নাস্তিকতা মানুষকে অর্জন করতে হয়। উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া নিজের পরম্পরা, বিশ্বাস, পরিবারের সংস্কার, প্রচলিত ধ্যান-ধারণাকে অস্বীকার করার মতো যুক্তি একজন মানুষকে প্রকৃতই শিক্ষিত করে তোলে। প্রকৃতই যাঁরা বিজ্ঞানের চর্চা করেন, নিজের পর্যবেক্ষণকে যাঁরা ব্যাখ্যা করতে পারেন তাঁরা কোনো কিছুকে অন্ধভাবে মেনে নিতে পারেন না। নাস্তিকরা আস্তিকদের মতো নিজের যুক্তিকে অন্যের উপর কখনোই চাপান না। নাস্তিকরা তর্ক করেন, যুক্তি দেন, বিশ্লেষণ করেন–আর আস্তিকরা জ্ঞান-যুক্তির অভাবে অন্ধভাবে নিজের বিশ্বাসকে আঁকড়ে ধরে থাকেন। নাস্তিকরা তর্ক করেন, যুক্তির কথা বলেন, বিশ্লেষণ করেন; অপরদিকে আস্তিকরা নিজের মত ও বিশ্বাসের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠায় রক্তপাতেও দ্বিধা বোধ করেন না। ধার্মিকদের মতের সমর্থন দেওয়ার জন্য পৃথিবীতে মানুষের অভাব পড়ে না। ভবিষ্যতেও অভাব পড়বে না। ধার্মিকদের রাষ্ট্রসহ প্রচুর পৃষ্ঠপোষক থাকে। কোটি কোটি টাকার ডোনেশন আসেধার্মিকদের বাঁচিয়ে রাখার জন্য। কিন্তু নাস্তিকদের সেই সমর্থনটা কোথা থেকেও পাওয়া যায় না।
অবশ্য সমর্থনের দরকার পড়ে না। কেউ সমর্থন করবে না-জেনেই মানুষ নাস্তিক হয়। পরিবারের সমর্থন বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই থাকে না, থাকে না বন্ধু-বান্ধবদের সমর্থনও। নাস্তিকদের লড়াইটা একাই করতে হয়। সর্বশক্তিমান আস্তিক বা ধার্মিকদের বিপক্ষে দাঁড়িয়ে লড়াইকরাটা যে কী কঠিন তা একমাত্র নাস্তিকরাই বোঝেন, হাড়েহাড়ে! খ্রিস্টানদের স্বপ্ন যদি সমগ্র পৃথিবীর ৭০০ কোটি মানুষ খ্রিস্টান বানানো ন্যায্য হয়, মুসলিমদের স্বপ্ন যদি সমগ্র পৃথিবীর ৭০০ কোটি মানুষ মুসলিম বানানো ন্যায্য হয়, হিন্দুদের স্বপ্ন যদি সমগ্র পৃথিবীর ৭০০ কোটি মানুষ হিন্দু বানানো ন্যায্য হয়, বৌদ্ধদের স্বপ্ন যদি সমগ্র পৃথিবীর ৭০০ কোটি মানুষ বৌদ্ধ বানানো ন্যায্য হয়–তবে অবশ্যই নাস্তিক চিন্তাশীল মানুষরাও স্বপ্ন দেখবে সমগ্র পৃথিবীর ৭০০ কোটি মানুষকে নাস্তিক বানানোর এবং অবশ্যই সেটা ন্যায্য হয়। দেখছিলাম কতিপয় ধর্মান্ধ ব্যক্তি রাস্তায় ‘নাস্তিকদের ফাঁসি চাই’ লিখে দাবি জানাচ্ছে, নাস্তিকরাও বলুক ওইসব ধর্মান্ধ ‘আস্তিকদের ফাঁসি চাই’। কেনই-বা ফাঁসিতে ঝোলানো হবে নাস্তিকদের?
