নাস্তিক এবং নাস্তিক্যবাদ–মুসলিমদের মধ্যে মৌলবাদীরা ধর্ম আর ঈশ্বরের বিরুদ্ধে সোচ্চার হলে যে-কাউকেই ‘জঙ্গি নাস্তিক’ বলা হয়ে থাকে। ঘোষণা দেয়–“দেশকে নাস্তিকমুক্ত করতে হবে”, “নাস্তিকদের ফাঁসি দিতে হবে” বাংলাদেশের কেউ কেউ আবার বলেন “বাংলাদেশের নাস্তিকরা আসলে ছুপা হিঁদু”। সরব নাস্তিকদের জঙ্গি মুসলিম, জঙ্গি খ্রিস্টান, জঙ্গি হিন্দু বা অন্য যে কোনও ধর্মীয় জঙ্গিদের সঙ্গে এক পংক্তিতে ফেলার এই যুক্তিহীন ভিত্তিহীন প্রবণতা। নাস্তিকদের বিরুদ্ধে সব আস্তিক্যবাদীদেরই একইরকম খঙ্গহস্ত। নাস্তিকদের পৃথিবী থেকে একেবারে নির্মূল করতে পারলেই আস্তিকদের শান্তি ও স্বস্তি। নাস্তিকবাদীদের হত্যা করেই আস্তিকরা নিশ্চিন্তে সুখনিদ্রা দিতে চান। এ ব্যাপারে সব আস্তিকবাদীদের এক দর্শন। এ থেকেই বোঝা যায় আস্তিকরা কত দুর্বল। ঈশ্বরের প্রতিও ভরসা রাখার আত্মবিশ্বাস নেই। পদে পদে মুখোশ খুলে যাওয়ার ভয়। ভণ্ডামি ধরা পড়ার আতঙ্কে চড়াও হয় নাস্তিকদের উপর।
নাস্তিকরা আস্তিকদের ঘৃণার পাত্র, নিধনযযোগ্য। এই ঘৃণাটা সবচেয়ে বেশি প্রকট মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে। মৌলবাদী মুসলিমরা শুধু নাস্তিক মুসলিমদেরই ঘৃণা করে তা নয়, এঁরা অন্য সম্প্রদায়ের নাস্তিকদেরও ঘৃণা করে। আন্তর্জাতিক এক গবেষণা বলছে, বিশ্বের ৮৫টি দেশে ধর্মে অবিশ্বাসী বা নাস্তিকরা প্রচণ্ড বৈষম্য নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। এর মধ্যে গত এক বছরে অন্তত সাতটি দেশে নাস্তিকদের বিরুদ্ধে চরম নির্যাতন হয়েছে। এই দেশগুলোর মধ্যে আছে ভারত, পাকিস্তান, সৌদি আরব এবং মালয়েশিয়া। ধর্ম বা সৃষ্টিকর্তায় অবিশ্বাসীদের জন্য ৩০টি সবচেয়ে বিপজ্জনক দেশের তালিকায় আছে বাংলাদেশের নাম। ‘International Humanist and Ethical Union’ নামে একটি সংস্থার উদ্যোগে পরিচালিত গবেষণা প্রতিবেদনে এমনই কথা বলা হয়েছে, যা ইউরোপীয় সংসদে পেশ করা হয়েছে।
নাস্তিকদের উপর হামলা নির্যাতনের প্রসঙ্গে পাকিস্তান, ভারত, সৌদি আরব, সুদান এবং মালয়েশিয়ার নাম একাধিকবার এসেছে। ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে এক বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রকে অন্য ছাত্ররা পিটিয়ে হত্যা করেছে এমন সংবাদও প্রকাশ হয়েছে। মালদ্বীপের এক ব্লগার, যিনি ধর্ম নিরপেক্ষতার স্বপক্ষে নিয়ে লেখালেখি করতেন এবং মাঝে মধ্যে ধর্ম নিয়ে কটাক্ষ করতেন, তিনি নিজের ঘরে আততায়ী দ্বারা ছুরিকাঘাতে নিহত হন। সুদানে মোহামেদ আল দোসোগি নামে একজন মানবাধিকার কর্মী তাঁর জাতীয় পরিচয় পত্রে মুসলিম পরিচয় বদলে নাস্তিক হিসাবে পরিচিত হতে চাইলে তাঁকে কারাগারে পাঠানো হয়। IHEU তাঁদের গবেষণা রিপোর্টে উল্লেখ করেছে, ২০১৭ সালে বিশ্বের ৮৫টি দেশে এই ধরণের নির্যাতন চরমে পৌঁছেছে। তার মধ্যে সাতটি দেশে, যেমন–ভারত, মালয়েশিয়া, মালদ্বীপ, মৌরতানিয়া, ভারত, পাকিস্তান, সুদান, সৌদি আরব। ধর্ম এসব দেশে অবিশ্বাসীদের ধরে ধরে বিচারের মুখোমুখি করা হচ্ছে, কখনো-বা অতর্কিতে হত্যা করা হচ্ছে।
