ঈশ্বর যে কোনো ধর্ম পৃথিবীতে পাঠাননি সমগ্র পৃথিবীর জন্য এটা একটা প্রধান প্রমাণ। পৃথিবীতে যদি ঈশ্বর কোনো ধর্ম পাঠিয়ে না-ই থাকেন, তিনি যদি আদৌ আমাদের নিয়ে কোনো চিন্তাভাবনা না-ই করেন, তাহলে একজন ঈশ্বর আছেন এটা বিশ্বাস করেই-বা কী লাভ? তবে ঈশ্বর যে মানুষের প্রাত্যহিক জীবনে কোনো ভূমিকা রাখেন না। হাত নাড়লে খেতে পাবেন, না-নাড়লে ভুখা থাকতে হবে। এটা যত তাড়াতাড়ি মানুষ বুঝবে তত তাড়াতাড়ি মানুষের সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনে কথিত ঈশ্বর প্রেরিত ধর্মের প্রভাব থেকে দূরে থাকবে। রাষ্ট্রীয় জীবনে ধর্মের ব্যবহারের মারাত্মক দিকটি থেকে চিরমুক্তি পেতে পারে। এই আস্তিকতা যত তাড়াতাড়ি পৃথিবীতে প্রসার লাভ করবে আমাদের কাঙ্খিত শান্তির পৃথিবীর আশা ততই বাড়তে থাকবে। ঈশ্বর অনেক ব্যাপক বিতর্কের বিষয়। পৃথিবীতে এমন মানুষের সংখ্যা অনেক আছেন যাঁরা ঈশ্বর বিশ্বাস না করলেও প্রচলিত ধর্ম মানেন না। তাঁরা নিজেদের আস্তিক বলেই পরিচয় দেয়। এঁরা স্বর্গ-নরক-জাহান্নম-জন্নত নিয়ে মাথা ঘামায় না।
প্রচলিত ধর্ম যেহেতু মানেন না, তাই ধর্মাচরণ করে অন্য মানুষকে বিব্রত করেন না। ঈশ্বরের বিশ্বাস ও প্রচলিত ধর্ম বিশ্বাস ওতপ্রোতভাবে জড়িত হলেও মোটেইএক নয়। ঈশ্বর আছে কি নেই তার সঙ্গে ধর্ম সঠিক না বেঠিক বিতর্কের সংযোগ সামান্য। যদিও দুটিই মানুষ কর্তৃক সৃষ্ট, তা সত্ত্বেও বলব ধর্মকে নিয়ে বিতর্ক করা যেতে পারে, কিন্তু ঈশ্বরের অস্তিত্ব নিয়ে তর্ক করা মানে ছায়ার সঙ্গে যুদ্ধ করে গাত্র ব্যথা করা। ঈশ্বর নিরাকার বিষয়, ধর্ম চর্চিত এবং রচিত বিষয়। ঈশ্বর ব্যক্তিগত স্বার্থের বিষয়, ধর্ম সমষ্টিগত স্বার্থের বিষয়। ধর্ম সমালোচক মানেই আমাদের সমাজে অবধারিতভাবে নাস্তিক কিংবা অন্য ধর্মের ছদ্মবেশী এজেন্ট। চুড়ান্তভাবে ঈশ্বর আছে কি নেই এসব চিন্তা করে পেট ভরবে না। ধর্মগ্রন্থগুলি তথাকথিত ঈশ্বরের সৃষ্টি, যে যতই বুক বাজিয়ে বলুক না-কেন, তা বাস্তব নয়। কারণ ধর্ম যদি ঈশ্বরের সৃষ্টিই হত এত বিভিন্নতা থাকত না। বিভিন্নতা থাকলেও অবিবেচক হতেন না।
ঈশ্বর যদি ধর্মগ্রন্থগুলি লিখতেন বা প্রেরণ করতেন, তবে হিন্দু-মুসলিম-খ্রিস্টান বৌদ্ধ ইত্যাদি হাজারো ধর্মমত তৈরি হত না। তাহলে বলতে হয় এ পৃথিবীতে যত ধর্মসংক্রান্ত বিড়ম্বনা হয়, সবকিছুর জন্য ঈশ্বরই দায়ী। ধর্মগ্রন্থগুলির বিধান যদি ঈশ্বরের নির্দেশ হয়, সেই ঈশ্বর মোটেই বিচক্ষণ নয়, বিবেচক নয়। গোরু যদি ভারতের দেবতা হয়, তবে তা এখানে মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের ভক্ষ্যণীয় হত না। একই পৃথিবীতে একই জিনিস এক গোষ্ঠীর কাছে দেবতা, অন্য গোষ্ঠীর কাছে খাদ্য হত না। এক গোষ্ঠীর কাছে পাপ, অন্য গোষ্ঠীর কাছে সুন্নত হত না। আরবের জীবনযাত্রা গড়ে উঠেছে মরুভূমি এবং সেখানকার