তসলিমা নাসরিনকে চেনে না এমন কেউ নেই বোধহয়। তসলিমা তাঁর লেখালেখির মধ্য দিয়ে লিঙ্গসমতা, মুক্তচিন্তা, নাস্তিক্যবাদ এবং ধর্মবিরোধী মতবাদ প্রচার করায় ইসলামপন্থীদের রোষানলে পড়েন। মৌলবাদীরা মনে করেন তসলিমা নিজেকে নাস্তিক বলে দাবি করলেও তাঁর যত ক্ষোভ, যত ঘৃণা সব কিছুই কেবল ইসলাম ধর্মের উপর। সনাতন ধর্ম কিংবা খ্রিস্ট ধর্ম অথবা ইহুদীদের নিয়ে তাঁর কোনো মাথাব্যথা তেমন চোখে পড়ে না। এইসব মৌলবাদীরা তসলিমা নাসরিনের বিরুদ্ধে ফতোয়া ঘোষণা করেন। তাঁদের কাছ থেকে হত্যার হুমকি পেতে থাকায় ১৯৯৪ সালে তসলিমা বাংলাদেশ ত্যাগ করেন এবং বিভিন্ন দেশে বাস করতে বাধ্য হন। বর্তমানে তিনি ভারতে আছেন। আব্দুল লতিফ সিদ্দিকি বাংলাদেশে বেশ পরিচিত এক নাম। তিনি মনে করেন ধর্ম তামাক ও মদের মতো একটি নেশা। মোল্লাদের কোনো কাজ নেই, তাই তাঁরা ঘন ঘন মসজিদ তৈরি করেছে। টাকা ইনকামের জন্য আব্দুল্লাহর পুত্র মোহাম্মদ হজ্জের প্রবর্তন করেছিল। সভা-সমাবেশের শুরুতে কোরান তেলাওয়াত বন্ধ করা দরকার। এইসব বক্তৃতার নাস্তিক-বিদ্বেষী ইসলামপন্থীরা তাঁর উপর ক্ষেপে আছে। নাস্তিকের তালিকায় উঠে এসেছে সাহিত্যিক জাফর ইকবালের নামও। বাংলাদেশের নাস্তিকতা প্রচারের মিশন দিয়ে আমেরিকার একটি বিশেষ সংস্থা তাকে বাংলাদেশে পাঠিয়েছে বলে ধারণা করা হয়। তরুণ সমাজকে নাস্তিক হিসাবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। নিজে মুক্তিযুদ্ধ না করলেও জাফর এখন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিক্রি করে পেট চালায়। জাফরের দাবি সে পাকিস্তানের দোষর রাজাকারদের ঘৃণা করে, কিন্তু আশ্চর্য হলেও সত্য ৭১ সালে পাকিস্তানকে সর্বপ্রকার সমর্থন ও সামরিক সাহায্য দেওয়া রাষ্ট্র আমেরিকার ব্যাপারে তার কোনো চুলকানিই নেই। জাফর নিজে আমেরিকায় চাকরি করত, এখন সে তাঁর ছেলে-মেয়েদেরকেও আমেরিকা পাঠিয়েছে পড়াশোনা করার জন্য।
সাহিত্যিক আনিসুল হক। ধর্মনিরপেক্ষ লেখক আনিসুল হক নাস্তিকপন্থী পত্রিকা প্রথম আলো’-র সহকারী সম্পাদক। ১৯৯১ সালে সে কোরানের একটি সুরাকে ব্যঙ্গ করে প্যারোডি সুরা রচনা করে, কয়েক বছর আগে তার ওই লেখা। পুনঃপ্রকাশিত হলে দেশ উত্তাল হয়ে ওঠে। আনিসুল হক এতে ভয় পেয়ে যান এবং নিঃশর্ত ক্ষমা চায়। এরপর তিনি আরও কৌশলী হয়ে যান, সরাসরি ইসলাম অবমাননা না করে এখন সে তার নাটক-সিনেমা ও পত্রিকা দ্বারা ইসলাম বিরোধী তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছেন। সুলতানা কামাল চক্রবর্তীও নাস্তিকদের তালিকায়। জন্মসূত্রে তিনি মুসলিম হলেও বিয়ে করেছেন শ্রী সুপ্রিয় চক্রবর্তী নামে এক হিন্দুকে। সংবিধান থেকে ‘বিসমিল্লাহ ও রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম’ তুলে দেওয়ার জন্য বহু বছর ধরে চেষ্টা করে যাচ্ছে তিনি। তাই তিনি কুখ্যাত সেকুলার হিসাবে চিহ্নিত হয়ে গেছেন। ইসলাম-বিদ্বেষী নাস্তিকদের প্রতি সে প্রকাশ্য সমর্থন দিয়ে থাকে। আসিফ মহিউদ্দিন নামক নাস্তিককে ইসলাম অবমাননার অভিযোগে যখন ডিবি পুলিশ গ্রেফতার করেছিল তখন সে আসিফকে ছাড়ানোর চেষ্টা করেছিল। সারারাত থানায় অবস্থান করে নাস্তিক আসিফকে নৈতিক সমর্থন দিয়েছিল। কবির চৌধুরী চরমপন্থী নাস্তিক হিসাবে পরিচিত। কারণ তিনি একবার বলেছিলেন–“তোমরা আমার মরণের সময় মোহাম্মদের জ্বালাও-পোড়াও ওই কালেমা শোনাবে না, বরং রবীন্দ্রনাথের একটি সংগীত আমাকে শুনাবে।” সংবিধানে ‘বিসমিল্লাহ’ রাখার ব্যাপারেও কবির চৌধুরী আপত্তি তুলেছিল। সৈয়দ শামসুল হককেও নাস্তিক বা ‘উগ্র সেকুলার’ বলা হয়। মুনতাসির মামুন নাস্তিক। তিনি সভা-সমাবেশে বলেন –“বিসমিল্লাহ বলা বা কোরান পড়ার দরকার নেই। সংবিধানে ‘বিসমিল্লাহ’ থাকা আমাদের জন্য অপমানস্বরূপ। আমরা তো সংবিধানে আল্লাহর নাম অথবা বিসমিল্লাহ থাকবে সেজন্য দেশ স্বাধীন করিনি। ধর্ম যেমন ভণ্ডামি তেমনি মৌলবাদীদের সব ভণ্ডামি। বঙ্গভবনের দেয়ালে কোরান শরিফের আয়াত লেখা এটা একটা চরম ভণ্ডামি।” মুনতাসির বলেন–“এদেশে একজন মুসলমানও যত দিন। থাকবে ততদিন পর্যন্ত আমাদের সংগ্রাম চলবেই চলবে।”
ব্লগার রাজীবকে (ওরফে থাবা বাবা) নাস্তিকতার দায়ে মুসলিম মৌলবাদী আততায়ী হত্যা করে। রাজীব নবি মোহাম্মদকে মহাউন্মাদ কিংবা মোহাম্মক (মহা+আহাম্মক) নামে উল্লেখ করত। হাদিসকে চটি গ্রন্থ এবং কোরানকে সে কৌতুকের বই বলত। বিভিন্ন সময়ে আল্লাহ নবির সাহাবীদেরকে নিয়ে চটি গল্প লিখে ‘ধর্মকারী’ নামে ব্লগে প্রকাশ করত। কোরানের বিভিন্ন আয়াতের উদ্ধৃতি দিয়ে সেগুলোর ব্যাখ্যা দিয়ে ঠাট্টা ও হাসি-তামাশা করত। তাঁর এসব কার্যকলাপ তাঁকে বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে কুখ্যাত ইসলাম-বিদ্বেষী নাস্তিকের মর্যাদা দিয়েছে। আসিফ মহিউদ্দিনকে ‘কুখ্যাত’ নাস্তিক বলা হয়। মৌলবাদীরা বলেন ইসলাম অবমাননার দিক দিয়ে থাবা বাবার পরেই তাঁর অবস্থান। মৌলবাদীরা মনে করেন, তাঁর ইসলাম-বিদ্বেষী কার্যকলাপে খুশি হয়ে জার্মান সরকার তাকে ওই দেশের ভিসা উপহার দিয়েছে। বর্তমানে সে জার্মানি থেকে ফেসবুক ও ব্লগে ইসলাম-বিদ্বেষী লেখালেখি করে থাকে। আসিফের দাবি আল্লাহ নিজেই নাস্তিক, অতএব নাস্তিক হওয়াটা দোষের কিছু নয়। আসিফ মহিউদ্দিন কোরানকে ‘আহাম্মোকোপিডিয়া’ বলে থাকে। তিনি কোরানের আয়াতকে বিকৃত করে “আউজুবিল্লাহি মিনাশ শাইতানির নাস্তিকানির নাজিম” বলে এবং নবি হজরত মোহাম্মদের কল্পিত ছবি তাঁর ব্লগে প্রকাশ করে। ফরহাদ মজহার বাংলাদেশের আর-একজন