৩০টি সবচেয়ে বিপজ্জনক দেশের তালিকায় বাংলাদেশের নাম অবশ্যই আছে। এই তালিকায় আছে মিশর, কাতার, আফগানিস্তান, ইরান ও ইরাক। এর মধ্যে ১২টি দেশে ধর্মত্যাগীদের বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডের বিধান আছে। এই ৩০টি দেশে ‘নাস্তিক’ তকমা দিয়ে চরম মানবাধিকার লঙ্ঘনের অনেক ঘটনা ঘটেছে। বিচার বহির্ভূত খুনও হয়েছে। এমনকি তথাকথিত ধর্ম অবমানকারীদের গুম করার ঘটনাও ঘটেছে। যেসব দেশে নাস্তিকরা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে আছে, সেগুলোর মধ্যে অধিকাংশই মুসলিম প্রধান দেশ। তবে কয়েকটি ইউরোপীয় দেশ এবং যুক্তরাষ্ট্রেও ধর্মে অবিশ্বাসী লোকজনের বিরুদ্ধে বৈষম্যের অভিযোগ পাওয়া গেছে। ব্রিটেনের কেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের ধর্ম বিষয়ক গবেষক ড লোয়া লি বলেছেন–“বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রে ধর্মে অবিশ্বাসীদের বিরুদ্ধে ঘৃণা বা বৈষম্য সাধারণ ঘটনা।” যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের তথাকথিত বাইবেল-বেল্টে নাস্তিকদের বিরুদ্ধে অসহিষ্ণুতা দিন দিন বাড়ছে। কিন্তু কেন এত অসহিষ্ণুতা? পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, বিশ্বজুড়ে ধর্ম বিশ্বাস যত তীব্র হচ্ছে, তেমনি বহু মানুষ নতুন করে নিজেদের অবিশ্বাসী হিসাবে পরিচিত করছে। ফলে দ্বন্দ্ব বাড়ছে। পিউ রিসার্চ সেন্টারের হিসাবে, ২০৬০ সালে গোটা বিশ্বে নাস্তিক এবং ধর্মে অবিশ্বাসীদের সংখ্যা বেড়ে ১২০ কোটিতে দাঁড়াবে। পাশাপাশি ধর্মে বিশ্বাসীদের সংখ্যাও বাড়বে।
বাংলাদেশে মৌলবাদীদের চিন্তাধারায় নাস্তিকরা যত খুশি অন্য ধর্মের সমালোচনা করতে পারে, কিন্তু ইসলামের সমালোচনা করা একদম চলবে না। তাই দেখা যায় বাংলাদেশে এ পর্যন্ত যত নাস্তিক হত্যা হয়েছে, তার মধ্যে সকলেই ইসলাম বিরোধী সমালোচনা করার জন্যেই হত্যা হয়েছে। তা সে হিন্দুই হোক কিংবা মুসলিম। বাংলাদেশে কুখ্যাত প্রথম সারির বেশ কয়েকজন ইসলাম-বিদ্বেষী নাস্তিকের তালিকা তৈরি করা হয়েছে, যাঁরা বাংলাদেশে নাস্তিকতার জন্ম দিয়ে ইসলামের বিরোধিতা করে গেছে ও করছে। দেখা যাক, তালিকায় কারা কারা আছেন।
তালিকার প্রথমেই আছেন বাউল লালন শাহ। লালন শাহকে বলা হচ্ছে সুবিধাবাদী সেকুলার। কোনো ধর্ম পালন করতেন না। বলা হয় জীবনে যতবার গাঁজা টেনেছে ততবার ভাত খেয়েছে কি না সন্দেহ। দেশের সমস্ত নাস্তিক লালন বলতে অজ্ঞান। লালন এমন এক পৃথিবীর স্বপ্ন দেখত, যেখানে ধর্ম বলে কিছু থাকবে না। হিন্দু-মুসলিম-খ্রিস্টান এরকম কোন ধর্মীয় পরিচয় মানুষের থাকবে না। তালিকার দ্বিতীয় নামটি হল আরজ আলি মাতব্বর। আরজ আলি অতি সাধারণ ‘অশিক্ষিত’ এক কৃষক হয়েও সে বাংলাদেশের নাস্তিক সমাজের মধ্যমণি। নাস্তিক-বিদ্বেষীরা মনে করেন–ইসলামি জ্ঞানের স্বল্পতা থাকার দরুন না বুঝেই ইসলাম ধর্ম নিয়ে অনেক অভিযোগ উত্থাপন করেছিল। কোরান হাদিসের ভুল ধরতে গিয়ে সে কেবল তার নিজের সীমাবদ্ধতাকেই তুলে ধরতে পেরেছে। শুধুমাত্র ইসলাম বিরোধিতা করার কারণেই নাস্তিকরা তাঁকে নিজেদের ‘ধর্মগুরু’ বানিয়ে নিয়েছে। আহমেদ শরিফও নাস্তিক ছিলেন বলা হয়। আহমেদ শরিফের ইচ্ছা মেনেই মৃত্যুর পর তাঁর জানাজা এবং কবর কোনোটাই হয়নি। তাঁর একটা বিখ্যাত উক্তি–“পুরুষদের যদি সততা দরকার না হয়, তবে নারীদের সতীত্বের কেন দরকার? নারীরাও যেভাবে খুশি যৌনাঙ্গ বিলাতে পারবে।” হুমায়ুন আজাদও নাস্তিকতার দায়ে মৌলবাদীদের দ্বারা সশস্ত্র আক্রমণের শিকার হয়েছেন। হুমায়ুন আজাদ তাঁর লেখালেখির মধ্য দিয়ে সারাজীবন ধর্মের প্রতি বিষোদগার করে গেছেন। কবি শামসুর রহমানও নাস্তিকতার দায়ে অভিযুক্ত। শামসুর রহমানের একটি কুখ্যাত উক্তি–আজানের ধ্বনি বেশ্যার খদ্দের ডাকার ধ্বনির মতো মনে হয় নাউজুবিল্লাহ। এই একটা উক্তিই নাস্তিক-বিদ্বেষীদের কাছে প্রমাণ করে শামসুর রহমান ইসলাম বিদ্বেষী ছিল। তাঁকে একবার প্রশ্ন করা হয়েছিল –“আপনি কি চান আপনার কবর হোক আপনার খালার কবরের পাশে?” শামসুর সপাটে জবাব দিয়েছিলেন –“আমি তো আমার কবর হোক এটাই চাই না।”