাতির কোপে নিহত হয়েছিলেন, তাঁরা কিন্তু মরণোত্তর দেহদান করেছিলেন। প্রকৃত নাস্তিকরা সমাজের শত্রু নয়, ধর্মেরও শত্রু নয়। এঁরা প্রশ্ন করতে শেখায়। উত্তর খুঁজে দেয়। (২) ছদ্মবেশী নাস্তিক : সংকীর্ণ অর্থে–যিনি আল্লাহকে বিশ্বাস করেন, কিন্তু ভগবানে বিশ্বাস নেই। অথবা ভগবান বিশ্বাস করেন, আল্লাহকে অস্বীকার করে–যিনি জ্যোতিষ বিশ্বাস করেন না, আবার রত্ন-পাথরে বিশ্বাস রাখে –যিনি ডাইনি বিশ্বাস করেন, আবার ভুত-প্রেতে বিশ্বাস রাখে না, তারাই ছদ্মবেশী নাস্তিক। ব্যাপক অর্থে–যাঁরা ধর্মের কিছু না জেনে, যিনি সমস্ত ধর্মাবলম্বীদের ধর্মগ্রন্থগুলি পাঠ করেনি, ঈশ্বরতত্ত্ব তলিয়ে দেখেনি, ভূগোল-বিজ্ঞান-ইতিহাসে সম্যক্ জ্ঞানলাভ না করে নেতিবাচক মন্তব্য করেন তিনিই ছদ্মবেশী নাস্তিক। না বুঝে যাঁরা হাসেন এরা তাঁদের দলে পড়েন। এঁরা আসলে ঈশ্বর নেই বলে তর্ক করলেও মন্দির-মসজিদ-গির্জার পাশ দিয়ে গেলেই নতমস্তকে প্রণাম সেরে নেন। এঁরা কিছু ধর্মীয় বা শাস্ত্রীয় বিধি-বিধান পালন করেন, কিছু পালন করেন না সুবিধা বুঝে। এঁরা ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদিতে অংশগ্রহণ করেন এরা অন্য ধর্মানুসারীদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগে এমন কথা বলে থাকেন। এরা মূলত সুবিধাবাদী, পরধর্মবিদ্বেষী।