বাংলাদেশী মুসলিম মৌলবাদীরা নাস্তিকদের এতটাই ঘৃণা করে যে, তাঁদের হত্যা করাটাকে পবিত্র কাজ বলে মনে করেন। হেফাজতে ইসলামের আমির ও হাটহাজারি মাদ্রাসার শিক্ষা সচিব শায়খুল হাদিস আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী ঘোষণা দেন–“নাস্তিক-মুরতাদ ধ্বংস করতে প্রয়োজনে শহীদ হব। শরীরে এক ফোঁটা রক্ত থাকতে বাংলাদেশকে স্পেন হতে দেব না। বিশ্বের দুই শত কোটি মুসলমানের ভালোবাসার প্রতীক রাসুলের বিরুদ্ধে ফ্রান্স সরকার ব্যঙ্গ ও কটাক্ষ করে মুসলমানদের কলিজায় আগুন লাগিয়েছে। রাসুলের অপমানের মোকাবিলায় রক্তের বন্যা বইয়ে দেব। যারা ইসলামের শত্রু, রাসুলের দুশমন, নাস্তিক-মুরতাদদের কবর রচনার জন্য হেফাজতে ইসলামের অভ্যুদয়।” এ প্রসঙ্গে এটুকু বলা যায় বাবুনগরীরা চিৎকার করুক তথাকথিত নাস্তিকদের মনে রাখবে মানুষ, মনে রাখবে ইতিহাস–বাবুনগরীরা শূন্যে বিলীন হয়ে যাবে, দু চারটে প্রজন্মের পর তাঁর পরিবার-পরিজনও মনে রাখবে না। মুসলিম মৌলবাদীদের মধ্যে ধারণা নাস্তিক মানেই তাঁরা লুইচ্চা, চরিত্রহীন, পরকীয়ায় লিপ্ত, পতিতাপল্লিতে রাত কাটায়, সমকামী সহ সব বদ অভ্যাসের অধিকারী। কারণ নাস্তিকরা ঈশ্বর বিশ্বাস করে না, তাই পাপকাজে তাঁদের কোনো ভয়ডর থাকে না। অর্থাৎ মুসলিম মৌলবাদী তথা ইসলাম ধর্মানুসারীরা কখনোই লুইচ্চা, চরিত্রহীন, পরকীয়ায় আসক্ত, পতিতাগমন, সমকামী হতে পারে না–এটাই বোঝায়। বাস্তব কিন্তু সেই সাক্ষ্য দেয় না।
তাকেই নাস্তিক বলা হয়, যে-ব্যক্তি একেবারে কোনো ধরনের প্রমাণ না-থাকার কারণে ঈশ্বরের অস্তিত্বের সপক্ষীয় দাবিতে অঅনাস্থা জ্ঞাপন করে। শুধু ঈশ্বরের বিরুদ্ধেই নয়, সমস্তরকম ভণ্ডামির বিরুদ্ধেই নাস্তিকরা অনাস্থা জ্ঞাপন করবে। এর বেশি কিছু নয়। বর্তমান যুগে জনসাধারণের মধ্যে ‘আস্তিক’ এবং ‘নাস্তিক সংজ্ঞা নিয়ে বেশ ভুল ধারণা আছে। এই ভুল ধারণার প্রতিফলন বিভিন্ন ক্ষেত্রে দেখতে পাই। মনুসংহিতার টীকাকার মেধাতিথি ‘নাস্তিক’ শব্দটির ব্যাখ্যা করেছেন “পরলোক বলে কিছু নেই, যাগ-দান-হোম এগুলিও কিছু নয়–এইরকম কথা যিনি বলেন এবং এই বিশ্বাসে যিনি চলেন তিনি নাস্তিক।”
এমতাবস্থায় অনেকে বলেন –দিন দিন যা দেখছি, সেদিন বেশি দূরে নয় যখন নাস্তিকতা একটি ধর্মে পরিণত হবে। আমি বলি–উঁহু, নাস্তিক্যবাদ কোনো ধর্মতত্ত্ব নয়। ধর্মতত্ত্ব ঈশ্বর ধারণার উপর প্রতিষ্ঠিত। যেখানে ঈশ্বর নেই, সেখানে ধর্মতত্ত্বের ভিত্তি নেই। ধর্ম তাকেই বলি, যা ঈশ্বরবিশ্বাস ও ঈশ্বর প্রদত্ত অনুশাসনকে বোঝায়। নাস্তিক্যবাদে ঈশ্বর অনুপস্থিত। নাস্তিক্যবাদীরা ঈশ্বর ও ঈশ্বরের নামে অনুশাসনকে অস্বীকার ও বিরোধিতা করে। নাস্তিক্যবাদীরা