ঘটনাটি কলকাতার। কলকাতার নাদিয়াল থানা এলাকার বাগদি পাড়ায়। নাদিয়াল থানা এলাকার বাগদি পাড়া রিকশা স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে উত্তেজিত গলায় কথা বলছিল এক যুবক আর এক মহিলা। অন্য আর-এক মহিলা ওই দুজনকে প্রাণপণ কিছু বোঝানোর চেষ্টা করছিলেন। হঠাৎই যুবক পোশাকের মধ্যে থেকে একটা তলোয়ার বের করে মহিলার গলায় বসিয়ে দিল কোপ। ধড় থেকে আলাদা হয়ে মাথাটা ছিটকে পড়ল রাস্তায়। খোলা তলোয়ারের সামনে এগোবে কে? যুবক তখন চিৎকার করে বলছে, “এটা আমাদের পারিবারিক বিষয়। কেউ এগোলে গর্দান নামিয়ে দেব।” উঁত-রঙা সালোয়ার-কামিজ পরা ধড় রাস্তাতেই পড়ে রইল। ডান হাতে মুণ্ডটা ঝুলিয়ে নিয়ে হাঁটা শুরু করল সৌম্যদর্শন যুবকটি। বিবাহ-বহির্ভূত সম্পর্কে জড়িয়ে পরিবারের সম্মানহানি করার দায়ে নিজের বোনকে এই ভাবে শাস্তি দিল দাদা। বোনের বয়স ২৪, নাম নিলোফার বেগম। দাদার নাম মেহতাব আলম (২৮)। মেহতাব বোনের মুণ্ড আর তলোয়ার হাতে নিয়ে পুলিশের কাছে ধরা দেয়। এই ঘটনায় স্থানীয় ধর্মবেত্তারা বললেন, “এটা কোনো অন্যায় কাজ নয়। এর মধ্যে কোনো অন্যায় দেখি না। আমাদের ধর্মে নাজায়েস সম্পর্কের কারণে পরিবারের সম্মান রক্ষার্থে এমন কাজ করা যায়। এই কর্তব্য পালন করার জন্য মেহতাবের বেহেস্তে জায়গা হবে”। হ্যাঁ, এটাই তথাকথিত ধর্মের অন্ধকারময় দিক, যা অনেকে মেনে চলার পক্ষপাতী।
একইরকম আর-একটি ঘটনা। এটি পাকিস্তানে সংঘটিত হয়েছে। লাহোরে পারিবারিক সম্মান রক্ষার কথা বলে মা ও দুই বোনকে গলা কেটে হত্যা করেছে দুই যুবক। জানা গেছে, হাতে কোনো মজবুত প্রমাণ না থাকা সত্ত্বেও সৎ দুই বোন আমেনা আর মুক্কাদাসকে নিয়ে মারাত্মক সন্দেহে ভুগতেন কুড়ির কাছাকাছি বয়সের দুই ভাই। বোনেদের নানাভাবে সতর্ক করার পরও নাকি তাঁরা সংশোধন হননি। উপরন্তু মা সুঘরার প্রচ্ছন্ন প্রশ্রয়-আশ্রয় পেয়ে দিনদিন তাঁদের অবাধ্যতা বেড়েই চলেছিল। এর উপর ছিল মহল্লার তরুণদের টিকা টিপ্পনি। বন্ধুরাও কথায় কথায় দুই তরুণীকে নিয়ে হর-হামেশাই রসালো আলোচনায় মেতে উঠত। আর এসব দেখে-শুনে শরীরের রক্ত ফুটে উঠত ভাইদের। শেষপর্যন্ত যাবতীয় বিড়ম্বনার হাত থেকে রেহাই পেতে হত্যার মতো চরম সিদ্ধান্ত নেন তাঁরা। ভোররাতে ঘুমন্ত পঞ্চাশোর্ধ্ব মা এবং দুই যুবতী বোনের গলা ছুরির কোপ বসিয়ে দেয় ওই দুই যুবক। এ ঘটনাও কি ধর্মীয় নির্দেশ পালন করল যুবকটি?
তৃতীয় ঘটনাটি পড়ন। ঘটেছে মহারাষ্ট্রে। তান্ত্রিকের কথায় বিপুল ধন-সম্পদ ও সুখ আর সমৃদ্ধির জন্য নিজের মাকে বলি দিয়েছে দুই ভাই। মাকে হত্যার দায়ে ওই দুই ভাইকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। তান্ত্রিক পলাতক রয়েছে। ভারতের মহারাষ্ট্রের নাসিকে এ ঘটনা ঘটেছে। থানে জেলার ডানডায়াল গ্রামের কাশীনাথ ডোরে এবং গোবিন্দ্র ডোরে এক মহিলা তান্ত্রিক বাচুবাই খড়কের কাছে যায়। তান্ত্রিক দুই ভাইকে ভগবানকে খুশি করার জন্য নিজের মাকে বলি দেওয়ার কথা বলে। কাশীনাথ ও গোবিন্দ্র তান্ত্রিকের কথায় প্রলুব্ধ হয়ে নিজের মা বুধিবাই ডোরেকে হত্যা করে। ঘটনাটি ঘটলে সম্প্রতি নিহত মা বুধিবাই ডোরের মেয়ে একটি সামাজিক সংস্থার কাছে এ বিষয়ে অভিযোগ করে। মাকে হত্যাকারী দুই ভাই জানায়, তান্ত্রিকের কথামতো মাকে হত্যা করার পর সব ধরনের চেষ্টা করার পরও ধনী হতে পারিনি। তাঁরা জানায়, তান্ত্রিক বলেছিল আমাদের মা-বোন ডাইনি এবং তাঁদের জন্য আমাদের ধন-সম্পদ হচ্ছে না। নাস্তিকগণ এ ধরনের বিশ্বাস পোষণ করেন না। নাস্তিকগণ এ ধরনের ঘটনা সংঘটিত করবেন অবিশ্বাসের কারণেই। খুব অন্যায় হবে কী!