জলবায়ুর উপর। এই সত্য পৃথিবীর সমস্ত ভূখণ্ডের জন্যই। ভৌগোলিক কারণেই সেই অঞ্চলের মানুষদের পোশাক নির্দিষ্ট হয়। তাই আরবের নারী-পুরুষনির্বিশেষে মাথা থেকে পা পর্যন্ত ঢাকা পোশাক পরতে হয়। সে নিয়ম অন্য কোনো দেশের মানুষদের জন্য প্রযোজ্য নয়। কোনো ধর্মগ্রন্থে যদি এই রকম নির্দেশ থাকে তাহলে বুঝতে হবে সেই ধর্মবেত্তাদের বিচক্ষণতার অভাব আছে। ভারতে মরু-জলবায়ুর কারণে রাজস্থানেও এরকম পোশাক পরার প্রচলন আছে। রাজস্থানের মানুষ যে ধরনের পোশাক পরিধান করেন সেই ধরনের পোশাক পশ্চিমবঙ্গের মানুষ পরিধান করতে পারে না। পোশাক ধর্মীয় কারণে নয়, ভৌগোলিক কারণেই নির্ধারিত
যন্ত্রণাক্লিষ্ট মানুষের কাছে ঈশ্বরের বিশ্বাস মানসিক শান্তির জন্য দরকার হতে পারে, তাতে কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু সেই ব্যক্তিগত বিশ্বাসটা অন্যের ঘাড়ে ছলে-বলে-কৌশলে চাপিয়ে দেওয়াটা ঘোরতর অন্যায় কাজ। নাস্তিকগণ আপনার ঈশ্বর-ভাবনায় একমত হবেন কেন? আপনি যেভাবে ঈশ্বরকে নিয়ে ভাবেন নাস্তিকরা সেভাবে ভাবেন না। নাস্তিকরা মনে করেন ঈশ্বর মানুষ সৃষ্টি করেছেন বলেই ঈশ্বর মানুষের মতো দেখতে। গোরু, সাপ, ডাইনোমোরাসরা যদি ঈশ্বর সৃষ্টি করত তাহলে তাদের ঈশ্বর তাদের মতোই দেখতে হত। মানুষের ঈশ্বর মানুষ সহ দু-চারটি প্রাণী ছাড়া আর কোনো প্রাণীরই খবর জানেন না। অথচ জলে-স্থলে-অন্তরিক্ষে সব মিলিয়ে কোটি কোটি প্রাণীর অস্তিত্ব আছে। তাদের ব্যাপারে ঈশ্বর এবং ধর্মগ্রন্থ কিছুই উল্লেখ করেননি। সেটা নিশ্চয়ই নির্মাতাদের সংকীর্ণ জ্ঞানের কারণেই। কে যেন বলেছিলেন—’যে মানুষ সর্বপ্রথম ঈশ্বরের ধারণার জন্ম দিয়েছিল সে জগতের শ্রেষ্ট বাটপার’।
অনেকেই নাস্তিক এবং নাস্তিকতাকে দেশের ও সমাজের পক্ষে সর্বনাশা বলে মনে করেন। নিত্যনতুন অভিযোগ শোনা যায় নাস্তিকদের বিরুদ্ধে। বলেন অমুকে নাস্তিক ছিল সে এই ওই করেছে, সুতরাং নাস্তিকেরা খারাপ। কিন্তু আরও দশজন নাস্তিক যদি উপকার করে থাকেন তাহলেও সে নিয়ে কোনো বিশেষ উচ্চবাচ্য নেই। তা ছাড়া নাস্তিক হলেই যে তাঁকে ষড়রিপু (কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ ও মাৎসর্য) থেকে মুক্ত হতে হবে এমন দোহাই তো কেউ দেননি। নাস্তিকও দোষেগুণে মানুষ, সেটাই স্বাভাবিক। একজন আস্তিকের মতো নাস্তিকেরও কিছু মৌলিক অধিকার আছে এবং থাকবে। বেঁচে থাকার জন্য সবরকমের লড়াই আস্তিকের মতো নাস্তিকেরও থাকবে। নাস্তিক মানে তো এই নয় যে আপনি এক গালে চড় মারলে আর-এক গাল পেতে দেবে আর আর একটা চড় খাওয়ার জন্য। বরং যেটা স্বাভাবিক সেটাই হতে পারে–ইট খেয়ে পাটকেল ফেরত দিতে পারে। সবচেয়ে বড় কথা, নাস্তিকরা যাই-ই করুক তা ঈশ্বরের নামে বা ধর্মের নামে করেন না। তাঁরা যাই-ই করুন না-কেন সব দায় নিজের কাঁধেই নেবেন, ঈশ্বর বা ধর্মের কাঁধে চাপাবেন না। একটা ঘটনাবলি–