মনে করেন মানুষকে সুপথে চালিত করতে রাষ্ট্রীয় অনুশাসনই যথেষ্ট। মানুষকে সুপথে চালিত করতে ঈশ্বরের কোনো প্রয়োজন নেই। যে সুপথে চালিত হবে না, তাঁর কাছে ঈশ্বরের অনুশাসন হোক বা রাষ্ট্রীয় অনুশাসন, তা কোনো কাজেই আসে না। বস্তুত প্রকৃত সৎ ব্যক্তির কোনো অনুশাসনেরই প্রয়োজন হয় না। নাস্তিক্যবাদে যেহেতু কোনো ঈশ্বরের জায়গা নেই, তাই কাল্পনিক ঈশ্বরের অনুশাসনের গ্রন্থও আসমান থেকে নাজিল হয় না। নাস্তিক্যবাদীরা মনে করেন তথাকথিত ঈশ্বর যদি সত্যিই সর্বশক্তিমান হন, তাহলে কোনো ধর্মগ্রন্থরেই প্রয়োজন হত না। সবাই তাঁর অঙ্গুলী হেলনে সুপথে চালিত হত। ধর্মবেত্তা দালালদের প্রয়োজন হত না। ঈশ্বর যদি চাইতেই তাহলে গোটা ঈশ্বর একটিই থাকতেন। তাহলে এত ঈশ্বরের এত পৃথক ধর্মগ্রন্থ এবং এত পৃথক ধর্মগোষ্ঠীর উপস্থিতি থাকত না। তাহলে মানুষ “আমার ধর্ম বড়, আমার ধর্ম বড়ো” বলে জাহির করত না, রক্তারক্তি করত না।
বস্তুত অনুশাসন গ্রন্থের প্রয়োজন হয় রাষ্ট্রের নামে রাষ্ট্রনায়কের। রাষ্ট্রনায়কের অনুশাসন প্রয়োজন হয় নিজের ও রাষ্ট্রের সুরক্ষার জন্য। জনগণকে শাসন ও শোষণের জন্য। ঈশ্বরের নাম জড়িয়ে যারা ধর্মীয় অনুশাসন রচনা করেছিলেন, তাঁরাও তৎকালীন সময়োপযোগী রাষ্ট্রনায়ক। অনুশাসনের উদ্দেশ্যও একই। শুরুটা ঈশ্বরের ভয় দেখিয়ে মানুষকে শাসকের ক্রীতদাসে পরিণত করা গেলেও, পরে ঐশ্বরীয় অনুশাসন ভোঁতা হতে শুরু করল। প্রয়োজন হয়ে পড়ল রাষ্ট্রীয় অনুশাসন। ঈশ্বরীয় অনুশাসন অদৃশ্য, রাষ্ট্রীয় অনুশাসন দৃশ্যমান। রাষ্ট্রীয় অনুশাসনকে কায়েমকে রাষ্ট্র প্রভূত শক্তি মোতায়েন করে। ঈশ্বরকে নয়, মানুষ ভয় করে রাষ্ট্রের লেলিয়ে দেওয়া পুলিশ ও সেনাকে। ধুরন্ধর মানুষরা বুঝেছিল ঈশ্বরে ভয় তেমন কোনো কাজে আসে না। প্রাচীন যুগে ধর্মীয় অনুশাসন প্রয়োগ করে রাষ্ট্র শাসিত হলেও আধুনিক বিশ্বে ধর্মীয় অনুশাসন অচল, রাষ্ট্র-নির্ধারিত অনুশাসনই শেষ কথা। নাস্তিক্যবাদীদের কাছে রাষ্ট্র নির্ধারিত অনুশাসনই যথেষ্ট।
শুধু ধর্মগ্রন্থই নয়, আসলে মানুষ সবকিছুই সৃষ্টি করতে পারে। সৃষ্টি যেমন করতে পারে, ধ্বংসও করতে পারে। ভগবান, ঈশ্বর, আল্লাহ সবই মনুষ্যসৃষ্ট। ভগবান, ঈশ্বর, আল্লাহ অস্তিত্বের গুজবটি মানুষই ছড়িয়ে দিয়েছে। ভগবান, ঈশ্বর, আল্লাহ যে নামেই ডাকা হোক এরা অতি নবীন। মানুষ প্রবীণ। মানুষের চেয়ে কোটি কোটি বছরের প্রবীণ ভাইরাস। ভাইরাস এখানে আলোচ্য বিষয় নয়। আলোচ্য বিষয় হল মানুষ আগে পৃথিবীতে এসেছে, তার অনেক পরে মানুষ ঈশ্বরকে সৃষ্টি করেছে। ঈশ্বরকে কেন সৃষ্টি করতে হয়েছে, সে বিষয়ে এই গ্রন্থের পরবর্তী প্রবন্ধে বিস্তারিত আলোচনা করেছি।