প্রসিদ্ধ নাস্তিক। এখন তিনি আওয়ামি লিগ বিরোধী অবস্থানে আছেন। তিনি এখন আর আগের মতো নাস্তিকতা প্রচার করে বেড়ায় না, উল্টে ইসলামপন্থীদের পক্ষাবলম্বন করে কলাম লেখে, বিবৃতি দেয়। তবে একসময় তিনি ছিলেন একজন ইসলাম বিদ্বেষী নাস্তিক। নব্বইয়ের দশকে ‘এবাদতনামা’ নামে একটি ইসলাম-বিদ্বেষী কাব্যগ্রন্থ লিখে সে বেশ বিতর্কিত হয়েছিল। কয়েকটা লাইন উল্লেখ করছি–“বিবি খাদিজার নামে আমি এই পদ্যটি লিখি, বিসমিল্লাহ কহিব না, শুধু খাদিজার নাম নেব। নবিজির নাম? উঁহু, তাঁর নামও নেব না। মালিক শুধু খাদিজার নাম–দুনিয়ায় আমি সব নাম ভুলে যাব। তোমাকেও ভুলে যাব, ভুলে যাব নবিকে আমার।” তার আরেকটা কবিতা–“দুনিয়া রেজিস্ট্রি করো, তিলেক হিম্মত নাই আধা ছটাকের নাই তেজ সাত আসমানে প্রভু খোদাতালা হয়ে বসে আছ মুখে খালি কহ শুনি দুনিয়ার তুমিই মালিক অথচ মালিক অন্যে, অন্যে কহিতেছে তারা খোদা মালিক এ জমিনের–প্রত্যেকেই তোমার শরিক তোমার শরিক নাই এই কথা তবে কি বোগাস? এদের দলিল যদি মিথ্যা হয় যাও আদালতে উকিল ধরিয়া করো দুনিয়া রেজিস্ট্রি নিজ নামে।” শফিক রেহমানকে বাংলাদেশে ‘ভ্যালেন্টাইন ডে’ নামক ‘বিজাতীয় সংস্কৃতির প্রবর্তক বলা হয়। ১৯৯৩ সালে তিনি সর্বপ্রথম তাঁর পত্রিকা যায় যায় দিন’-এর মাধ্যমে এদেশে ‘ভালোবাসা দিবস’-এর প্রচলন ঘটায়। আর তাতেই তিনি মুসলিম মৌলবাদীদের কাছে চক্ষুশূল। কবি দাউদ হায়দারকেও নাস্তিক বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। বলা হয় বাংলাদেশে স্বাধীন হওয়ার পর মাথাচাড়া দিয়ে জেগে উঠা স্বঘোষিত নাস্তিকদের অন্যতম সে। তাঁর কবিতায় তিনি আলেমদের উদ্দেশ্য করে লিখেছে–”মাথায় টুপি, মুখে দাড়ি….. আননে কি রূপের বাহার……এক্ষনি পাবে ভরে দেব মুখ”। তিনি ‘কালো সূর্যের কালো জ্যোৎসায় কালো বন্যায়’ নামে একটি কবিতা লিখেছিলেন। ওই কবিতাতে সে নবি মোহাম্মদ, জিশুখ্রিস্ট এবং গৌতম বুদ্ধ সম্পর্কিত অবমাননাকর উক্তি ছিল বলে সাধারণ মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করেছিল বলে মনে করা হয়। তখন বাংলাদেশে তৌহিদবাদী মানুষ এর বিরুদ্ধে প্রচণ্ড প্রতিবাদ শুরু করে। ঢাকার এক কলেজ শিক্ষক ঢাকার একটি আদালতে এই ঘটনায় দাউদ হায়দারের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছিলেন। তৎকালীন বঙ্গবন্ধুর সরকার কবি দাউদ হায়দারকে ১৯৭৩ সালে নিরাপত্তামূলক কাস্টডিতে নেওয়া হয়। ১৯৭৪ সালের ২০ মে সন্ধ্যায় তাঁকে জেল থেকে মুক্তি দেওয়া হয় এবং ২১ মে সকালে বাংলাদেশ বিমানের একটা রেগুলার ফ্লাইটে করে তাঁকে কলকাতায় পাঠানো হয়। তাঁর ভাষায়–“আমার কোনো উপায় ছিল না। মৌলবাদীরা আমাকে মেরেই ফেলত। মুজিব সরকারও আমার মৃত্যু কামনা করছিল।”