নাস্তিকতা কোনো অপরাধ হতে পারে না। নাস্তিক্যবাদীরা অপরাধী হলে আস্তিক্যবাদীরাও শতগুণ বেশি অপরাধী। কোনো আস্তিক কোনো ধর্মকে শ্রেষ্ঠ বলছে মানে বাকি সব ধর্মকে নিকৃষ্ট বলছেন –এই নিকৃষ্ট বলার অপরাধেই সেইসব আস্তিকদের ফাঁসি হওয়া উচিত। আস্তিকদের এই ধারণাই বিশ্বজুড়ে রক্তপাত ঘটায়। যাঁরা রক্তপাত ঘটান তাঁরা দীর্ঘজীবন লাভ করবেন, আর যাঁরা মানুষকে অন্ধকার থেকে আলোর পথে আনার চেষ্টা করে চলেছে নিরন্তর, তাঁদের ধরে ধরে ফাঁসি দেবেন। বাঃ। মধুচক্রে উঁকি মারা মানা যে! আস্তিকগণ মনে রাখুন, নাস্তিকদের ঠিক ততটাই বাঁচার অধিকার আছে, যতটা অধিকার আপনাদের। তাঁদের ফাঁসি চাওয়ার কে তোমরা? তাঁদেরকে তাদের মতো বাঁচতে দাও। মানুষকে ভালবাসাই ধর্ম, এর বাইরে আর কিছু বলার নেই।
আশার কথা, নাস্তিকরা ক্রমশই বাড়ছে। জগতের সব মানুষ যখন অন্ধবিশ্বাসে এবং কুসংস্কার বিশ্বাসে মগ্ন ঠিক সেই সময়টিতে প্রচুর মানুষ প্রতিদিন নাস্তিক হচ্ছেন। পৃথিবীর বেশিরভাগ বিখ্যাত জ্ঞানী মানুষগুলোই যে নাস্তিক। তা সত্ত্বে আস্তিকগণ নাস্তিকগণদের হত্যা করে নাস্তিকশূন্য করতে চায়। সেটা সম্ভব হবে না। নাস্তিকগণ মনে করেন, চারপাশে যে লোকগুলো আস্তিক তাঁদের জন্য করুণা হওয়া উচিত। এঁরা প্রকৃতপক্ষে অন্ধ এবং বাস্তবতাবর্জিত মানুষ। কুসংস্কারাচ্ছন্ন এইসব অন্ধ এবং মিথ্যেকে বিশ্বাসকারীদের জন্য একজন নাস্তিকের করুণা ছাড়া আর কিছু দেখানোর নেই। তাঁরা তো বাস্তব জ্ঞান থেকে বঞ্চিত এবং সত্যের আলো থেকে বঞ্চিত মানুষ। এঁরা বাঁচে মিথ্যের মধ্যে, এরা মারা যায় মিথ্যেকে বিশ্বাস করেই। নাস্তিকগণ কুসংস্কারকে এবং মানুষের অন্ধবিশ্বাসকে তুচ্ছ জ্ঞান করে মানবতার জন্য লড়াই করছেন। নাস্তিকগণ মানবতার সেবক। অন্ধবিশ্বাস এবং কুসংস্কারের হাত থেকে মানবতাকে বাঁচাতেই নাস্তিকদের আন্দোলন। মানুষের ইতিহাসে নাস্তিকদের নাম একদিন সম্মানের সঙ্গেই উচ্চারিত হবে। কারণ নাস্তিকরাই সমাজ থেকে অন্ধবিশ্বাস, কুসংস্কার এবং মিথ্যে বিশ্বাসকে সমাজ থেকে ঝেটিয়ে বিদায় করে দেবে।
ঈশ্বরের নামে, ধর্মের নামে যাঁরা মধুচক্র চালাবে তাঁদের বিরুদ্ধে লড়াই জারি থাকবে। বৈষম্যমূলক ও শোষণমূলক সমাজে থাকে নানা ধরনের অসুস্থ নিষ্ঠুর উপসর্গ যা কোনো অনুভূতিশীল মানুষের মন বেদনার্ত করে তুলবে। এই বেদনাই ধর্মের বিরুদ্ধে কলম ধরতে আমাদের মধ্যে প্রেষণা সৃষ্টি করে। অভিজিতের সঙ্গেই থাকতে হবে। অভিজিতের পথই আমাদের পথ। এই পথ দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর করার লক্ষ্যে আমাদের সংগ্রাম। রিলে করে করে বাটনটা হাতে তুলে নিতে হবে আমাদের। যুদ্ধ শুরু।
শুধু মানুষ কেন, এই বিশ্বের প্রতিটি কণার ধর্ম আছে। সেই হিসাবে নাস্তিকেরও ধর্ম আছে। আমি নাস্তিক, কিন্তু আমিও ধার্মিক। ধর্ম মানে কয়েকটি ভুর্জপত্রে লিখন নয়, যা মেনে চললেই ধার্মিক হওয়া যায় আর না-মানলেই নরকের কীট! মানুষের ধর্ম মানুষের মানবিক গুণ, যা মানুষকে অন্য প্রাণীর থেকে আলাদা করে। আসলে নাস্তিক বলে আলাদা করে ব্যাখ্যা দেওয়ার মতো কিছু আছে বলে মনে হয় না। তবে নাস্তিক, নির্ধার্মিক, অজ্ঞেয়বাদী, সংশয়বাদী–এদের মধ্যে কোনো প্রথাগত বিভেদ নেই, যা আছে তা হল সব বুদ্ধিগত এবং অহিংসতা। এরা সকলেই একই গ্রুপের অন্তর্ভুক্ত। এখন প্রশ্ন উঠতেই পারে আমি নাস্তিক্যবাদী, নাকি আস্তিক্যবাদী? আমি একই সঙ্গে চরম নাস্তিক, চরম সংশয়বাদী, চরম অজ্ঞেয়বাদী, চরম নির্ধার্মিক।