আস্তিকগণদের মধ্যে কেউ কেউ বলে থাকেন নাস্তিকদের কোনো জীবনদর্শন থাকে না। জীবনদর্শন? সেটা কেমন দেখতে? সেটা আস্তিক-নাস্তিক ভাবনার উপর নির্ভর করে নাকি? যে জীবনদর্শন মানুষ ধর্মগ্রন্থ পাঠ করে আয়ত্ত করে, বা যে আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতা ধার্মিকেরা অর্জন করে থাকে–নাস্তিকেরা তাঁকে নিশ্চয়ই অপছন্দ করে। তাই বলে নাস্তিকদের জীবনদর্শন নেই এটা বলা যায় না। ধর্মগ্রন্থ পড়লেই জীবনদর্শন লব্ধ হয় না। জীবনদর্শন উপলব্ধির বিষয়। জীবনদর্শন অর্জনের বিষয়। জীবনদর্শন বোধের বিষয়। জীবনদর্শন জীবনচর্চার বিষয়। বলা যায় নাস্তিকেরা প্রকৃতই জীবনদর্শন অর্জন করে থাকে। আস্তিকদের জীবনদর্শন মানেই তো পরকালের প্রস্তুতিমাত্র। জীবনদর্শনের মানে যদি এই হয় নিজেকে পরলোকে ভালো অবস্থানের বা স্বর্গলাভের জন্য প্রস্তুত করা, তাহলে সেই জীবদর্শনকে নাস্তিকরা জীবনদর্শন বলে না। বলে পরলোকদর্শন। তাই নয় কি? নাস্তিকেরা কোনো তত্ত্বের ব্যাখ্যার জন্য কাল্পনিক বা পূর্বপরিকল্পিত সর্বশক্তিমানের সাহায্য নেয় না। তাঁরা সেই তত্ত্বকে বাস্তবের মাটিতে রেখে পর্যবেক্ষণলব্ধ সূত্র থেকে ব্যাখ্যার চেষ্টা করে। যে ঈশ্বর জীবদ্দশায় মানুষকে দু-মুঠো অন্ন জোগানোর ক্ষমতা রাখে না, সেই ঈশ্বর মহাসুখ দেবে–এ ঢপলিং আস্তিকরা বিশ্বাস করলেও নাস্তিকরা বিশ্বাস করে না।
নাস্তিক্যবাদ কি একটা ফ্যাশনমাত্র? এমন কথা আস্তিকগণরা বলেন বইকি! আমি নই, জবাব দিয়েছেন নাস্তিক্যবাদী শুভজিৎ ভৌমিক। শুভজিৎ বলছেন, “মানুষের বিশ্বাস যদি হয় ফ্যাশন বিচারের মাপকাঠি, তাহলে ইসলাম একটা ফ্যাশন, হিন্দুধর্ম একটা ফ্যাশন এবং পৃথিবীর যাবতীয় বিশ্বাস হচ্ছে ফ্যাশন। সেই অনুযায়ী, আপনি যদি ধর্ম পালন করে ফ্যাশন দেখাতে পারেন, তাহলে আমি ধর্মপালন না করে ফ্যাশন দেখাতে পারব না কেন? না মানে, বলতে চাইছি এটা বাকি সবার চেয়ে আলাদা হওয়ার একটা চেষ্টা, তাই না? নির্দিষ্ট ধর্ম পালনই হচ্ছে আসলে মানুষের চেয়ে আলাদা হওয়ার চেষ্টা। আপনি একটি ধর্ম গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে ওই ধর্মটি বাদে পৃথিবীর বাকি ধর্মাবলম্বী জনগোষ্ঠী থেকে আলাদা হয়ে গেলেন, তাই নয় কি? শুধু তাই নয়, এটা আপনাকে একেবারেই আলাদা করে দেবে। এক ধর্মের বিশ্বাসের সঙ্গে আর-এক ধর্মের বিশ্বাসে আকাশ-পাতাল পার্থক্য। এক ধর্ম অন্য ধর্মকে বাতিল করে দেয় এবং অন্য ধর্মাবলম্বীকে ভালো চোখে দেখে না। তাই আপনাকে অন্যান্য ধর্মাবলম্বী থেকে শত হাত দূরে থাকতে হবে। তার মানে কী দাঁড়াচ্ছে? ধর্ম পালন হচ্ছে বাকি সবার চেয়ে আলাদা হওয়ার চেষ্টা।”